ইট–কাঠ–কাচে কৃত্রিম এই রুক্ষ, বিমর্ষ মহানগরীতেও মাঝে মাঝে রঙের ছোঁয়া লাগে। লাবণ্যময় হয়ে ওঠে নগর। যেমনটা হয়েছে এই তপ্ত দিনে।

গ্রীষ্মের দারুণদহন দিন। একেকটি দিনের উত্তাপ নেমেছে আগের দিনের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার প্রতিযোগিতায়। ঘর থেকে বের হলে হাওয়া যেন আগুনের ঝাপটা দেয় গায়েমুখে। কাঠফাটা রোদে ক্লান্ত ক্লিষ্ট নাগরিকের দৃষ্টিতে খানিকটা প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে রক্তিম কৃষ্ণচূড়া, প্রাণপ্রাচুর্যময় হলুদ সোনালু ও কনকচূড়া, স্নিগ্ধ বেগুনি জারুল, শুচিশুভ্র কুর্চি কিংবা কাঠগোলাপের রাশি। বিপুল বর্ণবিভা আর প্রস্ফুটনে শহরকে স্নিগ্ধ সুন্দর করে তুলেছে গ্রীষ্মের ফুলগুলো।

কৃষ্ণচূড়ার বেশি দেখা মেলে জাতীয় সংসদ এলাকায়। ক্রিসেন্ট লেকের পাশের সড়কের দুই পাশ দিয়ে টানা কৃষ্ণচূড়ার সারি। এ ছাড়া চলতি পথে রমনায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বেইলি রোডে, বিক্ষিপ্তভাবে আরও অনেক জায়গায় রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার দিকে না তাকিয়ে পারা যায় না।

ফুলের জন্য খ্যাতি বসন্তের। কবিদের কত কাব্য, কত গান ঋতুরাজের ফুলের বাহার নিয়ে। সে তুলনায় গ্রীষ্মের ফুল সংখ্যায় কম হলেও তার চোখজুড়ানো মনভোলানো অপার সৌন্দর্য যে মোটেই এড়িয়ে যাবার নয়, শহরের পথতরুগুলো এর উজ্জ্বল সাক্ষ্য হয়ে আছে। চলতি পথে নিবিড় সবুজ পাতার ওপরে আগুনরাঙা কৃষ্ণচূড়ার বিপুল বিস্তার, অথবা সরু শাখা থেকে লম্বা পুষ্পদণ্ড বেয়ে নেমে আসা হলুদ সোনালু ফুলগুলো দেখে মনে হয়—যেন এক লম্বা ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে নিসর্গ। প্রাণপ্রাচুর্য আর অপরূপ বর্ণালিতে শহরকে রাঙিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি।

কৃষ্ণচূড়ার বেশি দেখা মেলে জাতীয় সংসদ এলাকায়। ক্রিসেন্ট লেকের পাশের সড়কের দুই পাশ দিয়ে টানা কৃষ্ণচূড়ার সারি। এ ছাড়া চলতি পথে রমনায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বেইলি রোডে, বিক্ষিপ্তভাবে আরও অনেক জায়গায় রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার দিকে না তাকিয়ে পারা যায় না।

কৃষ্ণচূড়া আমাদের অনেক চেনা ফুল। একে ‘গুলমোহর’ও বলে। তবে আমাদের কাছে কৃষ্ণচূড়া নামটিই প্রিয়। অবশ্য এই নাম কে দিয়েছিল তা অজানা।

কৃষ্ণচূড়ার আরও এক দীর্ঘ নান্দনিক বীথি ছিল ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে সড়ক বিভাজকের এমাথা–ওমাথাজুড়ে। সাবেক নগরপিতা মহাশয় জনগণের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে তা সমূলে উৎপাটিত করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ফলে এই পথটি থেকে কৃষ্ণচূড়ার চোখজুড়ানো শোভা হারিয়ে গেছে।

কৃষ্ণচূড়া আমাদের অনেক চেনা ফুল। একে ‘গুলমোহর’ও বলে। তবে আমাদের কাছে কৃষ্ণচূড়া নামটিই প্রিয়। অবশ্য এই নাম কে দিয়েছিল তা অজানা। উদ্ভিদবিদেরা বলেন, কৃষ্ণচূড়ার জন্মভূমি মাদাগাস্কার অঞ্চলে। অনেক বড় পাতাঝরা গাছ। শীতে সব পাতা ঝরিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। গ্রীষ্মের শুরু থেকে তার বিপুল প্রস্ফুটন। প্রথমে শাখাগুলো ভরে ওঠে অজস্র আগুনরাঙা ফুলে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের পাপড়ি চারটি। ঝরে পড়া পুরোনো পাপড়িগুলো গাছতলাকেও করে তোলে নান্দনিক। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুনের শেষ নাগাদ কৃষ্ণচূড়া ফোটে।

কৃষ্ণচূড়ার সমগোত্রীয় ফুল কনকচূড়া। ফুল কাঁচা হলুদ রঙের। জাতীয় সংসদের পূর্ব পাশের সড়ক ধরে সোজা মিরপুরের দিকে রোকেয়া সরণিজুড়ে প্রচুর কনকচূড়ার সমারোহ। ‘কনকচূড়া’ নাম রেখেছিলেন নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা। সবুজ পাতার সমারোহে থোকা থোকা হলুদ ফুল স্বর্ণপ্রভার মতোই সমুজ্জ্বল। কনকচূড়ার বেশ কিছু সমাবেশ আছে মিন্টো রোড ও পাশের এলিফ্যান্ট রোড, রমনা, কার্জন হল এসব এলাকায়। কৃষ্ণচূড়া আর কনকচূড়াকে দেখে মনে হয়ে প্রকৃতই যেন ঘুম ভেঙে জেগেছে প্রকৃতি।

গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন বিকেলে স্ত্রী শাহানা পারভিন আর দুই ছেলে আরিফুজ্জামান ও হাসানুজ্জামানকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন খায়রুজ্জামান সোহাগ। মোহাম্মাদপুরের বাবর রেডের বাসিন্দা তাঁরা। খায়রুজ্জামান একটি বেসরকারি ব্যাংকের চাকুরে। বললেন, ঢাকায় বেড়ানোর মতো খোলামেলা জায়গা বিশেষ নেই। জাতীয় সংসদ এলাকার এই স্থানটি তাদের বেশ পছন্দ। বিশেষ করে এই গ্রীষ্মের সময় কৃষ্ণচূড়া ও কণকচূড়ার ফুলের সমাহার খুবই মনোমুগ্ধকর। বেশ ভালো লাগে এখানে এলে।

গ্রীষ্মের শুরুতে পাতাবিহীন সোনালুর শাখা থেকে নেমে আসে ঝুলন্ত পুষ্পদণ্ড। চারপাশ দিয়ে ফুটতে থাকে পাঁচ পাপড়ির ফুলগুলো। সৌরভ আছে হালকা। দিনে দিনে সবুজ পাতার উদ্‌গম হতে থাকে সরু শাখায় শাখায়।

হলুদ ফুলের কথা এলে সোনালুকে ভোলা যায় না। শীতে এ গাছের পাতা ঝরে দীনহীন ভিখারির দশা হয়। হিমালয় এলাকায় জন্ম হলেও আমাদের নিজস্ব উদ্ভিদ হিসেবে এর পরিচিত আছে। মাঝারি উচ্চতার গাছ। গ্রীষ্মের শুরুতে সোনালুর শাখা ভরে ওঠে কাঁচা হলুদ ফুলে ফুলে। একবার চোখ পড়লে, তা কোনো দিন ভুলবার নয়। লাঠির মতো লম্বা ফলের জন্য লোকে একে ‘বানরলাঠি’ও বলে থাকেন। সংস্কৃতে এর আরও অনেক নাম আছে, আছে বৈজ্ঞানিক নাম। রয়েছে ঔষধি গুণ। সে কথা থাক। গণমানুষের কাছে সোনালুর সৌন্দর্যই হলো নগদ প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তি মিলবে বিক্ষিপ্তভাবে শহরের অনেক স্থানে। কার্জন হল, ধানমন্ডি, জাতীয় জাদুঘর চত্বর, রমনা, কাকরাইল, ওসমানী উদ্যান ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়।

