আলোর একটি বিন্দু পায়ের কাছে এসে লুটোপুটি খেলে আমাদের মনে পড়ল হেকিমের উপদেশ: ‘আলো কখনো কখনো আলেয়া হয়ে তোমাদের প্রবঞ্চনা দিতে পারে। খবরদার, আলেয়ার খপ্পরে পড়বে না।’
কাফেলায় আমরা যারা আছি, সবার গন্তব্য এক, মনজিল অভিন্ন। আমাদের লোকালয়ে ফিরতে হবে, সন্ধ্যা নামার আগেই। যদিও হেকিম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে যত দ্রুতই আমরা পথ চলি না কেন, জঙ্গলের মাঝখানে কাকের পালকের মতো গহিন রাত্রি নামবে। তবু নিয়তি রেখা বদলাতে আমাদের শেষ চেষ্টা করে যেতে হবে। কারণ, লোকালয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আমাদের বাবা–মায়েরা। ইউসুফ নবীর জন্য তাঁর বাবার যে কাতর অপেক্ষা ছিল, আমাদের মা–বাবাও একই রকম কাতরতা নিয়ে অপেক্ষা করছে নিজ নিজ বাড়িতে। তারা শুধু অপেক্ষায়ই কাতর নয়, তারা কাতর অসুস্থতায়ও। কেউ জন্ডিস, কেউ প্লেগ, কেউ যক্ষ্মার শিকার। কেউ কেউ বা আমাশয়, কলেরা, কুষ্ঠর মতো প্রাণঘাতী রোগে বিপর্যস্ত। তারা আমাদের এবং আমাদের সংগৃহীত পথ্যের জন্য অপেক্ষমাণ।
মাসখানেক আগে অদ্ভুত এক দুর্যোগ নেমেছিল আমাদের জনপদে। এক আশ্চর্য ভোরে; আমরা তখনো আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠিনি, সাদা ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় আমাদের উঠোন, বারান্দা, ঘরের দুয়ার, এমনকি বিছানার বালিশ। এই ঘটনা তাদের বাড়িতেই ঘটে, যাদের বাড়িতে প্রৌঢ়ত্ব পেরোনো মা–বাবা আছে। সেই অলৌকিক ধোঁয়ায় খুকখুক করে কাশতে শুরু করে আমাদের বাবা–মায়েরা। শুরুতে আমরা কাশিকে নয়, গুরুত্ব দিই ধোঁয়াকে। কোথা থেকে এল এই ধোঁয়া, তার উদ্দেশ্য কী, তার শেষ গন্তব্যই বা কোথায়! জমাটবাঁধা এই সব জিজ্ঞাসার কোনো কূলকিনারা আমরা পাই না। পাই শুধু রোগ। বাবা–মায়েদের। কুষ্ঠ, কলেরা, আমাশয়, যক্ষ্মা, জন্ডিস। রোগগুলো যে এই ধোঁয়ারই সৃষ্টি, বুঝতে বাকি থাকে না আমাদের। অচিরেই মা–বাবাকে সুস্থ করে তোলার এক ঐশ্বরিক দায়িত্ব আমাদের কাঁধে এসে পড়ে। হেকিমের খোঁজে আমরা এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করি। কত রকম পথ্য যে তাদের খাওয়াই, কত রকম টোটকার ব্যবহার যে করি, কত রকম গাছগাছড়া যে তাদের গায়ে বাঁধি, হিসাব নেই। কিন্তু তারা সুস্থ হয় না। প্রতিদিনই তারা আগের দিনের চেয়ে একটু একটু করে ক্ষয় হতে থাকে। আমাদের প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কোনো পরোয়াই করে না ব্যাধি। হতাশা যখন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে, যখন আমরা জন্মদাতা পিতা ও জন্মদাত্রী মাতার কবর খননের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি, তখনই খোঁজ পাই এক আশ্চর্য হেকিমের, যার কোনো পথ্যই নাকি ব্যর্থ হয় না। দক্ষিণের জঙ্গলের ওপারে তার আশ্রম। আমরা সবাই, যাদের মা–বাবারা মুমূর্ষু, জঙ্গল পাড়ি দিয়ে নতুন আবিষ্কৃত এই হেকিমের