৯ বছর পর আবার তারা একসঙ্গে, একই ভূমিকায়। কলম্বোর ইনডিপেনডেন্টস স্কয়ারে গতকাল ট্রফি নিয়ে ফটোসেশনে আসার সময় দু’জন কি সে কথাই বলে হাসছিলেন! ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক ছিলেন চারিথ আসালঙ্কা, মেহেদী হাসান মিরাজ ছিলেন বাংলাদেশের নেতৃত্বে। সেই আসরে আসালঙ্কা ছিলেন সর্বোচ্চ স্কোরার আর মিরাজ হয়েছিলেন টুর্নামেন্ট সেরা। প্রজন্মের হাত ধরে তারা দু’জন এখন জাতীয় দলের নেতৃত্বে। তবে আসালঙ্কার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও মিরাজের শুরু আজ কলম্বো থেকেই, যেখানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে তাঁর সামনে।

সিরিজের ঠিক আগমুহূর্তে নাজমুল হোসেন শান্তকে সরিয়ে অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকে। প্রশ্ন রয়েছে– মিরাজ কি পারবেন এ আস্থার মর্যাদা দিতে? তিনি কি পারবেন ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ে দলকে তলানি থেকে উপরে তুলতে? তিন অধিনায়কে সমস্যা হতে পারে– শান্তর বলা এই আশঙ্কাকে তিনি পারবেন ভুল প্রমাণ করতে? পাঁচ সিনিয়র ছাড়া প্রথম ওয়ানডেতে নামা দলে তিনি কি পারবেন শূন্যতাগুলো পূরণ করতে? পারবেন কি প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কার মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ জিততে? মুখে নয়, এসব প্রশ্নের উত্তর মাঠেই দিতে হবে মিরাজকে। 

তিন ম্যাচ সিরিজের অন্তত একটিতে জিততে পারলেই বাংলাদেশের র‍্যাঙ্কিং ১০ থেকে ৯ নম্বরে উঠে আসবে। এই মুহূর্তে ৭৬ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। মাস দুয়েক আগে র‍্যাঙ্কিংয়ের এই অবনতির কারণেই শান্তকে বদলানো হয়েছে। এখন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ যদি ৩-০তে সিরিজ জেতে, তাহলে রেটিং পয়েন্ট হবে ৮৩, র‍্যাঙ্কিং ৯। যদি সিরিজটি ২–১ এ জিততে পারেন মিরাজ তাহলে ৮০ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে নয় নম্বরে চলে আসবেন। যদি ২-১ এ সিরিজও হারে বাংলাদেশ, তাতেও ৯ নম্বর র‍্যাঙ্কিংয়ে উঠবে ৭৭ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে। আর ম্যাচ না জিততে পারলে ১০ নম্বরেই থাকবে বাংলাদেশ, সেই সঙ্গে রেটিং পয়েন্ট কমে দাঁড়াবে ৭৪। তাই জয়ের সঙ্গে র‍্যাঙ্কিংয়ের পুরস্কারের হাতছানি মিরাজের সামনে। 

দলে মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক আর সাকিব না থাকায় ৭৬০ ম্যাচের অভিজ্ঞতা ছাড়া নামতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। সেখানে এই জায়গায় নাজমুল শান্ত, তাওহীদ হৃদয় আর মিরাজের ব্যাট হাতে নেমে দৃঢ়তা আনতে হবে। টপ অর্ডারে নাঈম শেখকে নিয়েও পরীক্ষা চালাতে হবে তাঁকে। লিটন দাসকে ওপেনিংয়ে এনে আস্থা জোগাতে হবে। অধিনায়ক হিসেবে এসব কিছু মিরাজকে গুছিয়ে নিতে হবে। কেননা গত দেড় বছরে আটটি ওয়ানডে খেলে মাত্র একটিতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ, সেটা আফগানিস্তানের বিপক্ষে। তাই প্রেমাদাসায় আজ জয় এনে দিতে পারলে মিরাজের নবযাত্রা স্মরণীয় হয়েই থাকবে।

দলের বোলিং বিভাগ নিয়েও চ্যালেঞ্জ থাকবে মিরাজের সামনে। বিশেষ করে, স্পিনারদের পারফরম্যান্স নিয়ে। সাকিবের না থাকার সময় থেকে গত ১৫ ম্যাচে স্পিনারদের রান দেওয়ার গড় ৬৫.

