দেশে বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করা ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করতে চায় সরকার। বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির মতামতের ভিত্তিতে সরকার এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে। তবে সরকারের এ উদ্যোগ নিয়ে সংস্থাগুলোর কারও কারও মধ্যে আপত্তি রয়েছে।

বিনিয়োগ–সংশ্লিষ্ট যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ), পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষ (পিপিপিএ) এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে একাধিক সংস্থা কাজ করে। কেউ বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়, কেউ নিবন্ধন দেয়, কেউ দেয় জমি বরাদ্দ। এ ছাড়া পরিবেশ ছাড়পত্র, ট্রেড লাইসেন্স প্রভৃতি প্রয়োজনেও বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয়। তবে মাঠপর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। ফলে পদে পদে বিনিয়োগকারীদের হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব নিয়ে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের পরামর্শ ছিল, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এতগুলো সংস্থার বদলে একটি সংস্থা থাকলে তাতে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা সহজ হতো। সেই চিন্তা থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান।

যদিও এ কমিটি গঠন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য, বিনিয়োগকারীদের সুবিধার জন্য একটি একক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম করা যেতে পারে। যেটি বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দরজায় সেবা (ওএসএস) হিসেবে কাজ করবে। তবে সব প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করা ঠিক হবে না। কারণ, অনেক প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত দক্ষতার দুর্বলতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে। আবার বিনিয়োগকারীরা কিছু প্রতিষ্ঠানের অধীন বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নন। ফলে ভালো করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কমিটি গঠন

গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) গভর্নিং বোর্ডের সভায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর একীভূতকরণের প্রস্তাব ওঠে। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিডার গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সভায় একীভূতকরণের প্রস্তাব যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়। সে আলোকে কমিটি গঠন করে ৩০ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।

আট সদস্যের কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানকে। কমিটিতে সদস্যসচিব করা হয়েছে বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীকে। বাকি ছয় সদস্য হলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়–সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো.

মোখলেস উর রহমান ও অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিনিয়োগ–সংশ্লিষ্ট ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে একীভূতকরণের বিষয়ে বিডার উত্থাপিত প্রস্তাবের সামগ্রিক বিষয় পরীক্ষা ও যাচাইপূর্বক মতামত প্রদান করবে এ কমিটি। যদিও বেজা ও বিডা বাদে অন্য চার সংস্থার কাছে প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি পাঠানো হয়নি।

আপত্তি সংস্থা ও বিনিয়োগকারীদের

ছয়টি সংস্থাকে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়ে ইতিমধ্যে আপত্তি জানিয়েছে একাধিক বিদেশি বিনিয়োগকারী ও কয়েকটি সংস্থা। যেমন  নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে ১৪ বছর ধরে ব্যবসা পরিচালনা করছে, এমন একটি চীনা কোম্পানি ২৩ এপ্রিল বিষয়টি নিয়ে চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে চিঠি লিখেছে। চিঠিতে ওই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, বেপজার বিনিয়োগ–সহায়ক নীতির কারণে তাঁরা ইপিজেডে বিনিয়োগ করেছেন। এখন ছয় সংস্থা একীভূত হলে তাঁদের সামনে অনিশ্চয়তা বাড়বে এবং ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ (এফডিআই) নিরুৎসাহিত হবে।

আবার ঢাকা ইপিজেডে কার্যক্রম পরিচালনা করা আরেকটি চীনা বস্ত্র কোম্পানি ২৭ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এ বিষয়ে চিঠি লেখে। চিঠিতে একীভূত করার উদ্যোগ স্থগিতের অনুরোধ জানিয়ে কোম্পানিটির এমডি বলেন, বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যথাযথ আলোচনার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত আসা উচিত।

বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বেজা, বেপজা, হাইটেক পার্কের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তাও এ উদ্যোগের নানা জটিলতার কথা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেজা ও বেপজার দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিডা বিনিয়োগের নিবন্ধন দেয়, কিন্তু জমি বরাদ্দ দিতে পারে না। বেপজা ও বেজা আলাদা আইনের অধীন পরিচালিত হয়। আর বেপজা শুধু রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে। ফলে তাদের কাজের পরিধি, ধরন ও সক্ষমতায় অনেক পার্থক্য রয়েছে। আবার এই ছয় সংস্থার বাইরেও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিনিয়োগ–সংশ্লিষ্ট সেবা দেয়। এগুলো সমন্বয় করে একীভূত প্রতিষ্ঠান তৈরি করা দুরূহ বিষয়। বরং সব কটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি সাধারণ ওএসএস ধরনের প্ল্যাটফর্ম করা যেতে পারে।

