ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনে কি কাজ হবে
Published: 2nd, July 2025 GMT
ভুয়া মামলা থেকে নিরপরাধ মানুষকে পরিত্রাণ দিতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের যে বার্তা দিলেন, সেটা ইতিবাচক। কিন্তু এই উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো তদন্তাধীন থাকা অবস্থায় মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলা আছে, কমিশনার, এসপি বা এসপি পদমর্যাদার কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো মামলার বিষয়ে যদি ‘মনে করেন’, তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন চাওয়া যৌক্তিক, তাহলে তিনি তা চাইতে পারবেন। প্রতিবেদন প্রস্তুত হলে তখন তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেবেন। ম্যাজিস্ট্রেট যদি দেখেন, মামলায় কোনো আসামিকে বিনা অপরাধে জড়ানো হয়েছে, যাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ কোনো প্রমাণ নেই, তখন তিনি (ম্যাজিস্ট্রেট) সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে (বিনা অপরাধে জড়ানো ব্যক্তি) মুক্তি দিতে পারবেন।
এখানে ‘মনে করার’ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির (পুলিশ কর্মকর্তা) সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন। তিনি মনে করলে মামলার তদন্ত চলাকালে প্রাথমিক প্রতিবেদন চাইবেন, না মনে করলে চাইবেন না। আইনি বিধান এখানে বাধ্যতামূলক নয়। দু–একটি ভুয়া মামলা হলে হয়তো এই বিধান কার্যকর হতে পারে। কিন্তু যেখানে হাজার হাজার ভুয়া মামলা করা হয়েছে এবং একটি মামলায় শতাধিক কিংবা তার বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, সেখানে আইন প্রয়োগের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার মর্জির ওপর ছেড়ে দেওয়া কতটা সমীচীন, তা–ও ভেবে দেখার বিষয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতসহ বিভিন্ন ঘটনায় অন্তত ১ হাজার ৪৯৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৫৯৯টি। অন্যান্য ৯০০টি। এসব মামলায় ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যা মামলার মধ্যে অনেকগুলোর তদন্তে অগ্রগতি আছে বলেও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। তবে ৪০টি মামলা পর্যালোচনা করে ঢালাওভাবে আসামি করাসহ নানা অসংগতি খুঁজে পেয়েছে। এসব মামলায় ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের চেয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিসেবীদের বিরুদ্ধেও ঢালাও হত্যা মামলা হয়েছে। পেশাজীবীদের কেউ দুর্নীতি করলে, কেউ স্বৈরাচারী সরকারের অপকর্মে সহায়তা করলে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হতে পারত। কিন্তু সবাইকে গয়রহ হত্যা বা হত্যাচেষ্টা মামলায় ফাঁসানো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো.
পুলিশ মামলা দেয়নি বলে সরকার দায় এড়াতে পারে না। একই ঘটনায় একাধিক মামলা, এমনকি একই ঘটনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে মামলা হওয়ার রহস্য কী? কেউ যদি ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য মামলা করে থাকেন, সরকারের কর্তব্য হলো তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।
কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া—দুটিই ফৌজদারি অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। বিচারক যদি মনে করেন, আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন, তুচ্ছ, বিরক্তিকর বা হয়রানিমূলক এবং আসামির প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে মামলাটি করা হয়েছে, তাহলে তিনি ওই মামলাকে মিথ্যা মামলা হিসেবে গণ্য করতে পারেন।
আওয়ামী লীগ আমলে আলোচিত ছিল গায়েবি মামলা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তার স্থান নিয়েছে ঢালাও মামলা। কেবল ফৌজদারি কার্যবিধি অল্প কিছু সংশোধন করে নিরীহ মানুষকে রক্ষা করা যাবে না; বরং সরকার উচ্চপর্যায়ে কমিটি করে মামলাগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেভাবেই হোক, মামলার হয়রানি থেকে যেমন নিরপরাধ মানুষ রেহাই দিতে হবে, তেমনি প্রকৃত অপরাধীদের বিচারও নিশ্চিত করতে হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত অপর ধ সরক র তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
যুদ্ধের অবসান জটিল করছে রাশিয়া: জেলেনস্কি
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ার যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হওয়া যুদ্ধ শেষ করার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে।
তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা দেখছি, রাশিয়া বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করছে এবং এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কবে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করবে। এটি পরিস্থিতিকে জটিল করছে।”
আগামীকাল সোমবার জেলেনস্কি ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ট্রাম্প ইতিমধ্যে বলেছেন, তিনি জেলেনস্কিকে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে সম্মত হতে উৎসাহিত করবেন।
আরো পড়ুন:
মেলানিয়ার চিঠি পুতিনের কাছে পৌঁছে দিলেন ট্রাম্প
ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে আসেনি যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা
গত শুক্রবার, আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প জানান, তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি এড়িয়ে সরাসরি স্থায়ী শান্তিচুক্তির দিকে যেতে চান।
ওই বৈঠকের পর ট্রাম্প তার অবস্থান পরিবর্তনের বড় ইঙ্গিত দিয়ে ট্রুথ সোশ্যালে বলেন, “এটাই রাশিয়া-ইউক্রেনের ভয়াবহ যুদ্ধ শেষ করার সবচেয়ে ভালো উপায়। কারণ বেশিরভাগ সময় যুদ্ধবিরতি টেকে না।”
