মক্কার পবিত্র ভূমিতে হজের ভিড়। হাজার হাজার মানুষ তাওয়াফ করছেন, তাঁদের কণ্ঠে লাব্বাইকের ধ্বনি। কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে একটি ছোট দল মিনায় জড়ো হয়েছে। তারা শাসকের অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাদের হাতে কোরআন, চোখে ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা। এই দৃশ্য ইসলামের ইতিহাসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের একটি অনন্য রূপ। হজ ও ঈদুল আজহা শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং মুসলিমদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি উত্থাপনের একটি পবিত্র প্ল্যাটফর্ম ছিল তখন। এই প্রবন্ধে আমরা ঈদুল আজহা ও হজের প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, ধর্মীয় আচারের সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে এর বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করব।

হজের প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ

হজ মুসলিমদের জন্য একটি বিশাল সমাবেশ, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ একত্র হয়। এই সমাবেশ শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিযোগ উত্থাপনের একটি মঞ্চ হয়ে উঠেছিল বেশ কয়েকবার।

উমাইয়া যুগে হুসাইন বিন আলী (রা.

) হজের সময় মক্কায় জনগণের সামনে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার (৬৪৭-৬৮৩ খ্রি.) শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি মিনায় একটি সমাবেশে হাজিদের উদ্দেশে বলেন, ‘ইসলামের মূল্যবোধ রক্ষার জন্য আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে।’ এই সমাবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল এবং হজের পবিত্রতা বজায় রেখে পরিচালিত হয়েছিল। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/১৫৪, দামেস্ক: দারুল ফিকর, ১৯৮৮)

এই প্রতিবাদ পরবর্তী সময়ে কারবালার ঘটনার পটভূমি তৈরি করে, কিন্তু হজের সময় এটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল। বলা যায়, হজের সময় মক্কার পবিত্রতা প্রতিবাদকে শান্তিপূর্ণ রাখতে বাধ্য করেছে। উমাইয়া যুগে আবদুল্লাহ বিন উমর (৬১০-৬৯৩ খ্রি.) হজের সময় মক্কায় শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, কিন্তু তিনি স্পষ্টভাবে সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘মক্কার পবিত্রতা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।’ (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা, ৪/২১০, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯৫)

আরও পড়ুনদরুদ কেন পড়ব২৮ এপ্রিল ২০২৫

আব্বাসীয় যুগের আরেকটি উদাহরণ আছে। ২৪৫ হিজরি সনে (৮৫৯-৬০ খ্রি.) মক্কায় হজের সময় জনগণ খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের (৮২২-৮৬১ খ্রি.) অত্যধিক করের বিরুদ্ধে মিনায় সমাবেশ করে। তারা কোরআনের কপি হাতে নিয়ে দোয়া করে এবং খলিফার প্রতিনিধির কাছে অভিযোগপত্র পাঠায়। এই প্রতিবাদের ফলে মক্কার হাজিদের জন্য কর হ্রাস করা হয়। (আল-তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ৯,/৩২৩, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৮৫)

ঈদুল আজহার প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদ

সেকালে ঈদুল আজহার সময় মানুষ সমবেত হতো এবং এই সমাবেশ প্রায়ই সামাজিক ও ধর্মীয় অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগ তৈরি করত।

ফাতেমীয় যুগে ৪০৫ হিজরি সনে (১০১৪-১৫ খ্রি.) মিসরে ঈদুল আজহার সময় জনগণ খলিফা আল-হাকিম বিআমরিল্লাহর (৯৮৫-১০২১ খ্রি.) কিছু ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে মসজিদে সমাবেত হয়। তারা ঈদের নামাজের পর কোরআন হাতে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের অভিযোগ তুলে ধরে। এই প্রতিবাদের ফলে খলিফা তাঁর কিছু বিতর্কিত নীতি সংশোধন করেন। (আল-মাকরিজি, ইত্তিআজুল হুনাফা, ১/১৬৫, কায়রো: দারুল কুতুব, ১৯৭০)

প্রতিবাদের বিবর্তন

মধ্যযুগে প্রতিবাদ প্রধানত মসজিদে সমাবেশ, মিছিল ও প্রতীকী অভিযোগের মাধ্যমে প্রকাশ পেত। আধুনিক যুগে এই প্রতিবাদ আরও সংগঠিত ও বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে। ২০ শতকে মুসলিম বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দেখা যায়। ১৯২০ সালে ভারতের খিলাফত আন্দোলনে মুসলিমরা অটোমান খিলাফতের পতনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির সঙ্গে সমন্বিত হয় এবং মধ্যযুগীয় মুসলিম প্রতিবাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সাদৃশ্য বজায় রাখে। (মিনল্ট, কে., দ্য খিলাফত মুভমেন্ট, পৃ. ৬৭, নিউইয়র্ক: কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮২)