ঢাকা চেম্বারের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, সংস্থাগুলো একীভূত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটি ভালো পদক্ষেপ। এতে বিনিয়োগকারীরা সহজে সেবা পাবেন এবং সরকারের পক্ষেও কেন্দ্রীয়ভাবে অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ হবে। তবে বেপজাকে এ প্রক্রিয়া থেকে আলাদা রাখা প্রয়োজন বলে মত দেন শামস মাহমুদ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য একট র জন য এক এক ধ ক পর চ ল ক জ কর আপত ত ব যবস সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশের কৃষিতে যেভাবে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে

নদী ও উর্বর মাটিতে ভরা আমাদের এই দেশে কৃষিই জাতীয় জীবনের মূল চালিকা শক্তি। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই কৃষি এখানে কেবল খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়; এটি ছিল সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার ভিত্তি। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে লুকিয়ে আছে কৃষকের ঘাম, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের গল্প। হাজার বছরের এই কৃষিভিত্তিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে পয়লা অগ্রহায়ণ—নবান্ন উৎসবের দিনটিকে জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এই দিনটি এখন বাংলার কৃষি ও কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধা, অর্জন এবং অঙ্গীকারের প্রতীক। পাশাপাশি দিনটি কৃষির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণের এক জাতীয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।

মোগল আমল পর্যন্ত এ অঞ্চলে কৃষি ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। ব্রিটিশ আমলে জমিদারি প্রথা কৃষিকে করেছিল শোষণের শিকার। মুক্তিযুদ্ধ–উত্তর বাংলাদেশ কৃষিতে ছিল বিপর্যস্ত। ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ ও উৎপাদনহীনতার কঠিন বাস্তবতায় জর্জরিত। ‘কৃষিই হবে উন্নয়নের ভিত্তি’—এই দর্শনে সরকার কৃষি পুনর্গঠনের নীতি গ্রহণ করে।

কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো।

এই সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৮০-র দশক থেকে ধান, গম ও সবজি উৎপাদনে বিপ্লব দেখা দেয়। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ। ধান, সবজি, মাছ-মাংস ও দুগ্ধ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে অগ্রগণ্য। এই রূপান্তরের পেছনে রয়েছে কোটি কৃষকের পরিশ্রম, কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন এবং কৃষি নীতি ও নেতৃত্বের সুপরিকল্পিত দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের কৃষি এখন কেবল চাষাবাদ নয়, এটি জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি সমন্বিত ক্ষেত্র।

অতীতের কৃষি ছিল পরিশ্রমনির্ভর। বর্তমান কৃষি হচ্ছে জ্ঞাননির্ভর। কৃষি গবেষণাগারে উদ্ভাবিত হচ্ছে উচ্চফলনশীল বীজ, জলবায়ু সহনশীল জাত, জৈব সার প্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি–নির্ভর স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা। কৃষি এখন উৎপাদন  থেকে টেকসই উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যাতে করে পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে।

দেশের খাদ্যনিরাপত্তার মেরুদণ্ড হলো ধান। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১২০টিরও বেশি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। লবণাক্ততা, খরা ও বন্যা সহনশীল এই জাতগুলো উপকূলীয় অঞ্চলে ধান চাষের সংকট দূর করেছে। এই উদ্ভাবনই বাংলাদেশকে ‘রাইস সেলফ সাফিশিয়েন্ট নেশন’ বা ধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতিতে পরিণত করেছে। সবজি ও ফলের উন্নত জাতের জনপ্রিয়তা বাড়ায় সেগুলো এখন রপ্তানিযোগ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে।

শ্রম থেকে প্রযুক্তির রূপান্তরে যান্ত্রিকীকরণ বাংলাদেশের কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এখন প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর জন্য কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে কৃষকের সময় ও শ্রম বাঁচছে এবং উৎপাদন ব্যয় কমছে।

