Prothomalo:
2025-07-04@12:10:46 GMT

গন্তব্য

Published: 4th, July 2025 GMT

আলোর একটি বিন্দু পায়ের কাছে এসে লুটোপুটি খেলে আমাদের মনে পড়ল হেকিমের উপদেশ: ‘আলো কখনো কখনো আলেয়া হয়ে তোমাদের প্রবঞ্চনা দিতে পারে। খবরদার, আলেয়ার খপ্পরে পড়বে না।’

কাফেলায় আমরা যারা আছি, সবার গন্তব্য এক, মনজিল অভিন্ন। আমাদের লোকালয়ে ফিরতে হবে, সন্ধ্যা নামার আগেই। যদিও হেকিম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে যত দ্রুতই আমরা পথ চলি না কেন, জঙ্গলের মাঝখানে কাকের পালকের মতো গহিন রাত্রি নামবে। তবু নিয়তি রেখা বদলাতে আমাদের শেষ চেষ্টা করে যেতে হবে। কারণ, লোকালয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আমাদের বাবা–মায়েরা। ইউসুফ নবীর জন্য তাঁর বাবার যে কাতর অপেক্ষা ছিল, আমাদের মা–বাবাও একই রকম কাতরতা নিয়ে অপেক্ষা করছে নিজ নিজ বাড়িতে। তারা শুধু অপেক্ষায়ই কাতর নয়, তারা কাতর অসুস্থতায়ও। কেউ জন্ডিস, কেউ প্লেগ, কেউ যক্ষ্মার শিকার। কেউ কেউ বা আমাশয়, কলেরা, কুষ্ঠর মতো প্রাণঘাতী রোগে বিপর্যস্ত। তারা আমাদের এবং আমাদের সংগৃহীত পথ্যের জন্য অপেক্ষমাণ।

মাসখানেক আগে অদ্ভুত এক দুর্যোগ নেমেছিল আমাদের জনপদে। এক আশ্চর্য ভোরে; আমরা তখনো আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠিনি, সাদা ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় আমাদের উঠোন, বারান্দা, ঘরের দুয়ার, এমনকি বিছানার বালিশ। এই ঘটনা তাদের বাড়িতেই ঘটে, যাদের বাড়িতে প্রৌঢ়ত্ব পেরোনো মা–বাবা আছে। সেই অলৌকিক ধোঁয়ায় খুকখুক করে কাশতে শুরু করে আমাদের বাবা–মায়েরা। শুরুতে আমরা কাশিকে নয়, গুরুত্ব দিই ধোঁয়াকে। কোথা থেকে এল এই ধোঁয়া, তার উদ্দেশ্য কী, তার শেষ গন্তব্যই বা কোথায়! জমাটবাঁধা এই সব জিজ্ঞাসার কোনো কূলকিনারা আমরা পাই না। পাই শুধু রোগ। বাবা–মায়েদের। কুষ্ঠ, কলেরা, আমাশয়, যক্ষ্মা, জন্ডিস। রোগগুলো যে এই ধোঁয়ারই সৃষ্টি, বুঝতে বাকি থাকে না আমাদের। অচিরেই মা–বাবাকে সুস্থ করে তোলার এক ঐশ্বরিক দায়িত্ব আমাদের কাঁধে এসে পড়ে। হেকিমের খোঁজে আমরা এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করি। কত রকম পথ্য যে তাদের খাওয়াই, কত রকম টোটকার ব্যবহার যে করি, কত রকম গাছগাছড়া যে তাদের গায়ে বাঁধি, হিসাব নেই। কিন্তু তারা সুস্থ হয় না। প্রতিদিনই তারা আগের দিনের চেয়ে একটু একটু করে ক্ষয় হতে থাকে। আমাদের প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কোনো পরোয়াই করে না ব্যাধি। হতাশা যখন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে, যখন আমরা জন্মদাতা পিতা ও জন্মদাত্রী মাতার কবর খননের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি, তখনই খোঁজ পাই এক আশ্চর্য হেকিমের, যার কোনো পথ্যই নাকি ব্যর্থ হয় না। দক্ষিণের জঙ্গলের ওপারে তার আশ্রম। আমরা সবাই, যাদের মা–বাবারা মুমূর্ষু, জঙ্গল পাড়ি দিয়ে নতুন আবিষ্কৃত এই হেকিমের আশ্রমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেদিন সকালেই, মা-বাবার দোয়া নিয়ে, কয়েক দিনের খাবার বেঁধে, আমরা রওনা দিই আশ্রমের উদ্দেশে। এক দিনের পথ যখন আমরা আধা দিনে শেষ করি, ক্লান্ত হওয়ার বদলে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠি। কারণ আর কিছু নয়—হেকিম। হেকিমের এমন সৌম্য-কান্তি মুখ, এমন হৃদয়ভেদী পরিষ্কার দৃষ্টি, এমন স্নিগ্ধ ব্যবহার, আমরা মোহিত হয়ে পড়ি। অপার্থিব এক শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায় আমাদের কাঁধ। হেকিম যেন সব জানতেন, যেন আমাদের জন্যই তিনি অপেক্ষা করছিলেন, এমনই শান্ত তাঁর অভিব্যক্তি। আমরা বিগলিত হই। তাঁর দাওয়াখানা দেখে আমরা হতবাকও হই। সারাটা দিন তিনি হামানদিস্তায় শিকড় বেটে পথ্য প্রস্তুত করেন। আমরা দক্ষিণা দিতে যাই। কিন্তু তিনি গ্রহণ করেন না। তিনি বরং গম্ভীর গলায় বলেন, ‘তোমরা প্রভুর পরীক্ষায় পড়েছ। তোমাদের থেকে দক্ষিণা নেব না।’