আশ্রমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেদিন সকালেই, মা-বাবার দোয়া নিয়ে, কয়েক দিনের খাবার বেঁধে, আমরা রওনা দিই আশ্রমের উদ্দেশে। এক দিনের পথ যখন আমরা আধা দিনে শেষ করি, ক্লান্ত হওয়ার বদলে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠি। কারণ আর কিছু নয়—হেকিম। হেকিমের এমন সৌম্য-কান্তি মুখ, এমন হৃদয়ভেদী পরিষ্কার দৃষ্টি, এমন স্নিগ্ধ ব্যবহার, আমরা মোহিত হয়ে পড়ি। অপার্থিব এক শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায় আমাদের কাঁধ। হেকিম যেন সব জানতেন, যেন আমাদের জন্যই তিনি অপেক্ষা করছিলেন, এমনই শান্ত তাঁর অভিব্যক্তি। আমরা বিগলিত হই। তাঁর দাওয়াখানা দেখে আমরা হতবাকও হই। সারাটা দিন তিনি হামানদিস্তায় শিকড় বেটে পথ্য প্রস্তুত করেন। আমরা দক্ষিণা দিতে যাই। কিন্তু তিনি গ্রহণ করেন না। তিনি বরং গম্ভীর গলায় বলেন, ‘তোমরা প্রভুর পরীক্ষায় পড়েছ। তোমাদের থেকে দক্ষিণা নেব না।’
‘প্রভুর পরীক্ষা!’ আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। এক আশ্চর্য সকালের অলৌকিক ধোঁয়ায় আমাদের বাবা–মায়েরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এ বুঝি প্রভুর পরীক্ষা! ‘ভালো হবে তো আমাদের বাবা–মায়েরা?’ সকাতর জিজ্ঞাসা করি আমরা।
রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে হেকিমের ঠোঁটে। বলেন, পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবে, কেবল তারাই সুস্থ মা–বাবা ফিরে পাবে। অন্যরা নয়।
হেকিমের কথায় ক্ষণিকের জন্য আমাদের গা ছমছম করে। আমরা উত্তীর্ণ হতে পারব তো প্রভুর পরীক্ষায়! আমরা হেকিমের কাছে দোয়া চাই। এরপর যে যার পথ্য থলেতে ভরে দিনের পড়ন্ত বেলার রোদ পিঠে নিয়ে আমরা ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিই। যাওয়ার সময় হেকিম শেষ উপদেশ দেন, ‘তোমাদের পথ বড়ই বিপৎসংকুল, বন্ধুর। খবরদার, দুনিয়ার চাকচিক্য যেন তোমাদের ধোঁকায় না ফেলে।’
আমরা পথ্য পেয়ে গেছি, যার ভেতর লুকিয়ে আছে মা–বাবার আরোগ্য; অতএব, হেকিমের এই সব ভয়ের বাণী আমাদের খুব বেশি আর ভাবিত করে না। আমরা সানন্দ রওনা দিই। আমাদের সবার চোখ-মুখ-হাত-পা বেয়ে উপচে পড়তে থাকে উচ্ছ্বাস। আমরা যেন বিজয়ী সৈন্যদলের সদস্য, যাদের বরণ করতে মাতৃভূমি হৃদয় পেতে অপেক্ষা করছে। আমরা ছুটি সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আমরা ছুটি বাতাসের সঙ্গে হল্লা করে। যেকোনো মূল্যেই হোক, সন্ধ্যারাতের ভেতরই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে, আমাদের বাবা–মায়েদের ভালো করে তুলতে হবে। কত দিন তাদের ঘর আলো করা হাসিমুখ দেখি না! কিন্তু পথ ফুরানোর আগেই হেকিমের শঙ্কাই যেন সত্যি হয়। শুধু কি সত্য, অনিবার্য সত্য হয়ে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি, ধীরে ধীরে আমাদের চলার পথ গম্ভীর হয়ে উঠছে। অথচ আসার সময় এই পথই ছিল আকাশের মতো দিলখোলা। সন্ধ্যা হতে হতে জঙ্গল পাড়ি দেওয়ার লক্ষ্য ছিল আমাদের। অথচ সন্ধ্যা নামল জঙ্গলের ঠিক প্রারম্ভিকতায়। এই প্রথম আনন্দ ফেলে আমরা ভীত হয়ে উঠলাম।