কৃষকদের পরিশ্রমেই দেশ এগিয়েছে খাদ্যে স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে। তাঁদের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষাই হতে হবে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। একটি টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও কৃষকবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলাই হোক ২০২৫ সালের জাতীয় কৃষি দিবসের মূল অঙ্গীকার।

বাংলাদেশের কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কৃষকেরা মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে ফসলের রোগনির্ণয়, বাজারদর, আবহাওয়ার তথ্য ও সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন। ড্রোন ইমেজিং, স্যাটেলাইট মনিটরিং ও রিমোট সেন্সিং ডেটা ব্যবহার করে জমির স্বাস্থ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। স্মার্ট কৃষি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থাৎ কৃষি ৪.০-এর যুগে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের রোগ শনাক্তকরণ, সার ও পানির সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ এবং বাজার চাহিদা বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে।

বাংলাদেশের কৃষি এখন আর শুধু পুরুষের নয়, নারীর হাতও সমানভাবে এর অগ্রযাত্রায় যুক্ত। তাঁরা বীজ বপন, রোপণ, ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। নতুন প্রজন্মের তরুণেরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘স্মার্ট অ্যাগ্রিপ্রেনিউরশিপ’ শুরু করছে। ই-কমার্স ভিত্তিক কৃষিপণ্য বিক্রয় প্ল্যাটফর্ম, হাইড্রোপনিক ফার্মিং ইত্যাদি কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার’ মডেল। এই মডেলে উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং কৃষকের সহনশীলতা বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে এখন চাষ হচ্ছে লবণাক্ততা সহনশীল ধান, বন্যাপ্রবণ এলাকায় গড়ে উঠেছে ফ্লোটিং গার্ডেন বা ভাসমান কৃষি।

শুষ্ক এলাকায় রয়েছে ড্রিপ সেচ ও সোলার কৃষি। বাংলাদেশের এই জলবায়ু সহনশীল কৃষি মডেল আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। জমি ক্রমে কমছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষিজমির প্রায় ৩০ শতাংশ জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাই টেকসই কৃষি কৌশলই একমাত্র সমাধান।

কৃষি এ দেশের অর্থনীতি ও খাদ্যনিরাপত্তার ভিত্তি হলেও কৃষকই সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত, অথচ কৃষির মোট জিডিপি অবদান মাত্র ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। মানে দাঁড়ায়, কৃষকের পরিশ্রমের প্রকৃত আর্থিক মূল্য সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না।

এই বৈষম্যই কৃষক–জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। কৃষিপণ্যের বিপণনব্যবস্থা এখনো মধ্যস্বত্বভোগীনির্ভর। কৃষক থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে একাধিক ধাপ পার হয়, যেখানে কৃষক সর্বনিম্ন অংশ পান। কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ঘাটতি থাকায় প্রতিবছর ২৫-৩০ শতাংশ কৃষিপণ্য নষ্ট হয়ে যায়। যদি কার্যকর কৃষি বিমা ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে কৃষকেরা উৎপাদনে ঝুঁকি নিতে সাহস করবেন।

কৃষির ভবিষ্যৎ এখন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। প্রিসিশন ফার্মিং, স্মার্ট গ্রিনহাউস, ড্রোন ডেলিভারি সিস্টেম, বায়োইনফরমেটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কৃষিনীতির ধারণাগুলো আগামী দিনের কৃষিকে পুনর্গঠন করবে। বিশ্ব কৃষি বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হলে এই প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিবিপ্লবকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। পাশাপাশি, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ‘কৃষক থেকে ভোক্তা’ সরাসরি বিপণনব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

কৃষকদের পরিশ্রমেই দেশ এগিয়েছে খাদ্যে স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে। তাঁদের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষাই হতে হবে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। একটি টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও কৃষকবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলাই হোক ২০২৫ সালের জাতীয় কৃষি দিবসের মূল অঙ্গীকার।

গোলাম মর্তুজা সেলিম, কৃষি সংগঠক ও রাজনৈতিক কর্মী
ইমেইল [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের কৃষিতে যেভাবে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে