পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে নাখোশ কেন অনেক ভারতীয়
Published: 14th, May 2025 GMT
আয়ুশ তিওয়ারি, নলিনা মিঞ্জ, রকিবুজ জামান ও তাবাসসুম বারনাগারওয়ালা
চার দিন ধরে মাহাতো তাঁর মোবাইল ফোনে চোখ রাখছিলেন। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের চলমান সংঘাতের খবর দেখতে দেখতে রাঁচিতে তাঁর অস্থায়ী চায়ের দোকানে চা বানিয়ে বিক্রি করছিলেন।
৭ মে, যেদিন ভারত পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে কথিত জঙ্গিঘাঁটিতে হামলা চালায়, সেদিন মাহাতো উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তিনি স্ক্রলকে বলেন, ‘সরকার ঠিক কাজটাই করেছে। হামলা চালিয়ে যেতে হবে, যতক্ষণ না সব জঙ্গিকে ধ্বংস করা যায়। ওরা যাতে আর কখনো এ রকম করতে না পারে।’
সীমান্ত থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও ৪৬ বছর বয়সী মাহাতো যুদ্ধের আশঙ্কায় মোটেও ভীত নন। তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো কিছুটা কষ্ট পাব, কিন্তু তার বদলে পাকিস্তান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। অপারেশন সিঁদুরের পর আমি এখন অপারেশন মঙ্গলসূত্রের অপেক্ষায় আছি।’
এই সময় তিনি অপারেশনের সেই কোড নেমের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন, যা কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের স্ত্রীদের সম্মান জানিয়ে রাখা হয়েছিল।
আরও পড়ুনশক্তি দেখাতে গিয়ে ভারতের দুর্বলতা বেরিয়ে এল কি?১৩ মে ২০২৫ভারত সরকার বলেছিল, ২২ এপ্রিল পেহেলগামে যে জঙ্গি হামলা হয়েছিল, সেটির জবাব দিতেই তারা ‘উসকানিহীন প্রতিরোধমূলক’ হামলা চালিয়েছে।
চার দিন ধরে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ১০ মে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
এই খবরে হতাশ হন মাহাতো। রোববার তিনি স্ক্রলকে বলেন, ‘সরকার যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে ভুল করেছে। তাদের উচিত ছিল প্রথম দিনেই যত বেশি সম্ভব পাকিস্তানে বোমাবর্ষণ করা। ওই দিনই আমরা জিতে যেতাম এবং পাকিস্তানকে মুছে দিতে পারতাম।’
অন্যদিকে হরিয়ানার আম্বালায় রিকশাচালক অনিল চাওলা রাগে ফুঁসছিলেন। স্ক্রলকে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক হয়নি। ওই সন্ত্রাসীরা যা করেছে, তার বদলা কি নিয়েছে সরকার? নেওয়া উচিত ছিল। কারণ, বিষয়টা তো এখান থেকেই শুরু।’
তিনি স্বীকার করলেন যে দুই পাশেই মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর মতে, সংঘাত চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। ‘পাকিস্তানকে দুর্বল মন হচ্ছিল। আমাদের উচিত ছিল ওদের কবজা করে ফেলা।’
চাওলা আরও অসন্তুষ্ট ছিলেন এই কারণে যে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, তারাই যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা রাজি হতে পারতাম, যদি আমেরিকা পাকিস্তানকে বলত, তারা যেন ওই সন্ত্রাসীদের ভারতের হাতে তুলে দেয়।’