‘প্রভুর পরীক্ষা!’ আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। এক আশ্চর্য সকালের অলৌকিক ধোঁয়ায় আমাদের বাবা–মায়েরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এ বুঝি প্রভুর পরীক্ষা! ‘ভালো হবে তো আমাদের বাবা–মায়েরা?’ সকাতর জিজ্ঞাসা করি আমরা।

রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে হেকিমের ঠোঁটে। বলেন, পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবে, কেবল তারাই সুস্থ মা–বাবা ফিরে পাবে। অন্যরা নয়।

হেকিমের কথায় ক্ষণিকের জন্য আমাদের গা ছমছম করে। আমরা উত্তীর্ণ হতে পারব তো প্রভুর পরীক্ষায়! আমরা হেকিমের কাছে দোয়া চাই। এরপর যে যার পথ্য থলেতে ভরে দিনের পড়ন্ত বেলার রোদ পিঠে নিয়ে আমরা ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিই। যাওয়ার সময় হেকিম শেষ উপদেশ দেন, ‘তোমাদের পথ বড়ই বিপৎসংকুল, বন্ধুর। খবরদার, দুনিয়ার চাকচিক্য যেন তোমাদের ধোঁকায় না ফেলে।’

আমরা পথ্য পেয়ে গেছি, যার ভেতর লুকিয়ে আছে মা–বাবার আরোগ্য; অতএব, হেকিমের এই সব ভয়ের বাণী আমাদের খুব বেশি আর ভাবিত করে না। আমরা সানন্দ রওনা দিই। আমাদের সবার চোখ-মুখ-হাত-পা বেয়ে উপচে পড়তে থাকে উচ্ছ্বাস। আমরা যেন বিজয়ী সৈন্যদলের সদস্য, যাদের বরণ করতে মাতৃভূমি হৃদয় পেতে অপেক্ষা করছে। আমরা ছুটি সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আমরা ছুটি বাতাসের সঙ্গে হল্লা করে। যেকোনো মূল্যেই হোক, সন্ধ্যারাতের ভেতরই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে, আমাদের বাবা–মায়েদের ভালো করে তুলতে হবে। কত দিন তাদের ঘর আলো করা হাসিমুখ দেখি না! কিন্তু পথ ফুরানোর আগেই হেকিমের শঙ্কাই যেন সত্যি হয়। শুধু কি সত্য, অনিবার্য সত্য হয়ে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি, ধীরে ধীরে আমাদের চলার পথ গম্ভীর হয়ে উঠছে। অথচ আসার সময় এই পথই ছিল আকাশের মতো দিলখোলা। সন্ধ্যা হতে হতে জঙ্গল পাড়ি দেওয়ার লক্ষ্য ছিল আমাদের। অথচ সন্ধ্যা নামল জঙ্গলের ঠিক প্রারম্ভিকতায়। এই প্রথম আনন্দ ফেলে আমরা ভীত হয়ে উঠলাম।

