আবরার হত্যা ঠেকানোর চেষ্টা না করায় দায় সবার: হাইকোর্ট
Published: 3rd, May 2025 GMT
আলোচিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। এই হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় সঠিক ছিল উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যারা সরাসরি মারধরে অংশ নেয়নি, তারাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে আবরারকে রক্ষা না করে হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে।
গত ১৬ মার্চ বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। সম্প্রতি বিচারপতিদের সই করা পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়েছে।
শনিবার আসামিপক্ষের আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, হাইকোর্টের দেওয়া ১৩১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রকাশের পর সংশ্লিষ্টপক্ষদ্বয়কে সরবরাহ করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে এ মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘হতে পারে কেউ কেউ সরাসরি মারধরে অংশ নেয়নি, কিন্তু তারা সবাই উপস্থিত ছিল এবং ভিডিও ফুটেজে তা স্পষ্ট দেখা গেছে। তারা কেউ আবরারকে রক্ষা করতে যায়নি, বরং পাশ থেকে তা উপভোগ করেছে। এভাবে তারা আবরারকে হত্যায় পরোক্ষ সহায়তা করেছে।’
পর্যবেক্ষণ আরও বলা হয়, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে আবরারকে মারধর করা হয় পূর্বপরিকল্পিতভাবে। এটি হঠাৎ কোনো উত্তেজনার ফল ছিল না। সাক্ষ্যপ্রমাণে এসেছে ৫ অক্টোবর এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজ, সাক্ষীদের বক্তব্য এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত। এছাড়া বালিশ, ভেজা বিছানার চাদর, দড়ি ও ক্রিকেট স্ট্যাম্পসহ অন্যান্য বস্তুত্মূলক প্রমাণও মারধরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
রায়ের শেষাংশে বলা হয়, ট্রায়াল কোর্ট (বিচারিক আদালত) উপস্থাপিত সব সাক্ষ্য, আলামত ও স্বীকারোক্তি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেছে এবং অভিযুক্তদের যথাযথভাবে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিয়েছে। এতে কোনো অনিয়ম বা বেআইনি কিছু পাওয়া যায়নি। তাই আপিল (রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের) গ্রহণযোগ্য নয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো.
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের ভাষ্য, আসামিপক্ষ ফের হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ পাবে। আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে আসামিদের সাজা কার্যকর হবে।
বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র আবরার থাকতেন শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। সেখান থেকে ডেকে নিয়ে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। রাত ৩টার দিকে হলের সিঁড়ির করিডোর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ফেসবুকে ভারতবিরোধী স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন হয়। হত্যাকাণ্ডের পরদিন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলায় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রায় দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার এই রায় হাইকোর্টও বহাল রাখেন।
মৃত্যুদণ্ড বহাল হওয়া আসামিরা হলেন—মেহেদী হাসান রাসেল, মো. অনিক সরকার, মেহেদী হাসান রবিন, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, মো. মুজাহিদুর রহমান, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম তানভীর, হোসাইন মোহাম্মদ তোহা, মো. শামীম বিল্লাহ, এ এস এম নাজমুস সাদাত, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মুনতাসির আল জেমি, মো. শামসুল আরেফিন রাফাত, মো. মিজানুর রহমান, এস এম মাহমুদ সেতু, মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মুজতবা রাফিদ। তখন তিনজন পলাতক ছিলেন। তারা হলেন মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মুজতবা রাফিদ।
আসামিদের মধ্যে মুনতাসির আল জেমি গত ৬ আগস্ট গাজীপুরের হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়াল ভেঙে পালিয়েছে বলে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিততে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় মুহতাসিম ফুয়াদ হোসেন, মো. আকাশ হোসেন, মুয়াজ আবু হুরায়রা, অমিত সাহা ও ইশতিয়াক আহমেদ মুন্নার। আসামিদের মধ্যে তিনজন মামলার শুরু থেকেই পলাতক। তিন আসামি হলেন– এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মাহমুদুল জিসান ও মুজতবা রাফিদ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র রহম ন আইনজ ব আবর র ম রধর
এছাড়াও পড়ুন:
দুই বছর পর মামলা, আসামি আওয়ামী লীগের নেতা, সাংবাদিকসহ ১৫৮ জন
বরগুনা জেলা বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনার দুই বছর পর বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৫৮ জনের নামে মামলা হয়েছে। মামলায় আওয়ামী লীগের নেতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও আইনজীবীকে আসামি করা হয়েছে। এমনকি আসামির তালিকায় আছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতাও। এই মামলা নিয়ে খোদ বিএনপি নেতাদের মধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
পুলিশ বলছে, গত ৩০ এপ্রিল এস এম নইমুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি মামলাটি করেন। তিনি বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এস এম নজরুল ইসলামের ছেলে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের পাশাপাশি এই মামলায় বিস্ফোরক আইনের ধারাও সংযোজন করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে। পুলিশ এরই মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
বিএনপির সূত্র জানায়, বিএনপিতে নইমুল ইসলামের কোনো পদ-পদবি নেই। মামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের বরগুনা সদর উপজেলা শাখার ৮ নম্বর সদর ইউনিয়নের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব সোহাগ মৃধাকেও আসামি করা হয়েছে। তবে এজাহারে তাঁকে জেলা যুবলীগের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া শহরের দুজন ব্যবসায়ীকেও মামলার আসামি করা হয়েছে।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে। এ ছাড়া আসামির তালিকায় আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর কবির, বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার (টুকু), সাবেক মেয়র কামরুল আহসান মহারাজ, মো. শাহাদাত হোসেন, আমতলী পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. মতিয়ার রহমান, বেতাগী পৌরসভার সাবেক মেয়র এ বি এম গোলাম কবির, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ ওয়ালি উল্লাহ, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম, তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজবি উল কবির, যুগান্তরের বরগুনার স্টাফ রিপোর্টার ও আইনজীবী মজিুবুল হক কিসলু, বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহাবুবুল বারী আসলাম, ৬ নম্বর বুড়িরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মামলায় আসামি করা হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও জাহাঙ্গীর কবির বর্তমানে কারাগারে। এ মামলায় আক্তারুজ্জামান নামে সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি গত বুধবার অন্য একটি মামলায় জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
বরগুনা জেলা বিএনপির অন্তত সাতজন নেতা-কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান, বরগুনায় বিএনপির কোনো জেলা কমিটি নেই। এই মামলা করার বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করা হয়নি। মামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন নেতার নামও যুক্ত করা হয়েছে, যা বিস্ময়কর।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২৩ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আসামিরা একটি মিছিল বের করে বরগুনা জেলা বিএনপি কার্যালয়ে হামলা চালান। হামলার সময় তাঁরা অফিস কক্ষ তছনছ করেন, আসবাব, ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জাম ভাঙচুর করেন এবং সেগুলো সড়কে স্তূপ করে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া একাধিক হাতবোমা কার্যালয়ের ভেতর ও বাইরে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
মামলার বাদী এস এম নইমুল ইসলাম বলেন, ওই সময় তাঁরা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো প্রতিকার পাননি। বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মারুফ হোসেন মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা মামলা। বিএনপির নেতা-কর্মীরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ মামলা নিয়ে নানা সমালোচনা করছেন। এতেই বোঝা যায়, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা।’
বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেওয়ান জগলুল হাসান বলেন, ইতিমধ্যে মামলার একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।