আসামের জনপ্রিয় গায়ক নীলুৎপল বরা যুদ্ধবিরোধী মত প্রকাশ করায় অনলাইনে ট্রলের শিকার হন। শুক্রবার তিনি ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন ফেসবুকে। পরে তা মুছে ফেলতে বাধ্য হন। তিনি স্ক্রলকে বলেন, ‘কিছু অপরিচিত লোক ফোন করে আমাকে, আমার ছোট সন্তান ও আমার মাকে গালাগাল করে, হুমকি দেয়। আমি শান্তির পক্ষে। কারণ, ইতিহাস বলছে, যুদ্ধ ভয়াবহ।’সীমান্তের কাছাকাছি পাঞ্জাবের ফিরোজপুর শহরে ছিল ভিন্নচিত্র। সেখানে যুদ্ধবিরতির খবরে স্বস্তির ঢেউ বয়ে যায়। মানুষ রাস্তায় এবং পার্কে বেরিয়ে আসেন কিছুটা মুক্ত বাতাস নিতে। কারণ, নিরাপত্তার জন্য তাঁরা কদিন ধরে অন্ধকার ঘরে আটকা পড়েছিলেন।
ফিরোজপুরের এক পার্কে এক বৃদ্ধা বললেন, ‘আমরা পরিবার ও শিশুদের নিয়ে বাইরে এসেছি, ওদের একটু আনন্দ করতে দিচ্ছি। শিশুরা রাতে ঘরে বসে হাঁপিয়ে ওঠে। গত কদিন তাদের অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছিলাম।’
আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি: মোদির ‘অপারেশন সিঁদুর’ কি হিতে বিপরীত হলো১১ মে ২০২৫এক মধ্যবয়সী পুরুষ বললেন, ‘যুদ্ধ শুরুর আগে মনে হচ্ছিল, পেহেলগামে নিহত পর্যটকদের বদলা নিতে হবে। কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতি ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল।’ তিনি আরও বলেন, গোলাবর্ষণ ও ড্রোন হামলায় অন্তত ২১ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে চারটি শিশু রয়েছে। ‘এখন এই যে যুদ্ধবিরতি হলো, এটাই ভালো হয়েছে,’ তিনি বলেন।
দেখা গেছে, অপারেশন সিঁদুর নিয়ে জনগণের উচ্ছ্বাস থাকলেও অনেকে যুদ্ধের ব্যাপক খরচ, বিশেষ করে অর্থনীতির ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ফলে যুদ্ধবিরতির খবর অনেকের কাছেই স্বস্তিদায়ক ছিল।
রাঁচির ব্যবসায়ী জয়দীপ বললেন, ‘যুদ্ধ খুব ব্যয়বহুল ব্যাপার, উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে।’
রাঁচির ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার্থী প্রেমা বললেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, আমাদের সেনাবাহিনী কেবল ওদের সেনাঘাঁটিতেই আঘাত করেছে। কিন্তু পাকিস্তান আমাদের বেসামরিক এলাকায় হামলা চালাচ্ছে। এমনকি যুদ্ধবিরতির পরও তারা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি, এসবের জবাব কঠোরভাবে দেওয়া উচিত, না হলে মনে হবে, আমাদের সেনাবাহিনী কিছু করছে না।’
অনেকের কাছে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় সমস্যা এর মানবিক ক্ষয়ক্ষতি। ‘যুদ্ধ করে আমরা কী পাব?’ প্রশ্ন করলেন আম্বালার দোকানদার গুরজন্ত সিং। ‘শুধুই ক্ষতি। আমাদেরও, তাদেরও।’
গুরজন্ত সিং বললেন, ‘যুদ্ধ ভুল। পেহেলগামের ঘটনাও অবশ্যই ভুল, কিন্তু আমরা প্রতিশোধ নিয়েছি। আমার এক আত্মীয় সেনাবাহিনীতে আছে, যুদ্ধ চললে ক্ষয়ক্ষতি হবেই।’
মুম্বাইয়ের নারকেল বিক্রেতা মোহাম্মদ ইসমাইল বললেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আপসের সিদ্ধান্ত ছিল গত কদিনে শোনা সবচেয়ে ভালো খবর। ‘সন্ত্রাসীরা ধর্মের ভিত্তিতে মানুষ মারছে। আর সরকারি হামলায় বেসামরিক লোক মারা যাচ্ছে। দুই ক্ষেত্রেই নিরীহ মানুষ মরছে,’ বললেন তিনি।
আম্বালার বাসিন্দা নিশা বললেন, ‘গত কদিনে ভারতীয় সেনারা মারা গেছেন। আগামীকাল তো আমাদের পালা আসতে পারে। পাকিস্তানের হয়তো হারানোর কিছু নেই, কিন্তু ভারতের আছে। আমরা কি দেশ গড়ে তুলেছি একদিন নিজেদের ধ্বংস করার জন্য?’
আসামে জন্ম নেওয়া ও মুম্বাইয়ে বসবাসকারী সংগীত পরিচালক জাকির হুসেইন বললেন, ‘যুদ্ধবিরতি সঠিক পদক্ষেপ। এর বেশি কিছু হলে কেবল মানুষের প্রাণহানিই হতো।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল জঙ্গিঘাঁটি। সরকার এখন পর্যন্ত ঠিক করেছে, আমি তাদের সিদ্ধান্তে আস্থা রাখছি।’
আম্বালার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহকর্মী বললেন, ‘যুদ্ধ হলে ক্ষতি হবে আমাদের। ধনীরা লাভ করবে, গরিবরা মরবে। সরকার আপস করে ঠিক কাজ করেছে।’
এই স্বস্তির মধ্যেও অনেকেই ভুয়া খবরের কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। আসামের জনপ্রিয় গায়ক নীলুৎপল বরা যুদ্ধবিরোধী মত প্রকাশ করায় অনলাইনে ট্রলের শিকার হন। শুক্রবার তিনি ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন ফেসবুকে। পরে তা মুছে ফেলতে বাধ্য হন।
তিনি স্ক্রলকে বলেন, ‘কিছু অপরিচিত লোক ফোন করে আমাকে, আমার ছোট সন্তান ও আমার মাকে গালাগাল করে, হুমকি দেয়। আমি শান্তির পক্ষে। কারণ, ইতিহাস বলছে, যুদ্ধ ভয়াবহ।’
ইটানগরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গবেষক আর কালিতা বলেন, তিনি দুই রাত ঘুমাতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘নিরবচ্ছিন্ন খবর আর ভুয়া তথ্যে আমি যেন অন্ধ হয়ে পড়েছিলাম।’
আসামের এক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলশিক্ষিকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সরকার ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিবৃতি এবং টিভি চ্যানেলগুলোর খবরের মধ্যে বিশাল ফারাক ছিল।’
তিনি বলেন, ‘যারা যুদ্ধ চালাচ্ছে, তারাই যদি শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলে, তাহলে জনগণের মনোভাব গত কদিনে এত উগ্র কেন?’
আয়ুশ তিওয়ারি প্রতিবেদক, স্ক্রল
নলিনা মিঞ্জ প্রতিবেদক, স্ক্রল
রকিবুজ জামান প্রতিবেদক, স্ক্রল
তাবাসসুম বারনাগারওয়ালা বিশেষ প্রতিনিধি, স্ক্রল
স্ক্রল থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র আম ব ল বলল ন সরক র র খবর
এছাড়াও পড়ুন:
শেফালি মৃত্যুর ৪ দিন পরে যা বলল তাঁর বান্ধবী
মৃত্যুর পরে চলে গেছে চার দিন। এখনো ‘কাঁটা লাগা গার্ল’ খ্যাত মডেল ও অভিনেত্রী শেফালি জারিওয়ালার মৃত্যুর ময়নাতদন্ত ঘিরে রহস্যের জোট খুলছে না। যদিও সামনে এসেছে প্রাথমিক ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। এর মধ্যেই সামনে এল শেফালির বান্ধবীর বক্তব্য। শুক্রবারে রাতে হাসপাতালে নেওয়াকে কেন্দ্র করে কী কী ঘটেছিল, সেটাই গণমাধ্যমে জানিয়েছেন তিনি।
প্রয়াত অভিনেত্রীর বান্ধবীর নাম পূজা ঘাই। তাঁর সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল। বিবেক ললওয়ানির সঙ্গে শুক্রবারের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন পূজা। ইন্ডিয়া টুডের বরাত দিয়ে জানা যায়, সেই শুক্রবার রাতের ঘটনা নিয়ে কথা বললেও মৃত্যুর কারণ কী হতে পারে সেই বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
মডেল ও অভিনেত্রী শেফালি জারিওয়ালা। ছবি: ইনস্টাগ্রাম