সরকার যুদ্ধংদেহী হলেও পাকিস্তানের মানুষ কেন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চান না
Published: 5th, May 2025 GMT
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সাঁজোয়া যানের বহর সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে। আকাশে যুদ্ধবিমান ছুটে বেড়াচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দায় প্রচারিত হচ্ছে সংঘাতের আশঙ্কা বার্তা। জাতীয় নেতারা যেকোনো সামরিক পদক্ষেপের কড়া জবাব দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কিন্তু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান যখন যুদ্ধংদেহী গর্জন তুলছে, তখন দেশটির অবসাদগ্রস্ত সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করাকে দেশের জন্য সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় হিসেবে দেখছেন।
সরকারি বক্তব্য আর জনগণের ক্লান্তির মধ্যকার এ ফারাক থেকে স্পষ্ট, পাকিস্তান এখন আরও গভীর ভঙ্গুর অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক হতাশা দেশটির নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো এবং বাসাবাড়িতে যুদ্ধ বা সীমানা নিয়ে আলোচনার তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, প্রতিনিধিত্বহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং অনিশ্চয়তায় ঢাকা ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশি কথা হচ্ছে।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় দুই দেশের দীর্ঘদিনের শত্রুতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ হামলার এক সপ্তাহ পর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অধ্যয়নরত ২১ বছর বয়সী তাহসিন জাহরা বলছিলেন, ‘এটা আমাকে অস্থির করে তোলে।’
তাহসিন আরও বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি, নেতারা শুধু শক্তি প্রদর্শন করতে চান। এমনিতেই আমাদের অনেক সমস্যা আছে। এর ভেতর যুদ্ধ নিয়ে এত কথা বলাটা খুব বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। আমাদের শান্তি দরকার, নতুন কোনো ঝামেলা নয়।’
এই পাকিস্তানি শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় আমার পরিবারের জন্য শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ রাজনীতিবিদদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাঁরা অনেক বেশি কথা বলেন। কিন্তু আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন দেখি না। মনে হয়, তাঁরা বুঝতেই পারেন না, মানুষ কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’
যাঁরা এখনো দেশপ্রেমে অটল আছেন, তাঁদের মধ্যেও দেশের সামনে থাকা বিশাল বাধাগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে।
পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো এবং বাসাবাড়িতে যুদ্ধ বা সীমানা নিয়ে আলোচনার তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি বেকারত্ব, প্রতিনিধিত্বহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং অনিশ্চয়তায় ঢাকা ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশি কথা হচ্ছে।ইসলামাবাদের ২৫ বছর বয়সী আরেক শিক্ষার্থী ইনামুল্লাহ বলেন, ‘আমি মনে করি, দেশ এখন অনেক দুর্বল। কারণ, অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের পেছনের দিকে টেনে নিচ্ছে।’
তবু পাকিস্তানের নাগরিকেরা আশ্চর্য রকমের সহনশীল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুদ্ধকে ব্যঙ্গ করে তৈরি মিম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। যেগুলো মাঝেসাঝে অনেক পাকিস্তানির চোখে ভারতীয়দের ‘যুদ্ধবাজ মনোভাবকে’ উপহাস করে বানানো। এ ধরনের কালো কৌতুক বা হাস্যরসকে অনেকে মানসিক চাপ সামলানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন।
