পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধবিরতি: তাহলে ট্রাম্প সত্য বললেন নাকি জয়শঙ্কর
Published: 1st, July 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্যের কথা শুনিয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়েছিলেন বলে যে দাবি বারবার জানিয়ে আসছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তা নাকচ করলেন। গতকাল সোমবার নিউইয়র্কে নিউজউইককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের ওই দাবি সম্পর্কে জয়শঙ্কর বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সের ফোনে আলোচনার সময় আমি সেই ঘরে উপস্থিত ছিলাম। কথোপকথনের সময় একবারও বাণিজ্য প্রসঙ্গ ওঠেনি।’
জয়শঙ্কর আরও বলেন, ‘পাকিস্তান অর্থনৈতিক লড়াই শুরু করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল পেহেলগামে হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে জম্মু–কাশ্মীরের অর্থনীতি বিপন্ন করে তুলতে। কাশ্মীরের অর্থনীতি মূলত পর্যটনকেন্দ্রিক। তারা সেটাই ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তা ছাড়া সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করাও ছিল তাদের (পাকিস্তান) লক্ষ্য। তাই, যাদের তারা মেরেছে তাদের ধর্ম কী জানতে চেয়েছে।’
পেহেলগাম–কাণ্ডের পাল্টা ভারত অপারেশন সিঁদুর নাম দিয়ে পাকিস্তানে হামলা চালানোর পর দুই দেশের মধ্যে চার দিন সংঘাত চলেছিল। এরপর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আজও বিতর্ক চলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার (আপাতত ১৬ বার) দাবি জানিয়েছেন, বাণিজ্য চুক্তির কথা শুনিয়ে তিনিই দুই দেশের লড়াই থামিয়েছেন। যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়েছেন।
ভারত ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই দাবি অস্বীকার করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ভারতের আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পাকিস্তানই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। জয়শঙ্করও আগে বলেছিলেন, কারও চাপে বা মধ্যস্থতায় ভারত যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়নি। সোমবার সেই কথাই আরেককটু বিশদভাবে জানালেন তিনি।
জয়শঙ্কর দাবি করেন, ‘৯ মে রাতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্স যখন নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন, তখন আমি সেই ঘরে উপস্থিত ছিলাম। ভান্স সেদিন বলেছিলেন, পাকিস্তান প্রবলভাবে আঘাত হানবে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যাঘাত সইতে হবে। পাকিস্তানের ভয়ে তিনি কুঁকড়ে যাননি।’
জয়শঙ্কর জানান, ৯ মে সত্যি সত্যিই পাকিস্তান জোরালভাবে আক্রমণ হেনেছিল। কিন্তু ভারত সফলভাবে তা প্রতিহত করেছে।
পরদিন ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফোন করেছিলেন জয়শঙ্করকে। তখনই মার্কো রুবিও বলেছিলেন, পাকিস্তান কথা বলতে প্রস্তুত। জয়শঙ্কর এ কথা জানিয়ে বলেন, সেই দিন বিকেলেই পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও) মেজর জেনারেল কাসিফ আবদুল্লা ফোন করেন ভারতের ডিজিএমও লে.