আধুনিক যুগেও হজের সময় প্রতিবাদ হয়েছে। ১৯৮৭ সালে মক্কায় হজের সময় একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হাজিরা রাজনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। যদিও এই সমাবেশ দমন করা হয়। (এস্পোসিটো, জে., দ্য অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইসলাম, পৃ. ৬৫৪, অক্সফোর্ড: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৯)

ইসলামের ইতিহাসে হজ ও ঈদুল আজহা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্য একটি পবিত্র প্ল্যাটফর্ম ছিল। এই প্রতিবাদগুলো ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে মুসলিম সমাজের ঐক্য ও ন্যায়বিচারের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এই ঐতিহ্য আমাদের শেখায়, ধর্মীয় আচার ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।

আল–জাজিরা ডট নেট অবলম্বনে

আরও পড়ুনহজের প্রস্তুতি যেভাবে নিতে হবে২৫ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র জন য হজ র প ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

নার্সদের অমর্যাদাকর অবস্থানে রাখা হয়েছে: ফরহাদ মজহার

বাংলাদেশে জনগণের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করাটা অত্যন্ত জরুরি হলেও এখানে পেশা হিসেবে নার্সদের অমর্যাদাসম্পন্ন একটা অবস্থানে রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার।

ফরহাদ মজহার বলেন, ‘নার্সদের ডাক্তারি ব্যবস্থার অধীন একটা পেশা হিসেবে যে দেখা হয়, আমরা মনে করি এটা ভুল। এখান থেকে মুক্ত হতে হবে। নার্স সেবাটা স্বাস্থ্যসেবার একটা মৌলিক দিক। ফলে তাঁদের স্বাধীনভাবে এই পেশাকে চর্চা করবার সুযোগ–সুবিধা দিতে হবে।’

আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ফরহাদ মজহার। সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ) ও স্বাস্থ্য আন্দোলন। স্বাস্থ্য আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য দেন ফরহাদ মজহার।

সরকার স্বাস্থ্যকে এখন আর জনগণের অধিকার হিসেবে স্বীকার করছে না বলে অভিযোগ করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, ‘এখন স্বাস্থ্যকে অধিকার নয়, বাজারজাত পণ্য বানানো হয়েছে। টাকা থাকলে চিকিৎসা পাবেন, টাকা না থাকলে নয়।’

নার্সদের স্বাধীন পেশাগত চর্চা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, ন্যায্য বেতন ও মর্যাদা নিশ্চিতের জন্য জাতীয় নার্সিং কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, নার্সদেরকে ডাক্তারদের হুকুমমতো চলতে হবে—এই ধারণা ভাঙতে হবে। স্বাস্থ্য মানে শুধু প্রেসক্রিপশন নয়, প্রতিরোধও একটি বড় দিক। নার্সদের মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে জনগণ প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা পাবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরহাদ মজহার বলেন, নার্সিং স্বাস্থ্যসেবার এক মৌলিক দিক। কিন্তু আমাদের সমাজে চিকিৎসাকে ডাক্তারিকরণ বা মেডিক্যালাইজেশন করা হয়েছে। অনেক রোগে ডাক্তার কিংবা ওষুধের প্রয়োজনই হয় না। এ জায়গায় নার্সরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) সভাপতি মো. শরিফুল ইসলাম। এক মাসের মধ্যে নার্সিং কমিশন গঠনের এক দফা দাবি বাস্তবায়ন না হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনের সঞ্চালনা করেন বিএনএর সহসভাপতি মাহমুদ হোসেন তমাল। এতে উপস্থিত ছিলেন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারপারসন জরিনা খাতুন, সহসভাপতি মনির হোসেন ভূঁইয়া এবং সংগঠনের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মী।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংস্কার, বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তরুণ নেতৃত্বের বিকল্প নেই: রাশেদ খান
  • প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য দেশের পরিস্থিতি অস্থির করে তুলছে: ফারুক
  • নার্সদের অমর্যাদাকর অবস্থানে রাখা হয়েছে: ফরহাদ মজহার
  • ১৭ বছর এক অসুর জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছিল: নিপুন রায় 
  • নির্বাচিত সরকার না থাকায় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি: আমীর খসরু
  • অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে: অ্যাটর্নি জেনারেল
  • ড. ইউনূসের নেতৃত্বেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে: অ্যাটর্নি জেনারেল
  • চাঁদপুরে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায় এনসিপির নিন্দা
  • রাষ্ট্র মানে কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক চালানো নয়: ফরহাদ মজহার
  • ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে ভোট