লাহোর শহরের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাভেরিয়া শাহজাদ বলেন, হ্যাঁ, এটিকে সহনশীলতা বলা যায়। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মনোযোগ–বিচ্যুতিও বটে।
শাহজাদ বলেন, গত কয়েক বছরে তিনি তাঁর রোগীদের মধ্যে এক গভীর হতাশা লক্ষ করেছেন। তাঁর মতে, রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে এবং দেশ এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।’
পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরেই সেনাবাহিনী কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। শুধু সীমান্ত রক্ষা নয়; বরং পর্দার আড়াল থেকে দেশের রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করছে তারা। এটি ঐতিহাসিকভাবে জনগণের গভীর আনুগত্য অর্জন করেছে এবং জাতীয় সংকটকালে, যেমন ভারতের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
২০১৯ সালে যখন ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সশস্ত্র গোষ্ঠী ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্যকে হত্যা করে এবং দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে, তখনো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি জনসমর্থন ছিল প্রবল।
লাহোরের কাছে একটি সীমান্ত নিরাপত্তাচৌকি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক
এছাড়াও পড়ুন:
মামদানির জয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি যেভাবে বদলে দিতে পারে
নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশেও ছিল বিপুল কৌতূহল ও উৎসাহ। কারণ, মুসলমান প্রার্থী জোহরান মামদানি, যাঁকে বলা হয়েছে নিউইয়র্কের ‘বাঙালি আন্টিদের’ প্রার্থী—তিনিই ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী। নিউইয়র্ক সিটি ‘বাঙালি আন্টিদের’ নিরাশ করেনি। জোহরান মামদানি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হলেন এবং ইতিহাস গড়লেন।
নিউইয়র্ক সিটি ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি মিনিয়াপোলিসে মেয়র নির্বাচন হলো, সেখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন একজন মুসলমান প্রার্থী—ওমর ফাতেহ।
৪ নভেম্বর, মেয়র নির্বাচন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হলো নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়ার দুটি স্টেটে গভর্নর পদে। দুটিতেই ট্রাম্পের মনোনীত প্রার্থীদের হারিয়ে ডেমোক্র্যাটরা জয়ী হয়েছেন। এ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় হার হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। শুধু নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়ায় নয়, যেসব স্টেটে ভোট হয়েছে, তার এক্সিট পুলে দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বড় আকারে মার্কিন জনগণের আস্থা হারিয়েছেন।
নিউইয়র্ক সিটিতে মামদানির জয়জয়কারনিউইয়র্ক সিটির মেয়র এখন একজন অভিবাসী মুসলমান! তাঁর গুরুত্ব ও পরিচিতি থাকবে সারা বিশ্বে। জোহরান মামদানি নির্বাচিত হওয়ায় সারা বিশ্বের মুসলমানরা অবশ্যই আনন্দিত, তবে মামদানিকে তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য নিউইয়র্কের জনগণ নির্বাচিত করেননি। তাহলে মাত্র ৯ শতাংশ মুসলমান ভোট নিয়ে তিনি প্রাইমারি থেকেই বিদায় নিতেন। তাঁর পরিচিতি ও দিগন্ত আরও বিশাল। তাই তো নিউইয়র্কের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাঁকে মেয়র হিসেবে বেছে নিয়েছে।
নিউয়র্ককে বলা হয় ‘ইহুদিদের শহর’। পৃথিবীর যত নামীদামি ধনি ইহুদি আছেন, তাঁদের বেশির ভাগ বাস করেন নিউইয়র্ক শহরে। সেই শহরে ভারত-উগান্ডার একজন মুসলমান অভিবাসীর ছেলে নিউইয়র্ক শহর জয় করে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সম্পদশালী ব্যক্তিত্ব সর্বতোভাবে মামদানির বিরোধিতা করেছিলেন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনে মামদানি সাবেক গভর্নরের অ্যান্ড্রু কুমো ও বর্তমান মেয়র এরিখ আদামসকে হারিয়ে দলের মনোনয়ন পান। অন্য যেকোনো প্রার্থীর জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার পর নির্বাচিত হওয়া খুব সহজ হতে পারত। কারণ, নিউইয়র্ক সিটিতে ৭০ শতাংশ ভোটার ডেমোক্রেটিক পার্টির রেজিস্টার্ড ভোটার। কিন্তু মামদানির জন্য কাজটা অত সহজ ছিল না।