পুতিন-ট্রাম্প বৈঠকের পর ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপে জেলেনস্কি ‘বাস্তব ও টেকসই শান্তির’ আহ্বান জানান। একইসঙ্গে যোগ করেন, ‘আগুন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে’ এবং ‘হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে’।
পরবর্তীতে সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে জেলেনস্কি মস্কোর সঙ্গে ‘টেকসই ও নির্ভরযোগ্য শান্তির’ শর্তাবলী তুলে ধরেন। যার মধ্যে রয়েছে ‘বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা’ এবং ক্রেমলিনের হাতে ‘দখলকৃত অঞ্চল থেকে অপহৃত’ শিশুদের ফিরিয়ে আনা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মন্তব্যে স্পষ্ট হয় যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারে তার অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। কারণ শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি দ্রুত যুদ্ধবিরতি চান।
ইউক্রেনের প্রধান দাবি হলো, দীর্ঘমেয়াদী নিষ্পত্তি নিয়ে আলোচনার আগে দ্রুত যুদ্ধবিরতি এবং ট্রাম্প আগেই ইউরোপীয় নেতাদের বলেছিলেন যে, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের লক্ষ্য হলো একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিশ্চিত করা।
এদিকে পুতিন ট্রাম্পকে একটি শান্তির প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানা গেছে। যেখানে যেখানে শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে দোনবাসের দোনেৎস্ক অঞ্চল থেকে সরে যেতে হবে, এর বিনিময়ে রাশিয়া জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন অঞ্চলে সামনের দিকে অগ্রসর হবে না।
বিবিসি জানিয়েছে, রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় এবং তারপর ৮ বছর পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা চালায়। মস্কো দনবাসকে রাশিয়ার অংশ দাবি করে এবং বর্তমানে লুহানস্কের বেশিরভাগ ও দোনেৎস্কের প্রায় ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
ট্রাম্প আগেও বলেছেন, কোনো শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে ‘কিছু ভূখণ্ড বিনিময়’ থাকতে পারে। জানা গেছে, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প নাকি ফোনালাপে জেলেনস্কিকে এই প্রস্তাবটি জানিয়েছেন।
কয়েকদিন আগেই জেলেনস্কি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, দনবাস অঞ্চল (লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক) রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে না। কারণ ভবিষ্যতে আরো হামলার জন্য এই অঞ্চল ব্যবহার করা হতে পারে।
বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ইউরোপীয় কূটনীতিকরা উদ্বিগ্ন যে, ট্রাম্প সোমবার জেলেনস্কিকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন যাতে তিনি ও পুতিন বৈঠকে যেসব শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন সেগুলোতে জেলেনস্কি সম্মত হন।
সিবিএস সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প ইউরোপীয় নেতাদের বলেছেন, পুতিন ‘কিছু ছাড়; দিতে রাজি, কিন্তু সেগুলো কী তা বিস্তারিত জানাননি।
শুক্রবার ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের পর ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে কী পরামর্শ দেবেন। উত্তরে ট্রাম্প বলেন, “একটা চুক্তি করুন।”
ট্রাম্প আরো বলেন, “রাশিয়া খুব বড় শক্তি আর তারা (ইউক্রেন) তা নয়।”
যদিও পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, পুতিন যুদ্ধ শেষ না করলে মস্কোকে ‘খুব কঠিন পরিণতির’ মুখে পড়তে হবে। ট্রাম্প এর আগে গত মাসে মস্কোকে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর জন্য অথবা সেকেন্ডারি শুল্ক সহ কঠোর নতুন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন।
তবে শুক্রবারের বৈঠকের পর স্পষ্ট কোনো চুক্তি ঘোষণা না হলেও ট্রাম্প বলেছেন, অগ্রগতি হয়েছে।
শনিবার পুতিন বৈঠককে ‘খুব ফলপ্রসূ’ বলে অভিহিত করেন। পুতিন জানান, তিনি ট্রাম্পের কাছে ‘মস্কোর অবস্থান তুলে ধরতে’ সক্ষম হয়েছেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমাদের সুযোগ ছিল, যা আমরা করেছি, এই সংকটের কারণ সম্পর্কে, উৎপত্তি সম্পর্কে কথা বলার। এই মূল কারণগুলো নির্মূল করাই সমাধানের ভিত্তি হওয়া উচিত।”
পরবর্তীতে, রাশিয়ার জাতিসংঘ প্রতিনিধি দিমিত্রি পলিয়ানস্কি বিবিসি নিউজআওয়ারকে বলেন, আলাস্কার এই বৈঠক ছিল ‘শান্তির পথে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি’। তবে তিনি বলেননি, পুতিন এখন জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করবেন কি না।
এদিকে, ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’ জোট ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জোরদার করেছে (যার মধ্যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি রয়েছে)। তারা জেলেনস্কির সোমবার হোয়াইট হাউস সফরের আগে রবিবার বৈঠক করবে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ এবং ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডের লেইনসহ ইউরোপীয় নেতাদের একটি দল বলেছেন, “পরবর্তী ধাপে জেলেনস্কিকে অন্তর্ভুক্ত করে আরও আলোচনা হতে হবে।”
তারা যোগ করেন, “আমরা রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখব। ইউক্রেনের ভূখণ্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ইউক্রেনের উপর থাকবে। আন্তর্জাতিক সীমানা জোর করে পরিবর্তন করা যাবে না।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার ট্রাম্পের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বলেন, “আমরা শান্তির এত কাছাকাছি আগে কখনো আসিনি।”
তিনি আরো বলেন, “অগ্রগতি হয়েছে, তবে পরবর্তী ধাপে অবশ্যই জেলেনস্কিকে অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করতে হবে। ইউক্রেনের শান্তির পথ তার অংশগ্রহণ ছাড়া নির্ধারিত হতে পারে না।”
ঢাকা/ফিরোজ