২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার যখন অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করছে, তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এই শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হলেও তা আবার কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা আছে—এই আশঙ্কা দেশের তৈরি পোশাকশ্রমিকদের।

২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক আরোপের ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই ৯ এপ্রিল তা স্থগিত করেন। বাংলাদেশের পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। এর মাঝে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি লেখেন। অঙ্গীকার করেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও বেশি সুতা ও পণ্য কিনবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্যঘাটতি আছে, তা হ্রাসের চেষ্টা করা হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি ৬ বিলিয়ন বা ৬০০ কোটি ডলারের।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের বড় অংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই তৈরি পোশাকের একক বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক স্থগিত হলেও ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বহাল আছে বাংলাদেশের পণ্যে। বাস্তবতা হলো, তৈরি পোশাক খাতে মুনাফার হার অত্যন্ত কম; এ পরিস্থিতিতে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলেও তা হজম করা কঠিন। চীনের সঙ্গে আছে তীব্র প্রতিযোগিতা। সেই সঙ্গে আছে ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে প্রতিযোগিতা।

সাভারের এ৪ ইয়ার্ন ডায়িং কোম্পানিতে কাজ করেন ২৫ বছর বয়সী মুর্শিদা আক্তার। সম্প্রতি এই কারখানায় যোগ দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি কিছুটা বেশি মজুরি পাচ্ছেন। কারখানা বাসার কাছেই। কারখানার কর্মপরিবেশও ভালো। সব মিলিয়ে নতুন এই চাকরি তাঁর জন্য ভালোই হয়েছে। কিন্তু এখন তাঁর শঙ্কা, ট্রাম্পের শুল্ক কার্যকর হলে ক্রয়াদেশ কমে যাবে। ফলে কাজও কমে যাবে।

১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশকে নিয়ে উপহাস করা হতো। বলা হতো, এই দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু ১৯৮০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরজিবাড়িতে পরিণত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ গড়পড়তাভাবে ভারতের মানুষের চেয়ে সচ্ছল।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে মুর্শিদা আক্তারের মতো ৪০ লাখ মানুষ কাজ করেন। সেই সঙ্গে আরও পাঁচ গুণ মানুষ এই ৪০ লাখ মানুষের আয়ের ওপর নির্ভরশীল, যেমন মুর্শিদার স্বামী ও সন্তান। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের পণ্যে ট্রাম্প যে শুল্ক আরোপ করবেন এবং তার সঙ্গে চীনের পণ্যে যে তিনি ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, তার জেরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি ভেঙে পড়তে পারে।

অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে অত্যন্ত সমালোচনামুখর। তাঁর মত, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ ক্ষমতার কদর্য বহিঃপ্রকাশ। এমন এক সময়ে এই শুল্ক আরোপ করা হলো, যখন কয়েক দশকের ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির পর অর্থনীতির গতি কিছুটা কমে গেছে, কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে অর্থনীতি।

শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে লুণ্ঠন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা করে উঠতে পারছে না। তাদের ধারণা, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির গতি অনেকটা কমে যাবে; যদিও ২০২৬ সালের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়াবে বলে তাদের বিশ্বাস। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কে সেই আশায়ও গুড়ে বালি। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক আগামী দুই বছরের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস করেছে। সেই সঙ্গে আইএমএফও বাংলাদেশের ওপর নানামুখী চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আইএমএফের পক্ষ থেকে আমাদের প্রবল চাপ দেওয়া হচ্ছে—ভর্তুকি কমিয়ে মূল্য বাড়াতে হবে।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর দেশের তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারপর বাংলাদেশের পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এই খাতও বুঝতে পেরেছে, টিকে থাকতে হলে পরিবর্তন দরকার। এরপর দেশে অনেকগুলো কারখানা পরিবেশবান্ধব স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের ২৩০টি কারখানা এখন পরিবেশবান্ধব। বিশ্বের আর কোথাও এত পরিবেশবান্ধব কারখানা নেই। রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা কমেছে। কিন্তু এই খাতের রপ্তানিমূল্য বেড়েছে এবং শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়েছে।

বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব কারখানাগুলোর মধ্যে ৪এ ইয়ার্ন ডায়িং অন্যতম। নাম ডায়িং হরেও গত কয়েক বছরে এই কারখানায় ডায়িং বা রং করা হয়নি। এই কারখানায় মূলত উচ্চ মূল্যের কাপড়, যেমন জ্যাকেট ও পানিনিরোধক কাপড় তৈরি করা হয়। কারহার্ট থেকে কেলভিন ক্লেইনের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এই কারখানার ক্রেতা। তবে মার্কিন ক্রেতার চেয়ে তাদের ইউরোপীয় ক্রেতাই বেশি। কারখানার ভেতরে বিশাল বিশাল ফ্যান চলে। সেই সঙ্গে কারখানার ভেতরটা আলোকিত। পরিবেশ সুখকর। কারখানার বাইরের দেয়ালে সবুজ লতাপাতা ঝুলছে।