গ্রীষ্মের শুরুতে পাতাবিহীন সোনালুর শাখা থেকে নেমে আসে ঝুলন্ত পুষ্পদণ্ড। চারপাশ দিয়ে ফুটতে থাকে পাঁচ পাপড়ির ফুলগুলো। সৌরভ আছে হালকা। দিনে দিনে সবুজ পাতার উদ্‌গম হতে থাকে সরু শাখায় শাখায়। ফিকে সবুজে কাঁচা হলুদে রচিত হয় চমৎকার বর্ণসুষমা। মৃদুমন্দ হাওয়ায় যখন এর ঝুলন্ত ফুলগুলো দুলে ওঠে, সেই দৃশ্য হৃদয়ের ব্যথাবেদনা উপশম করার মতো প্রশান্তি দিয়ে যায়।

রাজধানীতে জারুল প্রধানত সুশোভন করে তোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। জারুলও ফোটে এপ্রিল থেকে জুনে। নগরবাসীর কাছে এটিও খুব চেনা ফুল। যদিও আদি নিবাস শ্রীলঙ্কায়। সবুজ পাতার সঙ্গে কোমল নমনীয় বেগুনি ফুলের গুচ্ছ রৌদ্রতপ্ত দিনে দৃষ্টি স্নিগ্ধ করে দেয়।

জারুল ফুলে পাপড়ি থাকে ছয়টি। ফোটার প্রথম দিকে ফুল থাকে গাঢ় বেগুনি। পরে রং একটু ফিকে হয়ে আসে। ফুলে গন্ধ নেই। সবার সবকিছু থাকেও না। জারুলের বেগুনি ব্যঞ্জনার যে অপার সৌন্দর্য, তা দিয়েই সে মানুষের হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে এক অনন্য ভালো লাগার আবেশ। মন ভালো হয়ে যায় রোদে তপ্ত বা বৃষ্টিভেজা সতেজ জারুল ফুলের দিকে তাকালে।

কুর্চি বেশ দুর্লভ রাজধানীতে। অথচ এই গাছটি নগরীর সড়কগুলো ভরিয়ে দিতে পারত শুভ্র ফুলে ফুলে। বহু সড়কই তো খাঁ খাঁ ছায়াহীন, সৌন্দর্যহীন পড়ে আছে! কুর্চি ছোট আকারের ফুল। পাঁচটি করে পাপড়ি। দেখতে অনেকটা রঙ্গনের মতো। কুর্চি মধুর গন্ধ বিলিয়ে দেয় তপ্ত বাতাসে। ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব গাছ। এরও অনেকগুলো নাম আছে বাংলা ও সংস্কৃতে। আকার মাঝারি। কুর্চিরও সব পাতা ঝরে যায় শীতে। গ্রীষ্মের শুরুতে শাখাগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠলে পুরো গাছটিকেই সুসজ্জিত ফুলের তোড়ার মতো দেখায়। সাদা রঙে থাকে পবিত্রতার অনুভূতি।

কুর্চির কয়েকটি গাছ আছে রমনায়, নিমতলী এলাকায় এশিয়াটিক সোসাইটির আশপাশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল চত্বরের দুটি গাছ এখনো ফুলে ফুলে ভরা। বিক্ষিপ্তভাবে ওসমানী উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে একটি–দুটি গাছ অনুসন্ধানী চোখে পড়তে পারে।

গ্রীষ্মের আরেকটি প্রধান দৃষ্টিনন্দন ফুল কাঠগোলাপ বা গুলাচি। বর্ষায়ও এর কিছু প্রস্ফুটন থাকে। সাদা, গোলাপি, সাদার সঙ্গে হলুদ আভা, এমন অনেক রঙেই কাঠগোলাপগুচ্ছ গরমে জ্বালা ধরা চোখে প্রশান্তি এনে দেয়। এর লম্বা গাঢ় সবুজ পাতা এবং গাছের গড়নও নান্দনিক। গাছতলা বেশ ছায়াময়।

