মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার সময় প্রথম বর্ষের প্রতিটা শিক্ষার্থীর থাকে বুকভরা স্বপ্ন, প্রত্যাশার সুউচ্চ পারদ, নিজেকে মেলে ধরার প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর অন্যরকম এক ভালো লাগা। ধীরে ধীরে হল, বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, টিএসসি, কার্জন, কলাভবন, শহীদ মিনার, ফুলার রোড, মল চত্বর, ভিসি চত্বর হয়ে যায় তাঁর আপন নিবাস। গ্রামে ফেলে আসা জীবন থেকে ধীরে ধীরে কংক্রিটে মোড়ানো ঢাকা শহরের জীবনে হয়ে যায় অভ্যস্ত। অনেকে অনাহারে, অর্ধাহারে আবার অনেকে পুর্ণাহার আর অতি আহার করে এখানে জীবন যাপন করে। একই শ্রেণীকক্ষে পড়াশোনা করলেও প্রত্যেকের গন্তব্য ভিন্ন। কেউ চায় করপোরেট জায়ান্ট হতে, কেউ চায় ৯টা-৫ টা সরকারি চাকরি, কেউ পছন্দ করে শিক্ষকতা আবার কেউবা নিতে চায় দেশের নেতৃত্ব, কেউ কেউ এসবে রস না পেয়ে শিকড়ে ফিরে গিয়ে করতে চায় কৃষিকাজ বা ব্যবসা। যে যেখানেই যাক না কেন দিনশেষে প্রত্যেকেই চায় সফলতার সর্বোচ্চ শিখড়ে যেতে। তবে মুদ্রার উল্টা পিঠও রয়েছে, যা সবখানেই থাকে।

আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৫ তম জন্মদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো যেমন আছে তেমনই খারাপও আছে। সবদিক মিলিয়েই আমরা ঢাবিয়ান। 

জসীম (ছদ্মনাম) তার একান্নবর্তী পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে। ঢাকার আদি নিবাসী জসীমের বাবার অগাধ ধন সম্পদ। বাবার ইচ্ছা ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করে সেখানে সেটেল হবে। কিন্তু জসীম চেয়েছিল নিজের পরিচয় বানাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধের পর ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা জসীম সুযোগ পেলেন। ঢাকার বাসা ছেড়ে এসে উঠলেন হলে। সবাই ভাবল এই ছেলে যেন পাগল। সবাই হল থেকে শান্তি পেলে বাঁচে, অথচ সে ঢাকার আলিশান বাড়ি ছেড়ে এসে হলে থাকছে। কিন্তু এসবে যেন জসীমের মন নেই। সব মন তার পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, ক্লাবিং আর নিজের পরিচয় তৈরি করার কার্যক্রমে। জসীম অবশেষে সফল হলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর থেকে তাঁর বাবাকে সবাই ঢাবি শিক্ষক জসীমের বাবা বলেই পরিচয় দিত আর তিনিও সেই পরিচয়েই পরিচিত হতে চাইতেন।

এর বিপরীত চিত্রও আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাহফুজ (ছদ্মনাম) প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থী। এসএসসি, এইচএসসিতে মেধা তালিকায় স্থান করা এই শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হন বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম সারির একটা বিষয়ে। হলে উঠার পর থেকে তার স্বাভাবিকতা ক্রমেই পরিবর্তিত হতে থাকে। শান্ত, পড়ুয়া ছেলেটা ধীরে ধীরে এসব ছেড়ে দিয়ে কেমন জানি উদাস হতে থাকে। যতই দিন যায় ততই তার বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। এক পর্যায়ে উদ্যানের নেতা হয়ে উঠে। উদ্যানে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে কাপলদের বিরক্ত করা, ছিনতাই করা এগুলা হয়ে উঠে তার নিত্যদিনের কাজ। সারাদিন ক্লাস বাদ দিয়ে ঘুমানো এবং সারারাত উদ্যানে নেশা আর ছিনতাই, চাঁদাবাজি করে কাটে তার সময়। একদিন উদ্যানে ছিনতাই করার সময় আটক হন পুলিশের হাতে। 

তাঁর বাবার কাছে এই খবর পৌঁছানোর পর তিনি কোনোভাবেই তা মেনে নিতে পারেননি। মাহফুজকে পাঠানো হয় রিহ্যাব সেন্টারে। সেখান থেকে স্বাভাবিক জীবনে আসলেও কখনও আর পড়াশোনায় ফেরা হয়ে উঠেনি মাহফুজের!

আরেকদিকে আছে আছেন রাইমা (ছদ্মনাম); নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। দুই ভাই, তিন বোনের পরিবারের বড় মেয়ে তিনি। বাবা দিনমজুর আকবর অনেক কষ্টে মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন। ভর্তির টাকা ম্যানেজ করেছেন কিস্তি তুলে। রাইমা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বাবার সেই কিস্তির কথা মাথায় রেখে প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করেন টিউশন করানো, বিভিন্ন জায়গায় কাজকর্ম করা। পাঁচ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি পড়াশোনা যেমন করেছেন, তেমনি বিভিন্ন কাজে যুক্ত থেকেছেন, পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন। এর ভেতর ছোট দুই ভাই-বোন তার উত্তরসুরী হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখন তিন ভাই বোন একসঙ্গে চাকরি করে বাবা-মাকে নিয়ে ঢাকায় একটা ছোট্ট বাসায় থাকেন। কে জানতো কখনো ঢাকা শহর না দেখা রাইমার মায়ের ঢাকায় একদিন থাকার জায়গা হবে!

