মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহায়তা পৌঁছাতে ‘মানবিক করিডর’ গড়ার যে আলোচনা চলছে, তাতে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তেমন আগ্রহ কিংবা সাড়া নেই। রোহিঙ্গা নেতাদের অভিমত, করিডরের আগে আগে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল (সেফজোন) গড়তে হবে। এ ছাড়া যে করিডরের আলোচনা চলছে, তাতে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, আগে যেমন মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈরী ছিল, তেমনি এখনো সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি তাদের ভূমি থেকে উৎখাত করছে।

গত সোমবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতা, রাখাইন রাজ্য থেকে সদ্য পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা পরিবার, প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

রাখাইনে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গত ২৭ এপ্রিল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো.

তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, মানবিক করিডরের বিষয়ে সরকারের ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ হয়েছে। তাঁর ওই বক্তব্যের সপ্তাহ না পেরোতেই সরকারের ভিন্ন অবস্থানের কথা জানান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। গত রোববার ঢাকার এক সেমিনারে খলিলুর রহমান বলেন, মানবিক করিডর কিংবা অন্য কিছু নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে সরকারের কোনো চুক্তি হয়নি।

করিডর বিষয়ে সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কাছেও কোনো তথ্য নেই। শরণার্থীবিষয়ক কমিশনার ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানবিক করিডর নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চললেও এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে পৃথক পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, করিডর প্রতিষ্ঠা এবং অধিকৃত রাখাইন অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মির প্রশাসনে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি রাখা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ আসছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সম্প্রতি আরাকান আর্মি অধিকৃত অঞ্চলে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের নিয়ে দলগত বৈঠক করছে। তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। উচ্ছেদ করা কিছু মানুষজনকে পুনরায় ঘরবাড়িতে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

করিডর নিয়ে রোহিঙ্গাদের অনীহা

রাখাইনে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠায় রোহিঙ্গা নিজেদের কোনো লাভ দেখছে না। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, এই মুহূর্তে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত চলছে। আর এ কারণে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগ আগের মতোই অব্যাহত আছে। এই অবস্থায় মানবিক করিডর রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো উপকারে আসবে না।

রোহিঙ্গাদের সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটারির সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, টানা ১১ মাসের যুদ্ধের পর গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশ এলাকা (২৭১ কিলোমিটার) নিয়ন্ত্রণে নেয় আরাকান আর্মি। কিন্তু পাঁচ মাসে অধিকৃত অঞ্চলটিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ ঘোষণা দিতে পারছে না তারা। কারণ, সেখানে প্রায় প্রতিদিন আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে। রোহিঙ্গা নিধনও বন্ধ হয়নি। তা ছাড়া অধিকৃত এলাকায় চরম খাদ্য ও ওষুধের সংকট চলছে। মাদক, অস্ত্র চোরাচালান, চুরি-ডাকাতিও বাড়ছে। সবকিছু সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আরাকান আর্মি। এমন পরিস্থিতিতে তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বাইরে রেখে করিডর কোনোভাবে সম্ভব হবে না।

আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ দীর্ঘদিনের দাবি করে রোহিঙ্গা নেতা মো. জোবায়ের বলেন, সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর অধীনে একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যেতে রাজি হবে না। গোষ্ঠীটি টিকে আছে মাদক ও পশু চোরাচালানের টাকায়। করিডর হলে চোরাচালান আরও বাড়বে।

রাখাইন রাজ্যের মৃদু টাউনশিপের দামনখালীর ১৫ হাজার বাসিন্দার চেয়ারম্যান (ওকাট্টা) ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা সিরাজ উল্লাহ। ২০১৭ সালের আগস্টে সামরিক জান্তার নির্যাতনে সপরিবারে পালিয়ে এসে টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন। সোমবার দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জান্তা সরকারকে হটিয়ে মংডু টাউনশিপের পুরোটা আরাকান আর্মি দখল করলেও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। উল্টো দিনদিন পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে। দখলকৃত অঞ্চলটি নিয়ে গোষ্ঠীটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়া চেষ্টা করলেও নানা কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৭ সালে সরকারি বাহিনীর নিপীড়নে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। একইভাবে আরাকান আর্মির অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। ইতিমধ্যে ১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার চেষ্টায় আছেন। সে ক্ষেত্রে করিডর কার জন্য, এ প্রশ্ন রাখেন তিনি।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্যমতে, ১ মে পর্যন্ত গত কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে এসেছেন ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা। উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে আগে থেকে অবস্থান করছেন ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো না গেলে অনুপ্রবেশ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।

কক্সবাজারের উখিয়ার একটি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। সম্প্রতি তোলা

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আর ক ন আর ম র র খ ইন র জ য সশস ত র শরণ র থ সরক র র র জন য অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

১০০ টাকার নতুন নোট বাজারে, আসল-নকল চেনার উপায়

গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর স্বাক্ষরিত নতুন ডিজাইন ও সিরিজের ১০০ টাকা মূল্যমানের ব্যাংক নোট মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) বাজারে ছেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নোটটি প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস থেকে পাওযা যাবে। ধীরে ধীরে অন্যান্য ব্যাংকেও এই নোট পাওয়া যাবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

বিজ্ঞপ্তির ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যকে নতুন ১০০ টাকার নোটে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

আরো পড়ুন:

অর্থঋণ আদালতের মামলার তথ্য বছরে দুই বার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দাখিলের নির্দেশ