কাঠগোলাপের আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকায়। ঘন সন্নিবেশিত সবুজ পাতার ওপর ফুলগুলো স্তবকের মতো সাজানো থাকে। ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে, বা বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনের কাঠগোলাপের শোভা অনেকেরই মনে ছবির মতো হয়ে থাকবে। বাগানের গাছ হিসেবেও কাঠগোলাপ আগারগাঁও শেরেবাংলা নগরের ভবনের সামনে চোখে পড়ে। অনেকে পাঁচ পাপড়ির কাঠগোলাপ ফুলকে প্রেমের প্রতীক হিসেবে মনে করে থাকেন।

ফুলে ফুলে এমন সুশোভন হতে পারত নগরীর অধিকাংশ সড়ক। থাকতে পারত যথেষ্ট উন্মুক্ত পরিসর। সবুজ স্নিগ্ধ নিসর্গ। কিন্তু প্রশ্নের মুখে পড়া উন্নয়ন প্রকল্পের খড়্গহস্ত আর বহুবিধ নির্মাণে মহানগরীতে বিপন্ন প্রকৃতি। পরের প্রজন্মের কথা ভুলে তাৎক্ষণিক লাভ, লোভের অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ, আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা ক্রমাগত বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে এ শহরকে। তবু এর মধ্যেই ক্ষীণ হয়ে আসা নিসর্গ তার যতটুক সামর্থ্য, তা উজাড় করে দেয়। বসন্তে নবীন পাতায় পাতায় সজীব করে তোলে শহর। তপ্ত গ্রীষ্মে রাঙিয়ে দেয় কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়া, জারুল, সোনালু, কুর্চি আর কাঠগোলাপেরা। যেন তারা নিঃশব্দে বলে যায় ভুলে যাওয়া সেই কথাটি ‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না, পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও’।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সব জ প ত র প রস ফ ট স ন দর য কনকচ ড় এল ক য় আম দ র প রক ত র জন য র সড়ক

এছাড়াও পড়ুন:

রুক্ষ রাজধানী রাঙিয়ে দিচ্ছে কৃষ্ণচূড়া, জারুল, সোনালু

ইট–কাঠ–কাচে কৃত্রিম এই রুক্ষ, বিমর্ষ মহানগরীতেও মাঝে মাঝে রঙের ছোঁয়া লাগে। লাবণ্যময় হয়ে ওঠে নগর। যেমনটা হয়েছে এই তপ্ত দিনে।

গ্রীষ্মের দারুণদহন দিন। একেকটি দিনের উত্তাপ নেমেছে আগের দিনের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার প্রতিযোগিতায়। ঘর থেকে বের হলে হাওয়া যেন আগুনের ঝাপটা দেয় গায়েমুখে। কাঠফাটা রোদে ক্লান্ত ক্লিষ্ট নাগরিকের দৃষ্টিতে খানিকটা প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে রক্তিম কৃষ্ণচূড়া, প্রাণপ্রাচুর্যময় হলুদ সোনালু ও কনকচূড়া, স্নিগ্ধ বেগুনি জারুল, শুচিশুভ্র কুর্চি কিংবা কাঠগোলাপের রাশি। বিপুল বর্ণবিভা আর প্রস্ফুটনে শহরকে স্নিগ্ধ সুন্দর করে তুলেছে গ্রীষ্মের ফুলগুলো।

কৃষ্ণচূড়ার বেশি দেখা মেলে জাতীয় সংসদ এলাকায়। ক্রিসেন্ট লেকের পাশের সড়কের দুই পাশ দিয়ে টানা কৃষ্ণচূড়ার সারি। এ ছাড়া চলতি পথে রমনায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বেইলি রোডে, বিক্ষিপ্তভাবে আরও অনেক জায়গায় রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার দিকে না তাকিয়ে পারা যায় না।