গত ১০৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বড় সংকট হলো গবেষণার সুযোগ অনেক কম পাওয়া যেখানে উচ্চ শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল গবেষণা করে দেশ ও জাতি কে আরও বেশি সমৃদ্ধ করা। এছাড়াও অবকাঠামোগত বা পরিবেশগত সুবিধাও উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে অনেক কম। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও গবেষণা ক্ষেত্রে ঢাবিয়ানদের এই পশ্চাদপদ যাত্রার কারন সম্পর্কে জানতে আমরা কথা বলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ড.

ময়না তালুকদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তার ওপর পরিবার এবং সমাজের প্রত্যাশার চাপ বাড়তে থাকে। সবাই চিন্তা করে ছেলেটা বা মেয়েটা যত দ্রুত সম্ভব পড়াশোনা শেষ করে সংসারের হাল ধরবে। আর এই হাল ধরতে গিয়ে আর শিক্ষার্থীরা গবেষণামুখী হতে পারে না। তখন সমাজ বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে তারা শুরু থেকেই বা একটা সময় পর চাকুরির প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে, লাইব্রেরিতে গিয়ে বিসিএসের বই পড়াশোনা করে; যেখানে তাদের উচিত ছিল একাডেমিক কোনো বই হাতে নিয়ে তা নিয়ে গবেষণা করা।’

এই সমস্যার সমাধান জানতে চাইলে ড. ময়না তালুকদার আরও জানান, ‘নিখাদ গবেষক সৃষ্টি করতে হলে আর্থ-সামাজিক মুক্তির বিকল্প নেই, এ ক্ষেত্রে গবেষকদের যথেষ্ট গবেষণা বরাদ্দ প্রদান করাও একটা সমাধান হতে পারে। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের বিকাশের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দিন আর বের হওয়ার দিন এই দুটো সময়ের মাঝে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। কেউ হয় আরও শাণিত, শক্তিশালী, মর্যাদাসম্পন্ন আর কেউ সমাজে উচ্ছিষ্ট হিসেবে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। অথচ একই বিশ্ববিদ্যালয়, একই হল, ক্লাসরুম, একই জায়গা, একই পরিবেশ। এখানে কেউ কাউকে বাধা দেওয়ার নেই, কেউ কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে না। প্রত্যেকের গন্তব্য নিজের হাতে তৈরী করা। এভাবেই ১০৫ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন সৃষ্টি হয়েছে অদম্য মেধাবী সন্তান যারা পরিবার, সমাজ, দেশ তথা বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে, গড়ে তুলেছে আবার ধ্বংস করার মতোও অনেকেরই সৃষ্টি হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই। দিনশেষে আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব রক্ষা করা প্রতিটি শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীর দায়িত্ব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হিমালয় থেকে মরুভূমি পর্যন্ত একই পরিচয়ে পরিচিত সেটা হলো সকলেই ঢাবিয়ান।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব র র ই পর চ

এছাড়াও পড়ুন:

ভিআইপির লাগেজ তল্লাশিতে বাড়তি গুরুত্ব

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করতে নতুন করে ছয়টি ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসেবে বিমানবন্দরে যাত্রীদের লাগেজ আরও গুরুত্ব দিয়ে তল্লাশি করা হবে।

মঙ্গলবার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এ-সংক্রান্ত একটি নোটিশ জারি করে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিশেষ করে ভিআইপি ও ভিভিআইপি যাত্রীদের ব্যাগেজ স্ক্রিনিংয়ে এখন থেকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তারা জানান, নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে ছয়টি অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঠেকানো এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য।

অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো হলো– ভিআইপি ও ভিভিআইপি ব্যাগ স্ক্রিনিংয়ে অধিকতর মনোযোগ দেওয়া; এভিয়েশন সিকিউরিটি সদস্যদের নিয়মিত সচেতনতামূলক ব্রিফিং ও নির্দেশনা; সিসিটিভি মনিটরিং টিমকে বিশেষ নজরদারির নির্দেশনা; মেটাল ডিটেক্টর ও এক্স-রে মেশিনে স্ক্যানের পর ‘হাই রিস্ক’ ব্যাগের ক্ষেত্রে ম্যানুয়াল তল্লাশি বাধ্যতামূলক করা; আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারীদের জন্য বিমানবন্দরে প্রবেশের আগে পূর্বানুমতি নিশ্চিতকরণ এবং রেকর্ড সংরক্ষণ; কোনো ধরনের ‘সিকিউরিটি ব্রিচ’ ঘটলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত কমিটি গঠন ও তাৎক্ষণিক প্রতিরোধমূলক নির্দেশনা দেওয়া।

সম্পর্কিত নিবন্ধ