তাঁর উপস্থিতিতে যে কথা হয়েছিল তা জানিয়ে জয়শঙ্কর নিউজউইকের সিইও দেব প্রগাড়কে বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরেই পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ ভারত সহ্য করে আসছে। ২২ এপ্রিল পেহেলগামের হামলার পর অতিষ্ট দেশবাসীর মনোভাব এমন ছিল যে অনেক হয়েছে। এবার একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন। ওই মানসিকতা থেকেই পাল্টা আঘাত করেছে ভারত।
জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিই, সন্ত্রাসবাদীদের এভাবে যা খুশি, তা করতে দেওয়া যায় না। ওরা সীমান্তের ওপারে থাকে। তাই তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না—এই ধারণা বদলানোর দরকার ছিল। আমরা ঠিক সেটাই করেছি।’
যুদ্ধ থামানোর কৃতিত্ব প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য নিয়েই চলেছেন। গত বুধবার দ্য হেগ–এ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আবারও সেই কৃতিত্ব দাবি করে জানান, ‘বাণিজ্য নিয়ে অনেকগুলো ফোন করার মধ্য দিয়েই আমি যুদ্ধ থামিয়েছি। ওদের বলেছি, নিজেরা এভাবে লড়াই করলে আমি বাণিজ্য চুক্তি করব না। ওরা সেই কথা শুনেছে।’
জয়শঙ্কর সেই প্রসঙ্গে বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা দাবি করছেন, সেই অনুযায়ী ফোনালাপ হয়নি। কূটনীতি ও বাণিজ্য একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। দুটি আলাদাভাবে করা হয়। বাণিজ্য নিয়ে যাঁরা আলোচনা চালাচ্ছেন, তাঁরা সবাই পেশাদার। সাফল্যের সঙ্গেই তাঁরা তাঁদের কাজ করছেন।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
যুদ্ধের অবসান জটিল করছে রাশিয়া: জেলেনস্কি
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ার যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হওয়া যুদ্ধ শেষ করার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে।
তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা দেখছি, রাশিয়া বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করছে এবং এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কবে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করবে। এটি পরিস্থিতিকে জটিল করছে।”
আগামীকাল সোমবার জেলেনস্কি ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ট্রাম্প ইতিমধ্যে বলেছেন, তিনি জেলেনস্কিকে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে সম্মত হতে উৎসাহিত করবেন।
আরো পড়ুন:
মেলানিয়ার চিঠি পুতিনের কাছে পৌঁছে দিলেন ট্রাম্প
ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে আসেনি যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা
গত শুক্রবার, আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প জানান, তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি এড়িয়ে সরাসরি স্থায়ী শান্তিচুক্তির দিকে যেতে চান।
ওই বৈঠকের পর ট্রাম্প তার অবস্থান পরিবর্তনের বড় ইঙ্গিত দিয়ে ট্রুথ সোশ্যালে বলেন, “এটাই রাশিয়া-ইউক্রেনের ভয়াবহ যুদ্ধ শেষ করার সবচেয়ে ভালো উপায়। কারণ বেশিরভাগ সময় যুদ্ধবিরতি টেকে না।”
পুতিন-ট্রাম্প বৈঠকের পর ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপে জেলেনস্কি ‘বাস্তব ও টেকসই শান্তির’ আহ্বান জানান। একইসঙ্গে যোগ করেন, ‘আগুন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে’ এবং ‘হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে’।
পরবর্তীতে সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে জেলেনস্কি মস্কোর সঙ্গে ‘টেকসই ও নির্ভরযোগ্য শান্তির’ শর্তাবলী তুলে ধরেন। যার মধ্যে রয়েছে ‘বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা’ এবং ক্রেমলিনের হাতে ‘দখলকৃত অঞ্চল থেকে অপহৃত’ শিশুদের ফিরিয়ে আনা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মন্তব্যে স্পষ্ট হয় যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারে তার অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। কারণ শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি দ্রুত যুদ্ধবিরতি চান।
ইউক্রেনের প্রধান দাবি হলো, দীর্ঘমেয়াদী নিষ্পত্তি নিয়ে আলোচনার আগে দ্রুত যুদ্ধবিরতি এবং ট্রাম্প আগেই ইউরোপীয় নেতাদের বলেছিলেন যে, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের লক্ষ্য হলো একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিশ্চিত করা।