ফুলের জন্য খ্যাতি বসন্তের। কবিদের কত কাব্য, কত গান ঋতুরাজের ফুলের বাহার নিয়ে। সে তুলনায় গ্রীষ্মের ফুল সংখ্যায় কম হলেও তার চোখজুড়ানো মনভোলানো অপার সৌন্দর্য যে মোটেই এড়িয়ে যাবার নয়, শহরের পথতরুগুলো এর উজ্জ্বল সাক্ষ্য হয়ে আছে। চলতি পথে নিবিড় সবুজ পাতার ওপরে আগুনরাঙা কৃষ্ণচূড়ার বিপুল বিস্তার, অথবা সরু শাখা থেকে লম্বা পুষ্পদণ্ড বেয়ে নেমে আসা হলুদ সোনালু ফুলগুলো দেখে মনে হয়—যেন এক লম্বা ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে নিসর্গ। প্রাণপ্রাচুর্য আর অপরূপ বর্ণালিতে শহরকে রাঙিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি।

কৃষ্ণচূড়ার বেশি দেখা মেলে জাতীয় সংসদ এলাকায়। ক্রিসেন্ট লেকের পাশের সড়কের দুই পাশ দিয়ে টানা কৃষ্ণচূড়ার সারি। এ ছাড়া চলতি পথে রমনায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বেইলি রোডে, বিক্ষিপ্তভাবে আরও অনেক জায়গায় রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার দিকে না তাকিয়ে পারা যায় না।

কৃষ্ণচূড়া আমাদের অনেক চেনা ফুল। একে ‘গুলমোহর’ও বলে। তবে আমাদের কাছে কৃষ্ণচূড়া নামটিই প্রিয়। অবশ্য এই নাম কে দিয়েছিল তা অজানা।

কৃষ্ণচূড়ার আরও এক দীর্ঘ নান্দনিক বীথি ছিল ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে সড়ক বিভাজকের এমাথা–ওমাথাজুড়ে। সাবেক নগরপিতা মহাশয় জনগণের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে তা সমূলে উৎপাটিত করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ফলে এই পথটি থেকে কৃষ্ণচূড়ার চোখজুড়ানো শোভা হারিয়ে গেছে।

কৃষ্ণচূড়া আমাদের অনেক চেনা ফুল। একে ‘গুলমোহর’ও বলে। তবে আমাদের কাছে কৃষ্ণচূড়া নামটিই প্রিয়। অবশ্য এই নাম কে দিয়েছিল তা অজানা। উদ্ভিদবিদেরা বলেন, কৃষ্ণচূড়ার জন্মভূমি মাদাগাস্কার অঞ্চলে। অনেক বড় পাতাঝরা গাছ। শীতে সব পাতা ঝরিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। গ্রীষ্মের শুরু থেকে তার বিপুল প্রস্ফুটন। প্রথমে শাখাগুলো ভরে ওঠে অজস্র আগুনরাঙা ফুলে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের পাপড়ি চারটি। ঝরে পড়া পুরোনো পাপড়িগুলো গাছতলাকেও করে তোলে নান্দনিক। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুনের শেষ নাগাদ কৃষ্ণচূড়া ফোটে।

কৃষ্ণচূড়ার সমগোত্রীয় ফুল কনকচূড়া। ফুল কাঁচা হলুদ রঙের। জাতীয় সংসদের পূর্ব পাশের সড়ক ধরে সোজা মিরপুরের দিকে রোকেয়া সরণিজুড়ে প্রচুর কনকচূড়ার সমারোহ। ‘কনকচূড়া’ নাম রেখেছিলেন নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা। সবুজ পাতার সমারোহে থোকা থোকা হলুদ ফুল স্বর্ণপ্রভার মতোই সমুজ্জ্বল। কনকচূড়ার বেশ কিছু সমাবেশ আছে মিন্টো রোড ও পাশের এলিফ্যান্ট রোড, রমনা, কার্জন হল এসব এলাকায়। কৃষ্ণচূড়া আর কনকচূড়াকে দেখে মনে হয়ে প্রকৃতই যেন ঘুম ভেঙে জেগেছে প্রকৃতি।

গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন বিকেলে স্ত্রী শাহানা পারভিন আর দুই ছেলে আরিফুজ্জামান ও হাসানুজ্জামানকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন খায়রুজ্জামান সোহাগ। মোহাম্মাদপুরের বাবর রেডের বাসিন্দা তাঁরা। খায়রুজ্জামান একটি বেসরকারি ব্যাংকের চাকুরে। বললেন, ঢাকায় বেড়ানোর মতো খোলামেলা জায়গা বিশেষ নেই। জাতীয় সংসদ এলাকার এই স্থানটি তাদের বেশ পছন্দ। বিশেষ করে এই গ্রীষ্মের সময় কৃষ্ণচূড়া ও কণকচূড়ার ফুলের সমাহার খুবই মনোমুগ্ধকর। বেশ ভালো লাগে এখানে এলে।

গ্রীষ্মের শুরুতে পাতাবিহীন সোনালুর শাখা থেকে নেমে আসে ঝুলন্ত পুষ্পদণ্ড। চারপাশ দিয়ে ফুটতে থাকে পাঁচ পাপড়ির ফুলগুলো। সৌরভ আছে হালকা। দিনে দিনে সবুজ পাতার উদ্‌গম হতে থাকে সরু শাখায় শাখায়।

হলুদ ফুলের কথা এলে সোনালুকে ভোলা যায় না। শীতে এ গাছের পাতা ঝরে দীনহীন ভিখারির দশা হয়। হিমালয় এলাকায় জন্ম হলেও আমাদের নিজস্ব উদ্ভিদ হিসেবে এর পরিচিত আছে। মাঝারি উচ্চতার গাছ। গ্রীষ্মের শুরুতে সোনালুর শাখা ভরে ওঠে কাঁচা হলুদ ফুলে ফুলে। একবার চোখ পড়লে, তা কোনো দিন ভুলবার নয়। লাঠির মতো লম্বা ফলের জন্য লোকে একে ‘বানরলাঠি’ও বলে থাকেন। সংস্কৃতে এর আরও অনেক নাম আছে, আছে বৈজ্ঞানিক নাম। রয়েছে ঔষধি গুণ। সে কথা থাক। গণমানুষের কাছে সোনালুর সৌন্দর্যই হলো নগদ প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তি মিলবে বিক্ষিপ্তভাবে শহরের অনেক স্থানে। কার্জন হল, ধানমন্ডি, জাতীয় জাদুঘর চত্বর, রমনা, কাকরাইল, ওসমানী উদ্যান ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়।

গ্রীষ্মের শুরুতে পাতাবিহীন সোনালুর শাখা থেকে নেমে আসে ঝুলন্ত পুষ্পদণ্ড। চারপাশ দিয়ে ফুটতে থাকে পাঁচ পাপড়ির ফুলগুলো। সৌরভ আছে হালকা। দিনে দিনে সবুজ পাতার উদ্‌গম হতে থাকে সরু শাখায় শাখায়। ফিকে সবুজে কাঁচা হলুদে রচিত হয় চমৎকার বর্ণসুষমা। মৃদুমন্দ হাওয়ায় যখন এর ঝুলন্ত ফুলগুলো দুলে ওঠে, সেই দৃশ্য হৃদয়ের ব্যথাবেদনা উপশম করার মতো প্রশান্তি দিয়ে যায়।

রাজধানীতে জারুল প্রধানত সুশোভন করে তোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। জারুলও ফোটে এপ্রিল থেকে জুনে। নগরবাসীর কাছে এটিও খুব চেনা ফুল। যদিও আদি নিবাস শ্রীলঙ্কায়। সবুজ পাতার সঙ্গে কোমল নমনীয় বেগুনি ফুলের গুচ্ছ রৌদ্রতপ্ত দিনে দৃষ্টি স্নিগ্ধ করে দেয়।

জারুল ফুলে পাপড়ি থাকে ছয়টি। ফোটার প্রথম দিকে ফুল থাকে গাঢ় বেগুনি। পরে রং একটু ফিকে হয়ে আসে। ফুলে গন্ধ নেই। সবার সবকিছু থাকেও না। জারুলের বেগুনি ব্যঞ্জনার যে অপার সৌন্দর্য, তা দিয়েই সে মানুষের হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে এক অনন্য ভালো লাগার আবেশ। মন ভালো হয়ে যায় রোদে তপ্ত বা বৃষ্টিভেজা সতেজ জারুল ফুলের দিকে তাকালে।