৬৯। এ সময়ে মাত্র ২৩ উইকেট নিতে পেরেছেন তারা। এর মধ্যে মিরাজ ৯ উইকেট শিকার করেছেন ম্যাচপ্রতি ৭১.৪৪ রান খরচ করে, যা প্রমাণ করে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না মিরাজ, রিশাদ, নাসুমরা। যদিও আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং পিএসএল খেলে এই সময়ের মধ্যে লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন নিজের একটা পরিচিতি দাঁড় করিয়েছেন। সেই সঙ্গে ব্যাটিংয়ের হাত ভালো থাকায় অলরাউন্ড পারফরম্যান্সও করেছেন। রিশাদকে নিয়েই মিরাজের জুটি বাঁধতে হবে স্পিনে। পেসারদের মধ্যে তাসকিন ও মুস্তাফিজ ফিট হওয়ায় নিশ্চিতভাবেই স্বস্তি দিচ্ছে নতুন অধিনায়ককে। সব মিলিয়ে প্রেমাদাসায় নতুন এক সম্ভাবনার সামনে মিরাজ। যেখানে তাঁর হারানো নয়, পাওয়ার আছে অনেক কিছু।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রব ন র স মন

এছাড়াও পড়ুন:

পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে 

পিঠে থুরুং (ঝুড়ি) বাঁধা এক জুমিয়া নারী। মাথায় পাগড়ির বা শিরস্ত্রাণের মতো একটা ট্যাংক। ছবির পরিসরজুড়ে বিশালাকৃতির সেই নারীর চারপাশে বন্দুকধারী অসংখ্য ছায়ামূর্তি। তাদের আকৃতি নারীর তুলনায় বহুগুণ খর্বকায়। ট্যাংকের নল দিয়ে সেসব ছায়ামূর্তির ওপর পড়ছে পাতা আর ফুল।

শিল্পী জয়দেব রোয়াজা কালি ও কলমে এই ছবি এঁকেছিলেন ২০২৩ সালে। তাঁর অন্য সব ছবির মতোই এটিও পাহাড়ের সমকালীন অবস্থাই কেবল তুলে ধরে না; বরং তাকে ভীষণভাবে ছাপিয়ে যায়। বাস্তবতা পেরিয়ে জাদুবাস্তবতার সীমায় এসে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন, সংগ্রাম আর প্রকৃতি সব ভেঙেচুরে কবিতার একটি পঙ্‌ক্তির ভেতরে যেন প্রবেশ করে।

১৯৭৩ সালে খাগড়াছড়ির খামারপাড়ার একটি ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম জয়দেব রোয়াজার। মা নীহারিকা ত্রিপুরা আর বাবা হিরণ্ময় রোয়াজা। হিরণ্ময় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। শান্ত নিরিবিলি পাড়ার বাসিন্দা তাঁরা। পাহাড়, ঝিরি, ঝরনা আর জুমখেত দেখতে দেখতে বড় হওয়া। স্কুলে কবিতার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন নকল করে খাতায় আঁকতেন। কবিতার চেয়ে ভালো লাগত ইলাস্ট্রেশন। শেষে এই ভালো লাগারই জয় হলো। বাংলাদেশের এই সময়কার এক উজ্জ্বল শিল্পী জয়দেব। তাঁর শিল্পকর্মের পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। 