এদিকে পুতিন ট্রাম্পকে একটি শান্তির প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানা গেছে। যেখানে যেখানে শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে দোনবাসের দোনেৎস্ক অঞ্চল থেকে সরে যেতে হবে, এর বিনিময়ে রাশিয়া জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন অঞ্চলে সামনের দিকে অগ্রসর হবে না।
বিবিসি জানিয়েছে, রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় এবং তারপর ৮ বছর পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা চালায়। মস্কো দনবাসকে রাশিয়ার অংশ দাবি করে এবং বর্তমানে লুহানস্কের বেশিরভাগ ও দোনেৎস্কের প্রায় ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
ট্রাম্প আগেও বলেছেন, কোনো শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে ‘কিছু ভূখণ্ড বিনিময়’ থাকতে পারে। জানা গেছে, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প নাকি ফোনালাপে জেলেনস্কিকে এই প্রস্তাবটি জানিয়েছেন।
কয়েকদিন আগেই জেলেনস্কি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, দনবাস অঞ্চল (লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক) রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে না। কারণ ভবিষ্যতে আরো হামলার জন্য এই অঞ্চল ব্যবহার করা হতে পারে।
বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ইউরোপীয় কূটনীতিকরা উদ্বিগ্ন যে, ট্রাম্প সোমবার জেলেনস্কিকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন যাতে তিনি ও পুতিন বৈঠকে যেসব শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন সেগুলোতে জেলেনস্কি সম্মত হন।
সিবিএস সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প ইউরোপীয় নেতাদের বলেছেন, পুতিন ‘কিছু ছাড়; দিতে রাজি, কিন্তু সেগুলো কী তা বিস্তারিত জানাননি।
শুক্রবার ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের পর ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে কী পরামর্শ দেবেন। উত্তরে ট্রাম্প বলেন, “একটা চুক্তি করুন।”
ট্রাম্প আরো বলেন, “রাশিয়া খুব বড় শক্তি আর তারা (ইউক্রেন) তা নয়।”
যদিও পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, পুতিন যুদ্ধ শেষ না করলে মস্কোকে ‘খুব কঠিন পরিণতির’ মুখে পড়তে হবে। ট্রাম্প এর আগে গত মাসে মস্কোকে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর জন্য অথবা সেকেন্ডারি শুল্ক সহ কঠোর নতুন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন।
তবে শুক্রবারের বৈঠকের পর স্পষ্ট কোনো চুক্তি ঘোষণা না হলেও ট্রাম্প বলেছেন, অগ্রগতি হয়েছে।
শনিবার পুতিন বৈঠককে ‘খুব ফলপ্রসূ’ বলে অভিহিত করেন। পুতিন জানান, তিনি ট্রাম্পের কাছে ‘মস্কোর অবস্থান তুলে ধরতে’ সক্ষম হয়েছেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমাদের সুযোগ ছিল, যা আমরা করেছি, এই সংকটের কারণ সম্পর্কে, উৎপত্তি সম্পর্কে কথা বলার। এই মূল কারণগুলো নির্মূল করাই সমাধানের ভিত্তি হওয়া উচিত।”
পরবর্তীতে, রাশিয়ার জাতিসংঘ প্রতিনিধি দিমিত্রি পলিয়ানস্কি বিবিসি নিউজআওয়ারকে বলেন, আলাস্কার এই বৈঠক ছিল ‘শান্তির পথে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি’। তবে তিনি বলেননি, পুতিন এখন জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করবেন কি না।
এদিকে, ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’ জোট ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জোরদার করেছে (যার মধ্যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি রয়েছে)। তারা জেলেনস্কির সোমবার হোয়াইট হাউস সফরের আগে রবিবার বৈঠক করবে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ এবং ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডের লেইনসহ ইউরোপীয় নেতাদের একটি দল বলেছেন, “পরবর্তী ধাপে জেলেনস্কিকে অন্তর্ভুক্ত করে আরও আলোচনা হতে হবে।”
তারা যোগ করেন, “আমরা রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখব। ইউক্রেনের ভূখণ্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ইউক্রেনের উপর থাকবে। আন্তর্জাতিক সীমানা জোর করে পরিবর্তন করা যাবে না।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার ট্রাম্পের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বলেন, “আমরা শান্তির এত কাছাকাছি আগে কখনো আসিনি।”
তিনি আরো বলেন, “অগ্রগতি হয়েছে, তবে পরবর্তী ধাপে অবশ্যই জেলেনস্কিকে অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করতে হবে। ইউক্রেনের শান্তির পথ তার অংশগ্রহণ ছাড়া নির্ধারিত হতে পারে না।”
ঢাকা/ফিরোজ