কুর্চি বেশ দুর্লভ রাজধানীতে। অথচ এই গাছটি নগরীর সড়কগুলো ভরিয়ে দিতে পারত শুভ্র ফুলে ফুলে। বহু সড়কই তো খাঁ খাঁ ছায়াহীন, সৌন্দর্যহীন পড়ে আছে! কুর্চি ছোট আকারের ফুল। পাঁচটি করে পাপড়ি। দেখতে অনেকটা রঙ্গনের মতো। কুর্চি মধুর গন্ধ বিলিয়ে দেয় তপ্ত বাতাসে। ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব গাছ। এরও অনেকগুলো নাম আছে বাংলা ও সংস্কৃতে। আকার মাঝারি। কুর্চিরও সব পাতা ঝরে যায় শীতে। গ্রীষ্মের শুরুতে শাখাগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠলে পুরো গাছটিকেই সুসজ্জিত ফুলের তোড়ার মতো দেখায়। সাদা রঙে থাকে পবিত্রতার অনুভূতি।

কুর্চির কয়েকটি গাছ আছে রমনায়, নিমতলী এলাকায় এশিয়াটিক সোসাইটির আশপাশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল চত্বরের দুটি গাছ এখনো ফুলে ফুলে ভরা। বিক্ষিপ্তভাবে ওসমানী উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে একটি–দুটি গাছ অনুসন্ধানী চোখে পড়তে পারে।

গ্রীষ্মের আরেকটি প্রধান দৃষ্টিনন্দন ফুল কাঠগোলাপ বা গুলাচি। বর্ষায়ও এর কিছু প্রস্ফুটন থাকে। সাদা, গোলাপি, সাদার সঙ্গে হলুদ আভা, এমন অনেক রঙেই কাঠগোলাপগুচ্ছ গরমে জ্বালা ধরা চোখে প্রশান্তি এনে দেয়। এর লম্বা গাঢ় সবুজ পাতা এবং গাছের গড়নও নান্দনিক। গাছতলা বেশ ছায়াময়।

কাঠগোলাপের আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকায়। ঘন সন্নিবেশিত সবুজ পাতার ওপর ফুলগুলো স্তবকের মতো সাজানো থাকে। ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে, বা বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনের কাঠগোলাপের শোভা অনেকেরই মনে ছবির মতো হয়ে থাকবে। বাগানের গাছ হিসেবেও কাঠগোলাপ আগারগাঁও শেরেবাংলা নগরের ভবনের সামনে চোখে পড়ে। অনেকে পাঁচ পাপড়ির কাঠগোলাপ ফুলকে প্রেমের প্রতীক হিসেবে মনে করে থাকেন।

ফুলে ফুলে এমন সুশোভন হতে পারত নগরীর অধিকাংশ সড়ক। থাকতে পারত যথেষ্ট উন্মুক্ত পরিসর। সবুজ স্নিগ্ধ নিসর্গ। কিন্তু প্রশ্নের মুখে পড়া উন্নয়ন প্রকল্পের খড়্গহস্ত আর বহুবিধ নির্মাণে মহানগরীতে বিপন্ন প্রকৃতি। পরের প্রজন্মের কথা ভুলে তাৎক্ষণিক লাভ, লোভের অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ, আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা ক্রমাগত বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে এ শহরকে। তবু এর মধ্যেই ক্ষীণ হয়ে আসা নিসর্গ তার যতটুক সামর্থ্য, তা উজাড় করে দেয়। বসন্তে নবীন পাতায় পাতায় সজীব করে তোলে শহর। তপ্ত গ্রীষ্মে রাঙিয়ে দেয় কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়া, জারুল, সোনালু, কুর্চি আর কাঠগোলাপেরা। যেন তারা নিঃশব্দে বলে যায় ভুলে যাওয়া সেই কথাটি ‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না, পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও’।

সম্পর্কিত নিবন্ধ