আমাদের মনে হলো, এই মুহূর্তে হেকিমের উপদেশ পুনর্পাঠ করা সবচেয়ে জরুরি। আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। থলে থেকে বের করে শুকনো রুটি ও নাশপাতি খেলাম। নব উদ্যমে রওনা দেওয়ার আগে হেকিমের উপদেশবাণী পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সঙ্গীদের ভাবনায় তখন হেকিম নয়, আপন আপন ঘর বিরাজমান। তারা দ্রুত ঘরে ফিরতে চায়। ফলে উপদেশবাণীর পর্যালোচনা গুরুত্ব পেল না। গুরুত্ব না পেলেও হেকিমের কথাই যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যেতে লাগল। আমরা টের পেলাম, পথ তার দৈর্ঘ্যের চেয়ে ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে উঠছে। দীর্ঘ পথের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে আমাদের দেহবল। একটু পর বাতাসে মৃদু ঢেউ উঠতে লাগল। আমরা বুক ভরে সবুজ পাতার সতেজ বায়ু গ্রহণ করতে লাগলাম। কিন্তু এই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মৃদু বাতাস অচিরেই রূপান্তরিত হলো ঝড়ে। ধীরে ধীরে ঝড় বদলে যেতে লাগল ঝঞ্ঝাবায়ুতে। আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলাম। বাতাসের প্রাবল্যে আমাদের জামার বোতাম পটপট করে খুলে যেতে লাগল। আমাদের পিঠ ফুলে উঠতে লাগল বন্য ঝড়ের আক্রমণে। হঠাৎ আমরা আবিষ্কার করলাম, পথ দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় পথ ঝড়হীন শান্ত ও প্রশস্ত। আর প্রথম পথ তখনো পাগলা হাতির মতো লাফাচ্ছে। আমরা হুড়মুড়িয়ে দ্বিতীয় পথে পা বাড়ালাম।

দু–কদম যেতেই আমার কানের পর্দায় বাজতে লাগল হেকিমের সতর্কবার্তা, ‘তোমাদের ফেরার পথ বড়ই বিপৎসংকুল, বন্ধুর।’ খটকা লাগল আমাদের। এই পথ তো বিপৎসংকুল নয়। তাহলে এই পথ নিশ্চয়ই আমাদের পথ নয়। সবাইকে সতর্ক করলাম আমি। বললাম, ‘এই পথে যেয়ো না। এটা ছলনা।’ আমার কথায় বেশির ভাগ সঙ্গীই থমকে দাঁড়াল। কয়েকজন কর্ণপাত না করে এগিয়ে গেল। একজন তো দৃষ্টির তাচ্ছিল্যে আমাদের ভস্ম করে দিতে চাইল। আমরা উৎকণ্ঠাভরা চোখে ওদের মসৃণ গমন পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। আমাদের কেউ কেউ ফিসফাস করতে লাগল, ওদের সঙ্গে গেলেই বোধ হয় ভালো করতাম। শুধু শুধু এই ঝোড়ো পথে পড়ে আছি। তাদের কথার রেশ ফুরাল না, তার আগেই গলা-বুক থাবড়ে বাতাস–বাতাস বলে চিৎকার করতে লাগল সঙ্গ ত্যাগকারীরা। ঝড়হীন প্রশস্ত রাস্তার ওপর ওরা আছাড়িবিছাড়ি করতে লাগল। একমাত্র মৃত্যুক্ষণ ঘনিয়ে এলেই মানুষ এভাবে আছাড়িবিছাড়ি করে। আমরা ওদের বাতাস–বাতাস চিৎকারের অর্থ বুঝলাম না। তার আগেই ওদের নিষ্প্রাণ দেহ ধপাধপ মাটিতে পড়ে যেতে লাগল। ভয়ে, উৎকণ্ঠায়, বিস্ময়ে আমরা নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম। হঠাৎ ইথারে বাজতে লাগল এক অদৃশ্য কণ্ঠ, ‘নিশ্বাসের দারিদ্র্য, বাতাসের অভাব ওদের মৃত্যু ঘটিয়েছে।’ বুঝলাম, ওরা যে পথে গেছে, সে পথে কোনো অক্সিজেন নেই। ঝড় থেকে বাঁচতে নিয়তি ওদের নিয়ে গেছে বাতাসশূন্য রাস্তায়। গোপন সমবেদনা জানিয়ে আমরা ফিরে এলাম আপন পথে, যে পথ তখনো ঝঞ্ঝাকবলিত। একটু পর ঝড় থামল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার আমরা পথ চলতে শুরু করলাম। কিন্তু হারিয়ে ফেলা পাঁচ সঙ্গীর জন্য আমাদের মন খারাপ হয়ে রইল। এতক্ষণে ওদের বাবা–মায়েদের মৃত্যুও নিশ্চয়ই অবধারিত হয়ে গেছে। প্রয়াত সঙ্গীদের বাবা–মায়েদের আসন্ন প্রয়াণের কথা ভেবে আমরা বিষণ্ন হয়ে উঠলাম। আমরা তাদের মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিলাম। ওদের মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের সামনের পথচলার বড় উপদেশদাতা।