কারখানাটির মহাব্যবস্থাপক খন্দকার ইমাম বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে এই কারখানায়ও হামলা হয়। কারখানার বাইরে মানুষের জটলা তৈরি হয়। দেশের অনেক কারখানাই শেখ হাসিনা জমানার সমর্থক ছিল—মানুষের মনে এমন ধারণা ছিল।

খন্দকার ইমাম বলেন, এই কারখানা হামলায় করতে প্রায় এক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকদের সঙ্গে তিনিও হেলমেট পরে বাইরের জনতাকে প্রতিরোধ করতে দাঁড়িয়ে যান। শেষমেশ অবশ্য কেউই গুরুতর আহত হননি। এক দিনও উৎপাদন বন্ধ থাকেনি। এই দেশের মতো কোম্পানিটিও জীবনসংহারী হুমকি মোকাবিলা করে টিকে থাকতে শিখে গেছে।

কোম্পানির সাসটেইনেবিলিটি বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতি এই পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। যে আন্দোলনকারীরা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছেন, তাঁরাও এটা জানতেন। দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আছে কেবল শ্রমিক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প ক প রব দ ধ র পর ব শ

এছাড়াও পড়ুন:

বৃষ্টির পানি ধরে রেখে বিপদে দাউদকান্দির মানুষ

কুমিল্লার দাউদকান্দির লোকজন মনে করেন, বৃষ্টির পানি দিয়ে রান্না করলে ভাত সুস্বাদু হয়। এমন ধারণা থেকে পৌরসভার বাসিন্দারা বিভিন্ন পাত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেন। এসব পাত্রে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তাদের পরামর্শে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বৃষ্টির পানি পাত্র থেকে ফেলা হচ্ছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পৌর এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত দুই মাসে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। হাজারের ওপর লোক আক্রান্ত। এরপর দৌড়ঝাঁপ শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগ। ডেঙ্গুর উৎস খুঁজতে দাউদকান্দিতে গিয়ে অনুসন্ধান চালায় সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগ। এতে পাত্রে রাখা পানি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে এডিশ মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জুন মাসের শুরু থেকে পৌরসভার ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডকে ‘হটস্পট’ ঘোষণা করে প্রশাসন। রান্নার কাজে দাউদকান্দি পৌরসভার প্রায় প্রতিটি ঘরে বৃষ্টির পানি প্লাস্টিক বা মাটির পাত্রে জমিয়ে রাখার প্রবণতা রয়েছে। সেসব পাত্রে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে এডিস মশার লার্ভা। এ থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে বাড়ির লোকজন। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, গত ২৬ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৮৯৫ জন। যেখানে পুরো জেলায় সরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা ৩০৪।

পৌর এলাকার সবজিকান্দির বাসিন্দা রোনা আক্তার বলেন, পানির পাত্রে এডিস মশার লার্ভা থাকবে, তা পৌরসভা কিংবা কোনো সংস্থা থেকে জানানো হয়নি।
দাউদকান্দি পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুমন খন্দকার বলেন, পৌরসভার ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডকে হটস্পট ঘোষণা করা হয়েছে। ওই দুটি ওয়ার্ডে পৌর কর্তৃপক্ষ অনেক আগে থেকে পানি সরবরাহ করে। লোকজন উপকারিতা ভেবে বৃষ্টির পানি পাত্রে সংরক্ষণ করছে।
জেলার কীটতত্ত্ববিদ আল ইমরান ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, সবজিকান্দিতে গিয়ে প্রায় সব বাড়িতে বৃষ্টির পানি জমানোর পাত্র দেখেছি। সেগুলোতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ডেঙ্গু সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য বাইরের কিছু নয়, বরং বাড়ির এই পানির পাত্রগুলো দায়ী। আমরা পৌর কর্তৃপক্ষকে সেসব ড্রাম দ্রুত অপসারণের পরামর্শ দিয়েছি। এ কাজ শুরু হয়েছে।
দাউদকান্দি পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেদোয়ান ইসলাম বলেন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার পাত্রে বিপুল পরিমাণ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এটি ঘরে ঘরে ডেঙ্গু ছড়ানোর অন্যতম কারণ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব জমানো পানি ফেলে দিয়ে এসেছি। সবাইকে সচেতন হতে হবে। এসব পানি যতদিন না ফেলা হবে, ততদিন ডেঙ্গু সংক্রমণ কমবে না।
দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ১ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৯৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ৮৫০ জন। গতকাল দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিলেন ১১ জন। গত দুই মাসে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ছয়জন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