একনজরে জয়দেব

চারুকলার নতুন মাধ্যম পারফরম্যান্স আর্ট। জয়দেব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই ধারার শিল্পীরা নিজের শরীরকেই করে তোলেন ক্যানভাস। সঙ্গে থাকে নানা প্রকাশভঙ্গি। পারফরম্যান্স করতে গিয়ে ছবি আঁকা ছাড়েননি তিনি। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের যেমন স্টোরিবোর্ড, তেমনি জয়দেবের পারফরম্যান্সের প্রতিটি ভঙ্গির ছবি আঁকা থাকে তাঁর স্কেচ খাতায়। এভাবেই দুই মাধ্যমকে যুক্ত করেছেন নিজের ধরনে। পাশাপাশি বড় ক্যানভাসেও ছবি আঁকেন। কালি ও কলমেই সিদ্ধহস্ত তিনি।

ভারতের কোচি বিয়েনাল, হংকং আর্ট বেজেল, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রায়েনিয়ালে অংশ নিয়েছেন তিনি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১১টির বেশি দেশে তিনি পারফরম্যান্স করেছেন। হয়েছে চিত্র প্রদর্শনীও। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, চীনের হংকংয়ের এম প্লাস, ফ্রান্সের প্যারিসের ক্যাডিস্ট ফাউন্ডেশন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির গুগেনহাইম, ভারতের নয়াদিল্লির কিরণ নাদার মিউজিয়ামসহ বিশ্বের খ্যাতনামা বহু জাদুঘরে তাঁর শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। বাংলাদেশে তাঁর শিল্পসংগ্রহ রয়েছে সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন এবং দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে। শিল্পবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আর্ট রিভিউ এশিয়া, আর্ট নিউজ, ফোর্বস এবং ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় তাঁর শিল্পকর্মের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আবুধাবির গুগেনহাইম মিউজিয়াম জয়দেবের একটি শিল্পকর্ম বেশ ভালো দামে কিনে নিয়েছে। বর্তমানে তিনি মুম্বাইভিত্তিক ঝাভেরি কনটেমপোরারি গ্যালারির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। 

পাহাড় আর ঝিরির পথে পথে

খাগড়াছড়ি আর রাঙামাটির ঝিরি পথে বা কাপ্তাই হ্রদের নির্জনতায় সময় কাটে জয়দেব রোয়াজার। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এলেও জীবন কাটান পাহাড়ি জুমিয়াদের মতো। কখনো মাছ ধরতে চলে যান জেলেদের সঙ্গে। আবার কখনো ঝিরি পথে হেঁটে হেঁটে দিন কাটে তাঁর। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কামিলাছড়ি গ্রামে নির্জন হ্রদের ধারে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। সেখানে সপ্তাহের দুই দিন কাটে তাঁর। পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষজনকে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বুনে তোলেন ক্যানভাসে।

জয়দেব দেশের শিল্পীসমাজ ও শিল্পবোদ্ধাদের জগৎ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁর কথায়, ঢাকা তাঁকে কখনো টানে না। দু-এক দিন ঢাকা বা দেশের বাইরে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। ভাবেন, কখন ফিরবেন পাহাড়ে। 

সম্প্রতি কামিলাছড়িতে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেল আট ফুট দীর্ঘ একটি ক্যানভাসে কাজ করছেন তিনি। তিনতলা স্টুডিওর বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অবারিত নীল হ্রদের হাতছানি। হ্রদের পাড়ে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। সেদিকে তাকালে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। বারান্দায় বসে কথায় কথায় জানালেন নির্জন এই পাহাড়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ছবি বিক্রির টাকায় এই স্টুডিও গড়ে তুলেছেন। স্ত্রী হাসনাহেনা পরশের সঙ্গে মিলে জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন। একটাই চাওয়া, একটু আড়াল, একটু নির্জনতা। ছবি আঁকার জন্য এটুকু পরিসর চেয়েছেন জীবন থেকে। 

জয়দেব রোয়াজা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে