মৌলিক সংস্কারে শর্ত সাপেক্ষে একমত হওয়া উদ্বেগজনক
Published: 4th, August 2025 GMT
রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের ক্ষেত্রগুলোতে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর শর্ত সাপেক্ষে একমত হওয়াকে উদ্বেগজনক মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, দলগুলো এখন যেসব বিষয়ে শর্ত সাপেক্ষে একমত হচ্ছে, বাস্তবায়নের সময় যদি সেগুলো না মানতে চায়, তাহলে ঝুঁকির জায়গা তৈরি হবে। একই সঙ্গে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি কী হবে, তার বাধ্যবাধকতা কী হবে, সে সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। ফলে সংস্কারের আশায় ধাক্কা লাগতে পারে এবং রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
গতকাল সোমবার রাজধানীতে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ড.
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা নিয়ে আলোচনা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয় না উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক দলের সংস্কার না হলে, দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে দলগুলো কীভাবে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম ও মো. জুলকারনাইন। পরে গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর সার্বিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন ইফতেখারুজ্জামান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান ও উপদেষ্টা সুমাইয়া খায়ের।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ১১টি সংস্কার কমিশনের আশুকরণীয় বেশ কিছু সুপারিশ চিহ্নিত করে সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করবে বলা হলেও তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো সুপারিশগুলো পাশ কাটিয়ে একটি–দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে অ্যাডহক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা সংস্কারের নামে আরও বেশি সংকট সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের শতাধিক সুপারিশের মধ্য থেকে কয়েকটি সুপারিশ চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে শৌচাগার পরিষ্কার রাখার মতো সুপারিশকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে একধরনের বৈষম্য আছে উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রথম দফায় ছয়টি সংস্কার কমিশনের ওপর অনেকটা যৌক্তিক কারণেই প্রাধান্য বেশি হয়েছে। তবে পরবর্তী পাঁচটি কমিশনের বিষয়ে আলোচনা–পর্যালোচনা বা সামনে কী হবে এবং এই কমিশনগুলোর দেওয়া সুপারিশগুলোর ভাগ্যে কী ঘটবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। নারী, শ্রম, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম এবং স্থায়ী সরকার কমিশনের সুপারিশগুলো এখন পর্যন্ত আলোচনার বাইরে।
সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে কথা বলেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট–পরবর্তী রাজনৈতিক যাত্রা অশুভ ছিল। ৫ আগস্ট বিকেল থেকেই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের একাংশ দলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা–বাণিজ্য শুরু করে এবং এক বছর ধরে তা আরও বেড়েছে। এমনকি দলের উচ্চ পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
সরকারের কোনো কেনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে কিছু কিছু স্বার্থের দ্বন্দ্বপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের উচ্চ মহল থেকে দুদকের কাজে প্রভাব সৃষ্টি করার মতো উদ্বেগজনক ঘটনাও ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এমনটা প্রত্যাশিত ছিল না।
এক বছরের চিত্রগবেষণায় জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, গুমসংক্রান্ত তদন্ত ও বিচার, আইনি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা, নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা, বিচারিক সেবা, আর্থিক খাত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবেশ সংরক্ষণ, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, দুর্নীতি–অনিয়ম প্রতিরোধ, অর্থ পাচার রোধ এবং প্রধান প্রধান অংশীজন তথা রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমসহ সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে।
গুমের ঘটনার বিচারে ধীরগতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার বিরুদ্ধে গুমের আলামত নষ্টের অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর জড়িত সদস্যদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের অবস্থান অস্পষ্ট। র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ বাস্তবায়নেও সরকারের অবস্থান স্পষ্ট নয়।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বলা হয়, নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের একাধিকবার মতামত প্রকাশ বিতর্কিত ছিল। জুলাই–আগস্টে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতার সময় সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুনএনসিপি ‘কিংস পার্টি’, তাদের দুজন সরকারে: টিআইবির নির্বাহী পরিচালক৭ ঘণ্টা আগেজনপ্রশাসনজনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, জনপ্রশাসনে একটি দলের অনুসারীদের পরিবর্তে অন্য দল বা দলগুলোর প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বঞ্চিত হওয়ার নামে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা আদায় চলছে। পতিত সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় বঞ্চিত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি কর্মকর্তা উপসচিব, যুগ্ম সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫৫০ জনকে অনুমোদিত পদের বাইরে এবং ৭৬৪ জনকে ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দেওয়া হয় (এপ্রিল পর্যন্ত)। চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় ৪০ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত)। প্রতিবেদনে পদোন্নতি পাওয়া বা পদবঞ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণে ব্যর্থতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে টিআইবি।
নির্বাচন বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েকটি দলের চাপে যে প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষ দমনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে বলা হয়েছে, সরকার পতনের আগে–পরে সারা দেশে বিভিন্ন থানায় হামলা ও সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। পুলিশের নির্লিপ্ততা ও দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা এবং সামাজিক অসহনশীলতা রোধে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আর্থিক খাত নিয়ে বেশ কিছু ঘাটতি তুলে ধরা হয়েছে টিআইবির প্রতিবেদনে। সেগুলো হলো সঠিক তথ্য–উপাত্তভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন হলেও বাজেটে খাতভিত্তিক বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারা অনুসরণ করা। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সামগ্রিক বরাদ্দ হ্রাস; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গতানুগতিক বরাদ্দ, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম; সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাদ দেওয়া। শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশ গুরুত্ব না দেওয়া এবং বাজেট প্রণয়নে এর প্রতিফলন না থাকা। এ ছাড়া পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে সরকারের কূটনৈতিক কৌশল ও অংশীজনের সম্পৃক্ততায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