আরও পড়ুনমামলাবাজ ট্রাম্পের ‘আইনি যুদ্ধ’ কার স্বার্থে০৯ অক্টোবর ২০২৫সবচেয়ে বড় বাধা আসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প থেকে। তিনি মামদানিকে হারানোর জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিলেন। অ্যান্ড্রু কুমোকে ট্রাম্প পরিচিত করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মামদানির বিরুদ্ধে আবার সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। টাকাপয়সার সংস্থানও তিনি করলেন বড় ইহুদি ব্যবসায়ীদের চাঁদা নিয়ে। তিনি চাপ দিয়ে বর্তমান মেয়র এরিখ আদামসকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে দিলেন, যাতে তাঁর ভোটগুলো অ্যান্ড্রু কুমো পান। এরিখকে বলা হলো তাঁকে সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত করা হবে।
সিনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা চাক সুমারসহ ডেমোক্র্যাট অনেক নেতা মামদানিকে সমর্থন করতে অস্বীকার করলেন। সুমার নিজেও একজন ইহুদি ও ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক। কিন্তু বিরোধীদের এত চেষ্টা সত্ত্বেও মামদানির জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনের আগের দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে অ্যান্ড্রু কুমোর প্রতি সরাসরি সমর্থন জানিয়েছেন, যদিও তাঁর এ সমর্থন অনেক আগের থেকেই সবার জানা ছিল।
নির্বাচনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে অ্যান্ড্রু কুমো মামদানির আচরণকে উপহাস করে একটি বিশ্রী বিজ্ঞাপন ছেড়েছিলেন, যেখানে তিনি নিজের হাতে ভাত খান এবং ফিলিস্তিনি অধিকার নিয়ে কথা বলেন এবং কেফিয়া ও ফিলিস্তিনি পতাকাসহ ‘অপরাধীদের’ সঙ্গে ছবি তুলেছেন। কিন্তু এ বিজ্ঞাপন নিউইয়র্কবাসীর অনেককেই বরং মামদানিকে তাঁদের নিজেদের লোক ভাবতে সহায়তা করেছেন।নিউইয়র্ক সিটির জনগণ দৃঢ়ভাবে মামদানিকে সমর্থন দিয়েছেন। কারণ, তিনি নিউইয়র্কের সাধারণ সমস্যাগুলো আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন এবং সেগুলো সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বাড়ি ভাড়া স্থিতিশীল করা, বিনা মূল্যে বাস পরিবহনসেবা ও শিশুযত্ন পরিষেবা সম্প্রসারণ তাঁর প্রস্তাবগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সাধারণ জনগণের এসব সমস্যা নিয়ে আগে কখনো কেউ ভাবেননি। মামদানি তাঁর পরিকল্পনাগুলো সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রতি তাঁর অকপট সমালোচনা এবং ফিলিস্তিনি অধিকারের আদায়ের একজন অবিচল সমর্থক—জোহরান মামদানি বিশ্বের বৃহত্তম ইহুদি জনসংখ্যার একটি শহরে ইহুদি ভোটারদের কাছ থেকে সমর্থন অর্জনের জন্য একজন অসম্ভব প্রার্থী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু নিউইয়র্কবাসী ইহুদিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষ করে তরুণ, প্রগতিশীল ও সংস্কারবাদী ইহুদিরাও তাঁর তারুণ্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণে আকৃষ্ট হয়ে মেয়র নির্বাচনে তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন।
আরও পড়ুনমামদানির জয় থেকে ডেমোক্র্যাটরা কি শিক্ষা নেবেন২৭ জুন ২০২৫নির্বাচনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে অ্যান্ড্রু কুমো মামদানির আচরণকে উপহাস করে একটি বিশ্রী বিজ্ঞাপন ছেড়েছিলেন, যেখানে তিনি নিজের হাতে ভাত খান এবং ফিলিস্তিনি অধিকার নিয়ে কথা বলেন এবং কেফিয়া ও ফিলিস্তিনি পতাকাসহ ‘অপরাধীদের’ সঙ্গে ছবি তুলেছেন। কিন্তু এ বিজ্ঞাপন নিউইয়র্কবাসীর অনেককেই বরং মামদানিকে তাঁদের নিজেদের লোক ভাবতে সহায়তা করেছেন। কারণ, নিউইয়র্কে অনেক অভিবাসীই হাত দিয়ে ভাত খান এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশের বেশি লোক ফিলিস্তিনিদের সমর্থক।