কিন্তু মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে উপদেশ ভুলে যাওয়ার জন্য। ফলে এই উপদেশ ভুলে যেতে আমাদের সময় লাগল না। পথচলার একটা পর্যায়ে যখন আমাদের পথ কাঁটায় ভরে উঠল, তখন আমরা এই জীবন্ত উপদেশও ভুলে গেলাম। আমরা দেখলাম, দুপাশের কাঁটাওয়ালা গাছ আমাদের চলার পথকে বড় সংকীর্ণ করে তুলেছে। কাঁটার ঘায়ে আমাদের পোশাক ফুটো হয়ে যেতে লাগল। আমাদের দুই বাহু রক্তাক্ত হয়ে উঠল। সুচালো কাঁটার নিদারুণ আঘাতে আমরা আর্তনাদ করতে লাগলাম। চলার এমন ভয়ংকর পথ আমরা আগে কখনো দেখিনি। তবু আমাদের পথচলা থামল না একমুহূর্তের জন্য। কারণ, পথের এই বিপদ আমাদের নিয়তি। নিয়তিকে আলিঙ্গন করেই আমরা পথে বেরিয়েছি। হঠাৎ আমাদের সামনে নতুন এক পথ উদ্ভাসিত হলো। যে পথ কাঁটামুক্ত, যে পথ মসৃণ, যে পথ মখমলকোমল। ওই পথে যাবে বলে আমাদের কেউ কেউ হল্লা করে উঠল। ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্ত হলাম আমরা সবাই। আমরা লাগলাম, ‘হ্যাঁ, ওটাই আরামদায়ক পথ। ওই পথে সহজেই গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। কাঁটার এই আঘাত আর কতই বা সহ্য করা যায়!’ নতুন উদিত হওয়া এই পথে কদম বাড়াতে গিয়ে আমাদের টনক নড়ল। এটা নতুন পরীক্ষা নয় তো! আমরা থমকে দাঁড়ালাম। নিষেধ করলাম সবাইকে, ‘এই পথ বোধ হয় আমাদের পথ নয়।’ আমার কথায় বেশির ভাগ সঙ্গীই থেমে গেল। কিন্তু কয়েকজন ছুটে গেল ওই আরামের হাতছানিতে। আমরা খুব করে চাইলাম, নতুন চেহারায় প্রথম ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় আর। আমরা আর কোনো সঙ্গীকে হারাতে চাই না। আমরা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। তারা যদি স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে, নিয়তি যদি তাদের নতুন পরীক্ষার চোরাবালিতে নিক্ষেপ না করে, তবে আমরাও তাদের পথ ধরব।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। প্রবল ঝড়ে এক বিশাল কাঁটাওয়ালা গাছ তাদের ওপর আছড়ে পড়ল। মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তাদের শরীর। কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এলাম আমরা পুরোনো পথে। একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার চেয়ে কাঁটাযুক্ত পথ অনেক ভালো। আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, লোভের যত বড় হাতছানিই আসুক, আর আমরা বিভ্রান্ত হব না। আর আমরা চোরাবালিতে পড়ব না। রাত গভীর হতে লাগল। জঙ্গলে এতক্ষণ নক্ষত্রের আলো ছড়িয়ে ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর বাতি নেভার মতো নিভে গেল নক্ষত্রের আলো। নিকষ আঁধারে ছেয়ে গেল গোটা জঙ্গল। নিজের