অনিয়ম–দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক মূল্যায়নে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুদকের কার্যক্রম রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। তদন্ত ও মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণ অব্যাহত রয়েছে। দুদক সংস্কার বিষয়ে প্রায় সর্বজনীন ঐকমত্য থাকলেও অগ্রগতির সম্ভাবনা হতাশাজনক বলেছে টিআইবি।
রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ১২১রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে টিআইবি বলেছে, গত ১১ মাসে দেশে ৪৭১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১২১ জন নিহত এবং ৫ হাজার ১৮৯ জন আহত হয়েছেন। এসব রাজনৈতিক সহিংসতার ৯২ শতাংশের সঙ্গে বিএনপি, ২২ শতাংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ৫ শতাংশের সঙ্গে জামায়াত এবং ১ শতাংশের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি জড়িত।
গণমাধ্যমবিষয়ক পর্যবেক্ষণে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই অভ্যুত্থান–সংক্রান্ত হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। তিনজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে হামলায় নিহত হয়েছেন (আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত)।
টিআইবি বলছে, এ পর্যন্ত ২৪ জনের বেশি গণমাধ্যমকর্মীকে পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে; আটটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তাপ্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে; অন্তত ১৫০ জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে ‘মব’ তৈরি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি।
এনসিপি কিংস পার্টিসংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ইফতেখারুজ্জামান। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল (কিংস পার্টি) গঠন করা হয়েছে। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, কিংস পার্টি কারা। উত্তরে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা গোপন করার কিছুই নেই। এটি জাতীয় নাগরিক পার্টি। কারণ, এদের সহযোদ্ধা বা সহযাত্রীদের দুজন এখন সরকারে আছেন। সেই হিসেবে কিংস পার্টি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক স ট আইব র প সরক র র পরবর ত ত হয় ছ হয় ছ ন র ওপর ত হওয় আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ সনদ প্রকাশ উচিত নয়
প্রথমত যে বিষয়টিতে আমি গুরুত্ব দিতে চাই, সেটি হলো ঐকমত্য কমিশন কিছু সংস্কার প্রস্তাব ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ (ভিন্নমত) গ্রহণ করছে। আমি এটি সমর্থন করি না। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (গত নভেম্বরে) বলেছিলেন, তাঁরা মূলত ফ্যাসিলিটেটরের (এগিয়ে নিতে সহায়তাকারী) ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর ভাষায়, যতটুকু সংস্কারে সবাই একমত হবেন, ততটুকুই বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হবে। তিনি সংখ্যার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, যদি ১০০টি প্রস্তাব আসে, আর সব দলের সম্মতি মেলে মাত্র ১০টির ক্ষেত্রে, তাহলে কেবল সেই ১০টি বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হবে, বাকিগুলো নয়।
আমি মনে করি, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত করে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা উচিত নয়; বরং যেসব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য রয়েছে, কেবল সেগুলো নিয়েই জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়া উচিত।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, বিএনপি যেসব প্রস্তাবের ব্যাপারে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। ফলে ভবিষ্যতে তারা যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই। কারণ, তারা আগেভাগেই আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছে। সুতরাং এই প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ হওয়ার মানে, আমার কাছে মনে হয় সরকার কোনো একটি পক্ষকে খুশি করার কৌশল হিসেবে এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
গণতন্ত্রে সংখ্যার কথা বলা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবও বিবেচনায় রাখা উচিত। শুধু বিএনপি নয়, জামায়াতে ইসলামী বা জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) যদি কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়, তবে সেগুলো জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত না করাই শ্রেয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদ প্রকাশ করা উচিত নয়।
যে উদ্দেশ্যে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, আমি সেটির সঙ্গে সহমত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) উচ্চকক্ষ গঠনের যে ভাবনা, তাতে ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ ছিল। আমি সেই প্রস্তাবের পক্ষে। তবে আমি নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী।
অবশ্য সবকিছু ছাপিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমে কিছু বিষয় আমাকে যথেষ্ট সন্তুষ্ট করেছে। প্রথমত, কমিশনের সদস্যদের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অকল্পনীয় মাত্রায় খোলামেলা বিতর্ক হয়েছে। তাঁরা একসঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশ পরিচালনার কাঠামো নিয়ে আলোচনা করেছেন, এটা বড় অগ্রগতি। দ্বিতীয়ত, বিএনপির অবস্থানও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেসব প্রস্তাব মানেনি, তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। সমালোচনা হবে জেনেও তারা যেটা করবে না, সে বিষয়ে কথা দেয়নি। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি, সংবিধান ও কমিশনসংক্রান্ত কিছু বিষয়ে একমত হয়নি এবং তা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। আমি এটিকে সৎ অবস্থান মনে করি। অতীতে কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় গিয়ে তা পালন না করার প্রবণতা দেখা গেছে।
এ ছাড়া বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে পৃথক্করণের বিষয়ে সব দল রাজি হয়েছে। এটা একটা অসাধারণ অর্জন। সরকারের সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত পৃথক সচিবালয় হবে, হাইকোর্টের বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে যাবে, নিম্ন আদালত উপজেলায় যাবে—এগুলোতে সবাই একমত হয়েছে, এগুলো অবিশ্বাস্য অর্জন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েও মোটামুটি সবাই একটি জায়গায় পৌঁছেছে। নির্বাচন কমিশন সরকারের হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলার বিষয়ে রাজি হওয়া, কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে না পারার সিদ্ধান্ত—এগুলো খুবই মৌলিক সংস্কার। সব মিলিয়ে যতটুকু একমত হওয়া গেছে তা যথেষ্ট।
জাহেদ উর রহমান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)