কোনোভাবেই বাহিনীকে দমানো গেল না। জোহরান মামদানি এখন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহর নিউইয়র্ক সিটির মেয়র। মামদানি তাঁর বিজয় বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমার একমাত্র আফসোস, আজকের এ নতুন দিনটা আসতে এত সময় লেগেছে।’
মামদানির সামনে কঠিন পথনির্বাচিত হতে মামদানিকে যে কঠিন পথ পার হতে হয়েছে, সেটি এখন ইতিহাস হয়ে যাবে। সামনে মেয়র হিসেবে সফলকাম হতে তাঁকে আরও কঠিন বাস্তবতার মোকাবিলা করতে হবে। তাঁর প্রথম কাজ হবে, তিনি যে কোয়ালিশন তৈরি করেছেন, সেটিকে অক্ষুণ্ন রাখা। তাঁকে তাঁর কট্টর ফিলিস্তিনি সমর্থন ও শহরের ইহুদিদের আস্থা অর্জন—দুটোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
নিউইয়র্কবাসীকে দেওয়া তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পরিপূর্ণ করা খুব সহজ হবে না। এগুলোর অর্থায়নের জন্য নিউইয়র্কের ব্যবসায়ী ও করপোরেট নেতাদের তাঁর কাছে টানতে হবে।
তাঁর সবচেয়ে বিপদ আসবে ‘মাগা’ কমান্ডার থেকে। ট্রাম্প ওয়াশিংটন ও শিকাগোর মতো বড় শহরে শান্তি রাখার নাম করে এরই মধ্যে ফেডারেল রিজার্ভ সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছেন। তাঁর আসল উদ্দেশ্য শহরের প্রশাসনকে কবজায় রাখা। মামদানি শপথ গ্রহণের পরপরই যে সিটিতে ফেডারেল সেনা পাঠাবার চেষ্টা হবে, তা অনেকটা নিশ্চিত।
এখন সবাই জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে মামদানির প্রভাব দিন দিন বাড়তেই থাকবে এবং অন্য শহরগুলোতেও অনেক মামদানি বের হয়ে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে। ডেমোক্র্যাটরা আশা করে আছেন, মামদানি তাঁর প্রগতিশীল নেতৃত্ব দিয়ে ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বের নতুন মুখ হয়ে উঠতে পারেন।এরই মধ্যে ফ্লোরিডার দুজন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান দাবি করেছেন, বিচার বিভাগ যেন পুরোনো ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখে মামদানি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছিলেন? তাঁদের ধারণা কোথাও কিছু গরমিল পেলে ট্রাম্প মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল করে দিতে পারবেন।
তবে এটিও ঠিক, এই নির্বাচনে যাঁরা মামদানিকে কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা বলবেন, জোহরান মামদানিকে ভয় দেখিয়ে বা ‘হেলা-ঠেলা’ দিয়ে কখনো কুপোকাত করা যাবে না। প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই তিনি মেয়র হয়েছেন এবং মেয়র হিসেবে সফলতার জন্য তিনি সব প্রতিকূলতা চতুরভাবে মোকাবিলা করবেন।
আর একটি বিষয় লক্ষ্য করার, যাঁরা ট্রাম্পকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করেছেন, ট্রাম্প পরবর্তী সময়ে তাঁদের সম্মান দেখিয়ে মেনে নিয়েছেন। যেমন চীন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও পুতিন। মামদানির ক্ষেত্রেও তা–ই হতে পারে, দুজনেই সম্মানজনক সহ–অবস্থান বেছে নেবেন।
এখন সবাই জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে মামদানির প্রভাব দিন দিন বাড়তেই থাকবে এবং অন্য শহরগুলোতেও অনেক মামদানি বের হয়ে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে। ডেমোক্র্যাটরা আশা করে আছেন, মামদানি তাঁর প্রগতিশীল নেতৃত্ব দিয়ে ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বের নতুন মুখ হয়ে উঠতে পারেন।
যাঁরা আশাবাদী তাঁরা বলবেন, মামদানির জয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নতুন আলো ছড়াবে। আবার ট্রাম্পের মতো ‘না-বাদীর’ সংখ্যাও কম নয়। তাঁরা বলবেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে, মামদানির বামপন্থী রাজনীতি নিউইয়র্ককে অন্ধকারে ডোবাবেন। আপনি কোন দলে?