রপ্তানিকারকদের জন্য ডলার সংরক্ষণের নিয়ম শিথিল

আসল-নকল নোট যাতে গ্রাহকরা চিনতে পারেন, সেজন্য বিস্তারিত নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নোটটির নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যে বলা হয়েছে, ১০০ টাকার নতুন নোটের আকার ১৪০ মি.মি.x ৬২ মি.মি.। নোটের সম্মুখভাগে বাঁ পাশে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের ছবি ও মাঝখানে ব্যাকগ্রাউন্ডে পাতা ও কলিসহ প্রস্ফুটিত জাতীয় ফুল শাপলার ছবি এবং নোটের পেছন ভাগে সুন্দরবনের ছবি মুদ্রিত আছে। নোটে জলছাপ হিসেবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখ, এর নিচে উজ্জ্বল ইলেক্ট্রোটাইপ জলছাপে ‌100 ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম রয়েছে। নোটটিতে নীল রঙের আধিক্য রয়েছে।

১০০ টাকা মূল্যমানের নোটটিতে মোট ১০ ধরনেরর নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংযোজন করা হয়েছে। নোটের সম্মুখভাগে ডান দিকে কোণায় মুদ্রিত মূল্যমান ‌১০০ রঙ পরিবর্তনশীল উন্নতমানের নিরাপত্তা কালি দ্বারা মুদ্রিত। নোটটি নাড়াচাড়া করলে এর রঙ সোনালি থেকে সবুজ রঙে পরিবর্তিত হয়। নোটটির সম্মুখভাগে বাঁ পাশে ৪ মিলিমিটার চওড়া লাল রঙ এবং উজ্জ্বল রুপালি বার এর সমন্বয়ে পেঁচানো নিরাপত্তা সুতা রয়েছে। নোটটি নাড়াচাড়া করলে নিরাপত্তা সুতার রঙ লাল থেকে সবুজ রঙে পরিবর্তিত হয়, যাতে ‌১০০ টাকা খচিত রয়েছে এবং উজ্জ্বল রংধনুর রঙের বারে রূপান্তরিত হয়ে ওপর থেকে নিচে চলতে দেখা যাবে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য নোটের সম্মুখভাগে ডানে নিচের দিকে তিনটি ছোট বৃত্ত রয়েছে, যা হাতের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হয়।

নোটটিতে ইন্টাগ্লিও কালিতে মুদ্রিত অংশগুলো হাতের স্পর্শে অসমতল অনুভব করা যাবে। ইন্টাগ্লিও কালিতে মুদ্রিত অংশগুলোর মধ্যে রয়েছে, নোটের সম্মুখভাগের ষাট গম্বুজ মসজিদের ছবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রতিশ্রুত বাক্য, বাংলা ও ইংরেজিতে মূল্যমান নোটের ডান দিকে আড়াআড়িভাবে অবস্থিত ছয়টি লাইন এবং নোটের পেছন ভাগে সুন্দরবনের ছবি, সকল মূল্যমান (অঙ্কে ও কথায়), বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম, ‌BANGLADESH BANK ইত্যাদি। 

নোটের সম্মুখভাগে নিরাপত্তা সুতাসংলগ্ন নকশাগুলো বিশেষ কালিতে মুদ্রিত, যা আইআর ডিটেক্টর ম্যাশিনে দৃশ্যমান হবে। নোটের সম্মুখভাগে নিরাপত্তা সুতার বাঁ পাশে ও BANGLADESH BANK লেখাটির নিচে মাইক্রোপ্রিন্ট হিসেবে উলম্বভাবে BANGLADESH BANK 100 Taka বারবার মুদ্রিত রয়েছে। নোটের পেছন ভাগে বাঁ পাশে নিচে ও ডান পাশে উলম্বভাবে ‌BANGLADESH BANK এবং বাঁ পাশে ওপরে 100 Taka মাইক্রোপ্রিন্ট হিসেবে বারবার মুদ্রিত রয়েছে, যা শুধু আতশি কাঁচে দেখা যাবে।

নোটটিতে গভর্নরের স্বাক্ষরের ডান পাশে সি থ্রু ইমেজ হিসেবে ১০০ মুদ্রিত রয়েছে, যা আলোর বিপরীতে ধরলে ‌১০০ লেখা দৃশ্যমান হবে। নোটের সম্মুখভাগে নিচের দিকের বর্ডারের মাঝখানে নীল ডিজাইন অংশে গুপ্তভাবে 100 লেখা আছে, যা নোটটি অনুভূমিকভাবে ধরলে দেখা যাবে। নোটের কাগজে লাল, নীল ও সবুজ রংয়ের অসংখ্য ফাইবার রয়েছে, যা ইউভি ডিটেক্টর ম্যাশিনে দৃশ্যমান হয়। নোটটির উভয় পৃষ্ঠে ইউভি কিউরিং ভার্নিশ সংযোজন করা হয়েছে। এর ফলে নোটটি চকচকে অনুভূত হবে, নোটের স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি পাবে।

নতুন ডিজাইনের ১০০ টাকা মূল্যমানের নোটের পাশাপাশি বর্তমানে প্রচলিত সব কাগুজে নোট এবং ধাতব মুদ্রাও যথারীতি চালু থাকবে। মুদ্রা সংগ্রাহকদের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনা করে নিয়মিত নোটের পাশাপাশি ১০০ টাকা মূল্যমানের নমুনা নোট (যা বিনিময়যোগ্য নয়) মুদ্রণ করা হয়েছে, যা মিরপুরের টাকা জাদুঘর থেকে নির্ধারিত মূল্যে সংগ্রহ করা যাবে।

ঢাকা/নাজমুল/রাসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