আমাদের মনে হলো, এই মুহূর্তে হেকিমের উপদেশ পুনর্পাঠ করা সবচেয়ে জরুরি। আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। থলে থেকে বের করে শুকনো রুটি ও নাশপাতি খেলাম। নব উদ্যমে রওনা দেওয়ার আগে হেকিমের উপদেশবাণী পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সঙ্গীদের ভাবনায় তখন হেকিম নয়, আপন আপন ঘর বিরাজমান। তারা দ্রুত ঘরে ফিরতে চায়। ফলে উপদেশবাণীর পর্যালোচনা গুরুত্ব পেল না। গুরুত্ব না পেলেও হেকিমের কথাই যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যেতে লাগল। আমরা টের পেলাম, পথ তার দৈর্ঘ্যের চেয়ে ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে উঠছে। দীর্ঘ পথের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে আমাদের দেহবল। একটু পর বাতাসে মৃদু ঢেউ উঠতে লাগল। আমরা বুক ভরে সবুজ পাতার সতেজ বায়ু গ্রহণ করতে লাগলাম। কিন্তু এই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মৃদু বাতাস অচিরেই রূপান্তরিত হলো ঝড়ে। ধীরে ধীরে ঝড় বদলে যেতে লাগল ঝঞ্ঝাবায়ুতে। আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলাম। বাতাসের প্রাবল্যে আমাদের জামার বোতাম পটপট করে খুলে যেতে লাগল। আমাদের পিঠ ফুলে উঠতে লাগল বন্য ঝড়ের আক্রমণে। হঠাৎ আমরা আবিষ্কার করলাম, পথ দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় পথ ঝড়হীন শান্ত ও প্রশস্ত। আর প্রথম পথ তখনো পাগলা হাতির মতো লাফাচ্ছে। আমরা হুড়মুড়িয়ে দ্বিতীয় পথে পা বাড়ালাম।
দু–কদম যেতেই আমার কানের পর্দায় বাজতে লাগল হেকিমের সতর্কবার্তা, ‘তোমাদের ফেরার পথ বড়ই বিপৎসংকুল, বন্ধুর।’ খটকা লাগল আমাদের। এই পথ তো বিপৎসংকুল নয়। তাহলে এই পথ নিশ্চয়ই আমাদের পথ নয়। সবাইকে সতর্ক করলাম আমি। বললাম, ‘এই পথে যেয়ো না। এটা ছলনা।’ আমার কথায় বেশির ভাগ সঙ্গীই থমকে দাঁড়াল। কয়েকজন কর্ণপাত না করে এগিয়ে গেল। একজন তো দৃষ্টির তাচ্ছিল্যে আমাদের ভস্ম করে দিতে চাইল। আমরা উৎকণ্ঠাভরা চোখে ওদের মসৃণ গমন পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। আমাদের কেউ কেউ ফিসফাস করতে লাগল, ওদের সঙ্গে গেলেই বোধ হয় ভালো করতাম। শুধু শুধু এই ঝোড়ো পথে পড়ে আছি। তাদের কথার রেশ ফুরাল না, তার আগেই গলা-বুক থাবড়ে বাতাস–বাতাস বলে চিৎকার করতে লাগল সঙ্গ ত্যাগকারীরা। ঝড়হীন প্রশস্ত রাস্তার ওপর ওরা আছাড়িবিছাড়ি করতে লাগল। একমাত্র মৃত্যুক্ষণ ঘনিয়ে এলেই মানুষ এভাবে আছাড়িবিছাড়ি করে। আমরা ওদের বাতাস–বাতাস চিৎকারের অর্থ বুঝলাম না। তার আগেই ওদের নিষ্প্রাণ দেহ ধপাধপ মাটিতে পড়ে যেতে লাগল। ভয়ে, উৎকণ্ঠায়, বিস্ময়ে আমরা নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম। হঠাৎ ইথারে বাজতে লাগল এক অদৃশ্য কণ্ঠ, ‘নিশ্বাসের দারিদ্র্য, বাতাসের অভাব ওদের মৃত্যু ঘটিয়েছে।’ বুঝলাম, ওরা যে পথে গেছে, সে পথে কোনো অক্সিজেন নেই। ঝড় থেকে বাঁচতে নিয়তি ওদের নিয়ে গেছে বাতাসশূন্য রাস্তায়। গোপন সমবেদনা জানিয়ে আমরা ফিরে এলাম আপন পথে, যে পথ তখনো ঝঞ্ঝাকবলিত। একটু পর ঝড় থামল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার আমরা পথ চলতে শুরু করলাম। কিন্তু হারিয়ে ফেলা পাঁচ সঙ্গীর জন্য আমাদের মন খারাপ হয়ে রইল। এতক্ষণে ওদের বাবা–মায়েদের মৃত্যুও নিশ্চয়ই অবধারিত হয়ে গেছে। প্রয়াত সঙ্গীদের বাবা–মায়েদের আসন্ন প্রয়াণের কথা ভেবে আমরা বিষণ্ন হয়ে উঠলাম। আমরা তাদের মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিলাম। ওদের মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের সামনের পথচলার বড় উপদেশদাতা।
কিন্তু মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে উপদেশ ভুলে যাওয়ার জন্য। ফলে এই উপদেশ ভুলে যেতে আমাদের সময় লাগল না। পথচলার একটা পর্যায়ে যখন আমাদের পথ কাঁটায় ভরে উঠল, তখন আমরা এই জীবন্ত উপদেশও ভুলে গেলাম। আমরা দেখলাম, দুপাশের কাঁটাওয়ালা গাছ আমাদের চলার পথকে বড় সংকীর্ণ করে তুলেছে। কাঁটার ঘায়ে আমাদের পোশাক ফুটো হয়ে যেতে লাগল। আমাদের দুই বাহু রক্তাক্ত হয়ে উঠল। সুচালো কাঁটার নিদারুণ আঘাতে আমরা আর্তনাদ করতে লাগলাম। চলার এমন ভয়ংকর পথ আমরা আগে কখনো দেখিনি। তবু আমাদের পথচলা থামল না একমুহূর্তের জন্য। কারণ, পথের এই বিপদ আমাদের নিয়তি। নিয়তিকে আলিঙ্গন করেই আমরা পথে বেরিয়েছি। হঠাৎ আমাদের সামনে নতুন এক পথ উদ্ভাসিত হলো। যে পথ কাঁটামুক্ত, যে পথ মসৃণ, যে পথ মখমলকোমল। ওই পথে যাবে বলে আমাদের কেউ কেউ হল্লা করে উঠল। ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্ত হলাম আমরা সবাই। আমরা লাগলাম, ‘হ্যাঁ, ওটাই আরামদায়ক পথ। ওই পথে সহজেই গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। কাঁটার এই আঘাত আর কতই বা সহ্য করা যায়!’ নতুন উদিত হওয়া এই পথে কদম বাড়াতে গিয়ে আমাদের টনক নড়ল। এটা নতুন পরীক্ষা নয় তো! আমরা থমকে দাঁড়ালাম। নিষেধ করলাম সবাইকে, ‘এই পথ বোধ হয় আমাদের পথ নয়।’ আমার কথায় বেশির ভাগ সঙ্গীই থেমে গেল। কিন্তু কয়েকজন ছুটে গেল ওই আরামের হাতছানিতে। আমরা খুব করে চাইলাম, নতুন চেহারায় প্রথম ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় আর। আমরা আর কোনো সঙ্গীকে হারাতে চাই না। আমরা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। তারা যদি স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে, নিয়তি যদি তাদের নতুন পরীক্ষার চোরাবালিতে নিক্ষেপ না করে, তবে আমরাও তাদের পথ ধরব।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। প্রবল ঝড়ে এক বিশাল কাঁটাওয়ালা গাছ তাদের ওপর আছড়ে পড়ল। মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তাদের শরীর। কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এলাম আমরা পুরোনো পথে। একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার চেয়ে কাঁটাযুক্ত পথ অনেক ভালো। আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, লোভের যত বড় হাতছানিই আসুক, আর আমরা বিভ্রান্ত হব না। আর আমরা চোরাবালিতে পড়ব না। রাত গভীর হতে লাগল। জঙ্গলে এতক্ষণ নক্ষত্রের আলো ছড়িয়ে ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর বাতি নেভার মতো নিভে গেল নক্ষত্রের আলো। নিকষ আঁধারে ছেয়ে গেল গোটা জঙ্গল। নিজের হাতটাও দেখা যায় না, এমন অবস্থা। আমাদের পথচলা থেমে গেল। এই আঁধারে চলতে গেলে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নির্ঘাৎ হাত-পা ভাঙবে নয়তো কপাল ফাটবে। এর ভেতর কীভাবে পথ চলা যায়! সময় বইতে লাগল। আমাদের প্রত্যেকের থলেতে হেকিমের দেওয়া পথ্য। যে পথ্যের স্পর্শ থেকে আমরা মা–বাবার গায়ের ওম পাচ্ছি। আমরা বুঝতে পারছি, এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের ঘরে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আর ঘরে ফিরতে দেরি হলে আমাদের মা-বাবাদের অসুস্থতাও দীর্ঘ হবে। কিন্তু কী করব, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম না। এই মুহূর্তে ঠিক কীই–বা করা যায়, নিরীহ অপেক্ষা ছাড়া! হঠাৎ আমাদের সামনে একবিন্দু আলোর রেখা ফুটে উঠল। সেই আলো পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া পাথরের মতো গড়িয়ে এল আমাদের পায়ের কাছে। আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। আমরা বিহ্বল হয়ে পড়লাম। আলোর ভোর কি তবে অত্যাসন্ন? ওই আলোর বিন্দুর দিকেই কি তবে আমাদের গন্তব্য? আলোকে কেন্দ্র করে কাফেলা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল। একদল আলোর বিন্দুকে লক্ষ্য বানিয়ে পথ চলতে উদগ্রীব। অন্য দল আলোর বিন্দুকে উপেক্ষা করার সিদ্ধান্তে স্থির। কারণ, হেকিম আলো নামের আলেয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। হেকিমের উদ্ধৃতি টেনে আমিও প্রথম দলকে সতর্ক করলাম। কিন্তু তারা ততক্ষণে বাড়িতে ফিরতে ব্যাকুল। তা ছাড়া নিকষ আঁধারে আলোর অনুসরণ ব্যতীত গন্তব্যে পৌঁছানো অসম্ভব। ফলে তারা আলোর বিন্দুকে সামনে রেখে ছুটতে লাগল সামনের দিকে। তাদের অবয়ব আমাদের দৃষ্টির সামনে ক্ষুদ্র হতে হতে মিলিয়ে গেল। তাদের পদশব্দ শোনার জন্য আমরা কান পাতলাম। তাদের গমনচিহ্ন দেখার জন্য আমরা চোখ পাতলাম। কিন্তু ততক্ষণে দুই দলের মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এক অদৃশ্য দেয়াল। তারা আলেয়ার খপ্পরে পড়ল নাকি বাড়ির পথ খুঁজে পেল, অন্ধকারের দেয়ালে বুঝতে পারলাম না আমরা। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমরা অন্ধকারে গলা ডুবিয়ে বসে রইলাম।
তারপরও নক্ষত্র কিংবা সূর্যের আলোর দেখা আমরা পেলাম না। আমাদের এই জঙ্গলযাত্রা যে এক অনিবার্য দীর্ঘতায় পর্যবসিত হতে চলেছে, বুঝতে বাকি রইল না আমাদের। কিন্তু মা–বাবার বিষণ্ন রুগ্ন মুখ আমাদের চুপচাপ বসে থাকতে দিল না। অন্ধকার ঠেলেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যেতে লাগলাম। অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে আমরা যখন বিপন্ন ও বিধ্বস্ত, ঠিক তখনই মহা সুসংবাদ হয়ে আমাদের চোখের সামনে দীপ্তিমান হয়ে উঠল সূর্য। ‘সূর্য উঠেছে, ওই যে আমাদের বাড়ি’—আমরা শিশুদের মতো চিৎকার করে উঠলাম। আমাদের চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল আমাদের বাড়ির মায়াবী উঠোনে, ছাতিম ফুলের থোকায় থোকায়। সেই চিৎকার শুনে আমাদের মা–বাবারা দৌড়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আমরা দেখলাম, আমাদের মা–বাবারা অনেক বেশি সতেজ হয়ে উঠেছে। তাদের দেহে রোগের কোনো চিহ্ন নেই। তারুণ্য জ্বলজ্বল করছে তাদের সারা অঙ্গে। আমরা আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যেকে যে যার মা–বাবার সঙ্গে আলিঙ্গন করলাম। এই আনন্দের মধ্যেও আমরা খুঁজে ফিরলাম তাদের মা–বাবাদের, যারা গন্তব্যের জন্য ঝড়হীন প্রশান্ত পথ, মখমলকোমল রাস্তা আর আলোর বিন্দু বেছে নিয়েছিল। কিন্তু এই আনন্দমেলায় তাদের মা–বাবারা অনুপস্থিত। কারণ, জঙ্গলের কুহক তাদের সন্তানদের ঘরে ফিরতে দেয়নি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল র ব ন দ আম দ র ব ব আম দ র চ আম দ র জ আম দ র ম ল আম দ র আম দ র ক আম দ র স ম দ র পথ আম দ র প য় আম দ র উৎকণ ঠ র আগ ই ল গল ম র স মন সতর ক উপদ শ প রথম আনন দ উঠল ম এই পথ করল ম
এছাড়াও পড়ুন:
শাহরুখের ব্যাপারে সাবধান করলেন জুহি চাওলা
বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। অভিনয় গুণে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে দোলা দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে যশ-খ্যাতি যেমন পেয়েছেন, তেমনি আয় করেছেন মোটা অঙ্কের অর্থও। রবিবার (২ নভেম্বর) ৬০ বছর পূর্ণ করে একষট্টিতে পা দেবেন এই তারকা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অনেক নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। তাদের মধ্যে অন্যতম জুহি চাওলা। ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’, ‘রামজানে’, ‘ডর’, ‘ইয়েস বস’, ‘ডুপ্লিকেট’সহ আরো কিছু জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন এই জুটি। একসঙ্গে অভিনয় ছাড়াও, এই দুই তারকা বাস্তব জীবনে খুবই ভালো বন্ধু। কেবল তাই নয়, ব্যবসায়ীক অংশীদারও তারা।
আরো পড়ুন:
শাহরুখের অজানা এই সাত তথ্য জানেন?
পাকিস্তানের সন্ত্রাসী তালিকায় সালমান খান কেন?
বন্ধু শাহরুখের জন্মদিন উপলক্ষে হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন জুহি। এ আলাপচারিতায় স্মৃতিচারণ তো করেছেনই, পাশাপাশি শাহরুখের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
শাহরুখের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “আমি যখন প্রথম ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হই, তখন সহপ্রযোজক বিবেক ভাসওয়ানি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার নায়ক দেখতে আমির খানের মতো।’ আমি শাহরুখকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। দেখি, শাহরুখের চুল চোখের ওপরে নেমে এসেছে। আর সে একেবারেই আমার কল্পনার সেই ‘চকলেট বয়’ নয়! যখন কাজ শুরু করি, তখন বুঝতে পারি, সে একদম নতুন অভিনেতাদের মতো নয়, সে পরিশ্রমী, দিনে তিন শিফটে কাজ করছে।”
একটি ঘটনা বর্ণনা করে জুহি চাওলা বলেন, “আমার মনে আছে, ‘ইয়েস বস’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়, কোনো দৃশ্য ঠিকমতো লেখা না থাকলে পরিচালক আজিজজি (আজিজ মির্জা) বলতেন, ‘শাহরুখ আসুক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ রোমান্স আর মজার মিশেলে থাকা দৃশ্যগুলো আমাদের সবচেয়ে ভালো ছিল। সেই সূত্রেই আমরা অনেকগুলো সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছি।”
শাহরুখের পাশে অবস্থান করলে সাবধান থাকার কথার কথা বলেছেন জুহি। হাসতে হাসতে এ অভিনেত্রী বলেন, “শাহরুখের আশেপাশে থাকলে সাবধানে থাকবেন। কারণ সে কথা দিয়ে আপনাকে যেকোনো কিছু করাতে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে। ওর কথাবলার ভঙ্গি এমন যে, আপনি ‘না’ বলতেই পারবে না। আমি ‘ডুপ্লিকেট’ সিনেমা করতে চাইছিলাম না, কারণ সেখানে আমার তেমন কিছু করার ছিল না। আমরা তখন আরেকটি সিনেমার শুটিং করছিলাম, আর শাহরুখ আমাকে সিঁড়িতে বসিয়ে দুই ঘণ্টা বোঝায় এবং আমি সিনেমাটিতে চুক্তিবদ্ধ হই। সে আপনাকে যেকোনো কিছু করতে রাজি করাতে পারে, তাই সাবধানে থাকবেন।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “অফস্ক্রিনে আমাদের সম্পর্কেও উত্থান-পতন রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কোনো না কোনোভাবে আমাদের যুক্ত রেখেছেন, এমনকি আইপিএলের মাধ্যমেও। আমাদের বন্ধন কোনো পরিকল্পনার ফল নয়, এটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে আইপিএল দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) সহ-মালিক জুহি ও তার স্বামী জয় মেহতা। এই দলের পেছনে জুহি বিনিয়োগ করেছেন ৬২৯ কোটি রুপি। বর্তমানে এই দলটির মূল্য আছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি রুপি। শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘রেড চিলিস গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন জুহি।
১৯৬৫ সালে ২ নভেম্বর ভারতের নয়াদিল্লিতে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহরুখ খান। তার শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর কেটেছে ম্যাঙ্গালুরুতে। শাহরুখের দাদা ইফতিখার আহমেদ স্থানীয় পোর্টের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যার কারণে সেখানে বসবাস করেন তারা। শাহরুখের বাবার নাম তাজ মোহাম্মদ খান, মা লতিফ ফাতিমা।
দিল্লির হংসরাজ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন শাহরুখ খান। তারপর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে গণযোগাযোগ বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। কিন্তু অভিনয় জীবন শুরু করার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। তবে বলিউডে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-তে ভর্তি হন এই শিল্পী।
১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন শাহরুখ খান। রোমান্টিক ঘরানার এ সিনেমায় অভিনয় করে নজর কাড়েন তিনি। সিনেমাটিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে সেরা নবাগত অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
একই বছর ‘চমৎকার’, ‘দিল আসনা হে’ ও ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় অভিনয় করেন শাহরুখ। তার পরের বছর ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজের জাত চেনান শাহরুখ। তার অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ হন কোটি ভক্ত; পৌঁছে যান সাফল্যের চূড়ায়। তার অভিনয়ের খ্যাতি আরো বাড়তে থাকে যশরাজ ফিল্মসের সিনেমায় ধারাবাহিকভাবে অভিনয় করে। একের পর এক হিট সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেন শাহরুখ। যদিও তার এই সফলতার জার্নির গল্প মোটেও সহজ ছিল। আর সে গল্প সবারই জানা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন শাহরুখ খান। তার মধ্যে মোট পনেরোবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এর মধ্যে আটবার সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। হিন্দি সিনেমায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে ভারত সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন মোট পাঁচবার। তবে শাহরুখ খানের ৩৩ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে অধরা ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলতি বছর ‘জওয়ান’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
ঢাকা/শান্ত