মিনিয়াপেলিসে কি ওমর ফতেহ মেয়র হতে পারবেনযুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিশীল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু যদি কোনো স্টেটকে বলতে হয়, সেটি হবে মিনেসোটা। ষাট ও সত্তর দশকে মিনেসোটার সিনেটর হুবার্ট হামফ্রে ও এককালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়াল্টার মন্ডেল ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রগতি ও মানবতাবাদী রাজনীতির পতাকাবাহী। পরবর্তী সময়ে সোমালিয়ান বংশোদ্ভূত কংগ্রেস ওম্যান ইলিয়ান ওমর ২০১৯ সাল থেকেই মিনেসোটা থেকে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নির্বাচিত হয়ে আসছেন এবং প্রগতিবাদী ককাসে নাম লেখিয়েছেন। মিনেসোটার বড় শহর মিনিয়াপেলিস সিটির মেয়র নির্বাচনও হয়ে ৪ নভেম্বর।
মিনিয়াপোলিস সিটির মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির (যা মিনেসোটাতে ডেমোক্রেটিক ফার্মার ও লেবার পার্টি নামেও পরিচিত) প্রাইমারিতে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দুই মূল প্রার্থী—বর্তমান মেয়র জ্যাকব ফ্রে, যিনি একজন ইহুদি এবং কট্টর ইসরায়েলি সমর্থক। স্টেট সিনেটর ৩৫ বছর বয়সী ওমর ফাতেহ, যাঁকে বলা হয় মিনিয়াপোলিসের মামদানি। ফতেহ একজন গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ও সোমালি বংশোদ্ভূত মুসলমান। এ যেন নিউইয়র্কে সিটির ডুপ্লিকেট। কারণ, ওমর ফাতেহও বর্তমান মেয়রকে হারিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন লাভ করেন।
স্টেট ডেমোক্রেটিক পার্টি ফাতেহকে নিজেদের একমাত্র প্রার্থী হিসেবে অনুমোদন করেছিল। কিন্তু এ অনুমোদন ছিল অল্প কয়েক দিনের জন্য। পরবর্তী সময়ে মেয়র ফ্রের আপত্তিতে স্টেট ডেমোক্রেটিক পার্টি এ অনুমোদন বাতিল করে দেয় এই অজুহাতে যে নির্বাচনের সম্মেলনকক্ষে মাইক্রোফোন, ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেমে ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ভালোভাবে কাজ করছিল না, তাই ভোটাররা সুশৃঙ্খলভাবে ভোট দিতে পারেননি। আসলে এটি ছিল ফাতেহর বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত।
৪ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আবার ফাতেহর ও ফ্রের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। ডেমোক্রেটিক পার্টি ফাতেহর অনুমোদন বাতিল করার পর ফাতেহর নির্বাচনী প্রচারণা দারুণভাবে হোঁচট খায়।
মিনিপোলিস মেয়র নির্বাচনে হয়েছে ‘রাঙ্কেড’ ভোট। প্রত্যেক ভোটার তাঁদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দ বাছাই করে তিনটা ভোট দেন। প্রথম পছন্দ গণনায় ফ্রে ও ফাতেহ প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছেন, কিন্তু দুজনের কেউই ৫০ শতাংশ ভোট পাননি। তাই প্রতিযোগিতা এখনো শেষ হয়নি। ভোটারদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দের প্রার্থীদের বিবেচনায় ব্যালট গণনা অব্যাহত রয়েছে। দু–এক দিনের মধ্যেই জানা যাবে, কে হবেন নতুন মেয়র।
যুক্তরাষ্ট্রে যে মুসলমান রাজনীতিকেরা ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, এর আরেকটি প্রমাণ ভার্জিনিয়া স্টেটসের লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন গাজালা ফেরদৌস হাশমি। তিনি চার বছর বয়েসে ভারত থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী স্টেটের দ্বিতীয় ব্যক্তি।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব