কাবাঘরের চাবি কী দিয়ে তৈরি, কার কাছে থাকে
Published: 15th, May 2025 GMT
পবিত্র কাবাঘরের দরজার চাবি ইসলামপূর্ব যুগ থেকে বংশানুক্রমিকভাবে আল-শাইবা পরিবারের হাতে রক্ষিত আছে। প্রায় ১৬০০ বছর ধরে এই পরিবার কাবাঘরের চাবির রক্ষণাবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে।
চাবির ইতিহাস ও রক্ষক
ইতিহাস অনুযায়ী, কুসাই বিন কিলাবের সময় থেকে আল-শাইবা পরিবার কাবাঘরের চাবির দায়িত্বে রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.
চাবি সব সময় পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষের কাছে থাকে, পিতা থেকে পুত্রের কাছে নয়, বরং বয়সের ভিত্তিতে উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়। একজন রক্ষকের মৃত্যুর পর সৌদি বাদশাহর তত্ত্বাবধানে পরিবারের পরবর্তী বয়স্ক সদস্যকে চাবি হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে চাবির দায়িত্বে রয়েছেন শায়েখ আবদুল ওয়াহাব বিন জাইন আল-আবিদিন আল-শাইবি, যিনি হজরত উসমান (রা.)-এর ১১০তম উত্তরসূরি। এর আগে এই দায়িত্বে ছিলেন ড. শায়েখ সালেহ বিন জয়নুল আবেদিন আল-শাইবি, যিনি ২১ জুন ২০০৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আরও পড়ুনমক্কা থেকে মদিনার পথে পথে দেখা মেলে বাংলাদেশিদের০৬ নভেম্বর ২০০৯চাবির উপাদান
কাবাঘরের বর্তমান তালা ও চাবি ১৮ ক্যারেট সোনার নিকেল দিয়ে তৈরি। তালা ও চাবিতে কোরআনের আয়াত খোদিত রয়েছে। চাবি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত ব্যাগেও কোরআনের আয়াতের নকশা করা থাকে। তুরস্কের জাদুঘরে অটোমান আমলের ৪৮টি চাবি সংরক্ষিত আছে, যা কাবার দরজা খোলার জন্য ব্যবহৃত হতো। সৌদি আরবে এই চাবির যে অনুলিপি আছে, তা খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি।
কাবার দরজা
কাবাঘরে একটি দরজা রয়েছে, যাকে বাবে কাবা বলা হয়। এটি কাবার উত্তর-পূর্ব দেয়ালে মেঝে থেকে ২.১৩ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
১. ১৯৪২ সালে: ইব্রাহিম বদর রুপার দরজা তৈরি করেন।
২. ১৯৭৯ সালে: ইব্রাহিম বদরের ছেলে আহমেদ বিন ইব্রাহিম বদর ৩০০ কেজি সোনা দিয়ে তৈরি বর্তমান দরজা নির্মাণ করেন।
আরও পড়ুনকাবা শরিফের মাতাফে মার্বেল পাথরের অপূর্ব কাহিনি১৮ জুন ২০২৪চাবি ও তালার ব্যবহার
আল-শাইবা পরিবারের প্রধান দায়িত্ব হলো কাবার দরজা খোলা ও বন্ধ করা। বর্তমানে তাঁদের দায়িত্ব এই কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অতীতে তাঁরা কাবার পরিচ্ছন্নতা, মাকামে ইব্রাহিম, কিসওয়ার মেরামত এবং দেয়ালে সুগন্ধি প্রয়োগের দায়িত্বও পালন করতেন।
কাবাঘর প্রতিবছর দুবার পরিষ্কার করা হয়, শাবান মাসের মাঝামাঝি ও জিলকদ মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এ সময় গোলাপজল, জমজমের পানি ও সুগন্ধি দিয়ে কাবা পরিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া মহররম মাসের ১৫ তারিখে সৌদি বাদশাহর নির্দেশে কাবার অভ্যন্তর পানি দিয়ে ধোয়া হয়। সৌদি বাদশাহ, রাজ অতিথি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা জরুরি বাহিনী নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে চাবি ব্যবহার করে দরজা খুলতে পারে।
তালা পরিবর্তন
শেখ আবদুল কাদিরের শাসনকালে শাহ আবদুল্লাহর নির্দেশে কাবার তালা পরিবর্তন করা হয়। প্রিন্স খালিদ আল-ফয়সাল নতুন তালা ও চাবি শেখ আবদুল কাদিরের হাতে তুলে দেন। শেখ আবদুল কাদিরের মৃত্যুর পর ড. সালেহ বিন জয়নুল আবেদিন আল-শাইবি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুনহাজেরা (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর ত্যাগে মক্কার জমজম কূপ১৭ জুন ২০২৪চাবির নিলাম
২০০৮ সালে দ্বাদশ শতাব্দীর একটি কাবার চাবি লন্ডনে নিলামে ১ কোটি ৮১ লাখ ডলারে বিক্রি হয়। এই লোহার চাবি ১৫ ইঞ্চি লম্বা এবং এতে লেখা ছিল, ‘এটি আল্লাহর ঘরের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত।’ এটি একমাত্র চাবি, যা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে কেনা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে কাবার ৫৮টি চাবি সংরক্ষিত আছে।
কাবাঘরের চাবি শুধু একটি বস্তু নয়, বরং ইসলামি ঐতিহ্য ও পবিত্রতার প্রতীক। আল-শাইবা পরিবারের হাতে এই চাবির দায়িত্ব রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় থেকে অব্যাহত আছে, যা মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও ধারাবাহিকতার প্রতিনিধিত্ব করে।
আরও পড়ুনমাকামে ইব্রাহিম: হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দাঁড়ানোর স্থান১৩ জুন ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ব ঘর র চ ব পর ব র র খ আবদ ল ব যবহ র দরজ
এছাড়াও পড়ুন:
বাঙালি মুসলিমদের নিশানা করেই কি আসামে আদিবাসীদের অস্ত্র দিচ্ছে রাজ্য সরকার
ভারতের আসাম রাজ্যের বিজেপি সরকার তীব্র বিতর্ক সত্ত্বেও গতকাল বৃহস্পতিবার আদিবাসীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। ওই দিনই জানানো হয়েছে, অনলাইনে আবেদন করে রাজ্যের ‘অরক্ষিত ও প্রত্যন্ত’ এলাকায় বসবাসকারী ‘মূল নিবাসী উপজাতি গোষ্ঠীর’ মানুষ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবেন।
ভারতের সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ স্থানীয় কয়েকটি সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়, বিজেপিশাসিত রাজ্যের বিজেপিদলীয় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার অতীতের একাধিক ভাষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে ‘অরক্ষিত’ এলাকা বলতে এমন অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে বাঙালি-বংশোদ্ভূত মুসলিমরা বসবাস করেন।
রাজ্যের একাংশের মানুষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে শুক্রবার বলেন, এর ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতে সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিল।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নাগরিকের হাতে অস্ত্র থাকা প্রয়োজন: মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত
অস্ত্র দেওয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বৃহস্পতিবার পোর্টাল চালু করার সময় মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মা বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘যদি আমি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বা আন্তরাষ্ট্রীয় সীমানা অঞ্চলের কাছাকাছি থাকি, অথবা আমি এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাস করি, যেখানে আমার সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা খুবই কম। যদি সেখানে একটি সম্প্রদায়ের হার ৯০-৯৫ শতাংশ হয় এবং অপর সম্প্রদায় ৫ শতাংশ হয়, তবে সেখানে উত্তেজনা থাকবে। ঐতিহাসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক—সব স্তরেই উত্তেজনা থাকবে। একটি ছোট ঘটনা এমন পরিস্থিতিও সৃষ্টি করতে পারে যেখানে ৯৫ শতাংশের সম্প্রদায় ৫ শতাংশকে আক্রমণ করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে পারে।’
আসামের আদিবাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার পক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর আরও যুক্তি, সাধারণভাবে একটি থানায় ৬ থেকে ১২ জন কনস্টেবল থাকেন। কোনো সংঘাত হলে জেলা সদর থেকে অতিরিক্ত বাহিনী পাঠাতে দুই-তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়।
বিজেপির এই উগ্রবাদী মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই দুই-তিন ঘণ্টা আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে হবে। এবং যদি লোকেরা (আক্রমণকারীরা) এটা জানে, আক্রান্ত ব্যক্তি বা আক্রান্ত বাড়িতে একটি আগ্নেয়াস্ত্র আছে, তাহলে এটিই একটি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের ‘প্রথম প্রতিরক্ষক’ বলেও উল্লেখ করেন হিমন্ত।
কারা পেতে পারেন আগ্নেয়াস্ত্র
আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের জন্য ‘সেবা সেতু’ নামে একটি পোর্টালে আবেদন করা যাবে। সেবা সেতু ওয়েবসাইটে এত দিন আসাম সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক পরিষেবার ঘোষণা দেওয়া হতো। সেসবের পাশাপাশি এখন জানানো হয়েছে, কারা আগ্নেয়াস্ত্র পেতে পারেন।
ওয়েবসাইটে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, আবেদনকারীকে আসামের আদিবাসী হতে হবে, তার বয়স কমপক্ষে ২১ হতে হবে এবং ‘অরক্ষিত ও প্রত্যন্ত’ অঞ্চলে বসবাস করতে হবে। আবেদনকারীর অপরাধমূলক কোনো ব্যক্তিগত ইতিহাস থাকা চলবে না এবং তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও থাকা চলবে না।
সেবা সেতু ওয়েবসাইটে শর্তে আরও বলা হয়, আবেদনকারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। ২০১৬ সালের অস্ত্র আইন মোতাবেক উপযুক্ত প্রশিক্ষণও থাকতে হবে।
তবে প্রচারমাধ্যমের বক্তব্য অনুসারে, আসামের মুখ্যমন্ত্রী ‘অরক্ষিত অঞ্চল’ বলতে বাঙালি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলকে বোঝালেও সেবা সেতুতে অরক্ষিত অঞ্চলের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। বন্দুক সংগ্রহ করার আগে আরও একাধিক বিষয়—যেমন কেন তার আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োজন—এ বিষয়ে আবেদনকারীকে লিখিতভাবে তার বক্তব্য রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে।
ভারতের বর্তমান অস্ত্র আইন অনুসারে একজন সাধারণ বেসামরিক নাগরিকের পক্ষে আইনগতভাবে অস্ত্র কেনা বা সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব। আসাম সরকারের এই নতুন নির্দেশনা অস্ত্র সংগ্রহ করাকে অনেক সহজ করে দেবে বলে আসামের সাধারণ মানুষই মনে করছেন।
নাগরিক সমাজের বিরোধিতা
আজ শুক্রবার প্রথম আলোর সঙ্গে এই বিষয়ে আসামের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি আসামে তৈরি হতে চলেছে।’
ওই ব্যবসায়ী বলেন, এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে আসামে এই মুহূর্তে প্রায় ৪০ শতাংশ মুসলিম রয়েছেন, যাঁদের বড় অংশই বাঙালি মুসলমান। আসামে যে জনবিন্যাসের একটা পরিবর্তন হচ্ছে তা–ও অনস্বীকার্য। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, সমাজের একটি বৃহৎ অংশের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়ে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হবে।
আসামের ওই ব্যবসায়ী আরও বলেন, যে রাজ্যে বা দেশে সাধারণ মানুষের হাতে বেশি অস্ত্র থাকে, সেখানে সাধারণভাবেই বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে মাঝেমধ্যেই স্কুল-কলেজে গুলি চলে। আসামে সুকৌশলে পরিস্থিতিকে সেই দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুনআসামে কাদের লক্ষ্য করে আদিবাসী, মূল নিবাসীদের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অনুমতি দিল হিমান্তের সরকার৩০ মে ২০২৫উত্তর-পূর্ব ভারতে একসময় কর্মরত এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার মতে, এর ফলে আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশেও সহিংসতা বাড়বে।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘বন্দুক এমন এক জিনিস, যা এক জায়গায় থেমে থাকে না। একেকটি বন্দুকের বিরাট আয়ু হয়, যত্নে রাখলে একেকটি বন্দুক দীর্ঘদিন কাজ করে। ফলে এই আগ্নেয়াস্ত্র ধীরে ধীরে কালোবাজারে বিক্রি হবে এবং তা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও ঢুকে পড়বে। আসামের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত রয়েছে।’
সাবেক ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারত অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গা, যার সীমান্তের মাত্র ২ শতাংশ রয়েছে ভারতের সঙ্গে। বাকি ৯৮ শতাংশ অন্যান্য দেশের সঙ্গে।
অবসরপ্রাপ্ত ওই পুলিশ কর্তা বলছিলেন, ‘সেসব দেশের সঙ্গে নানা কারণে ভারতের সম্পর্ক বেশ খানিকটা নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, তা ঈশ্বরই জানেন।’
উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের কথায়, এর ফলে শুধু আসামে নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যে সহিংসতা বাড়বে। কারণ, এই বন্দুক সেখানেও পৌঁছবে।
ওই গবেষক বলেন, ‘আমার মনে হয় এই কাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হলো। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হয়তো এভাবে নিজেকে জাতীয় রাজনীতিতে তুলে ধরতে চাইছেন। কারণ, তিনি দেখেছেন, মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক জীবনে চরম উন্নতি করেছেন।’
আরও পড়ুনবাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে হিমন্তের বিতর্কিত মন্তব্য, নিন্দা জানাল বিরোধীরা১৮ মে ২০২৪