হাতটাও দেখা যায় না, এমন অবস্থা। আমাদের পথচলা থেমে গেল। এই আঁধারে চলতে গেলে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নির্ঘাৎ হাত-পা ভাঙবে নয়তো কপাল ফাটবে। এর ভেতর কীভাবে পথ চলা যায়! সময় বইতে লাগল। আমাদের প্রত্যেকের থলেতে হেকিমের দেওয়া পথ্য। যে পথ্যের স্পর্শ থেকে আমরা মা–বাবার গায়ের ওম পাচ্ছি। আমরা বুঝতে পারছি, এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের ঘরে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আর ঘরে ফিরতে দেরি হলে আমাদের মা-বাবাদের অসুস্থতাও দীর্ঘ হবে। কিন্তু কী করব, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম না। এই মুহূর্তে ঠিক কীই–বা করা যায়, নিরীহ অপেক্ষা ছাড়া! হঠাৎ আমাদের সামনে একবিন্দু আলোর রেখা ফুটে উঠল। সেই আলো পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া পাথরের মতো গড়িয়ে এল আমাদের পায়ের কাছে। আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। আমরা বিহ্বল হয়ে পড়লাম। আলোর ভোর কি তবে অত্যাসন্ন? ওই আলোর বিন্দুর দিকেই কি তবে আমাদের গন্তব্য? আলোকে কেন্দ্র করে কাফেলা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল। একদল আলোর বিন্দুকে লক্ষ্য বানিয়ে পথ চলতে উদগ্রীব। অন্য দল আলোর বিন্দুকে উপেক্ষা করার সিদ্ধান্তে স্থির। কারণ, হেকিম আলো নামের আলেয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। হেকিমের উদ্ধৃতি টেনে আমিও প্রথম দলকে সতর্ক করলাম। কিন্তু তারা ততক্ষণে বাড়িতে ফিরতে ব্যাকুল। তা ছাড়া নিকষ আঁধারে আলোর অনুসরণ ব্যতীত গন্তব্যে পৌঁছানো অসম্ভব। ফলে তারা আলোর বিন্দুকে সামনে রেখে ছুটতে লাগল সামনের দিকে। তাদের অবয়ব আমাদের দৃষ্টির সামনে ক্ষুদ্র হতে হতে মিলিয়ে গেল। তাদের পদশব্দ শোনার জন্য আমরা কান পাতলাম। তাদের গমনচিহ্ন দেখার জন্য আমরা চোখ পাতলাম। কিন্তু ততক্ষণে দুই দলের মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এক অদৃশ্য দেয়াল। তারা আলেয়ার খপ্পরে পড়ল নাকি বাড়ির পথ খুঁজে পেল, অন্ধকারের দেয়ালে বুঝতে পারলাম না আমরা। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমরা অন্ধকারে গলা ডুবিয়ে বসে রইলাম।

তারপরও নক্ষত্র কিংবা সূর্যের আলোর দেখা আমরা পেলাম না। আমাদের এই জঙ্গলযাত্রা যে এক অনিবার্য দীর্ঘতায় পর্যবসিত হতে চলেছে, বুঝতে বাকি রইল না আমাদের। কিন্তু মা–বাবার বিষণ্ন রুগ্‌ন মুখ আমাদের চুপচাপ বসে থাকতে দিল না। অন্ধকার ঠেলেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যেতে লাগলাম। অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে আমরা যখন বিপন্ন ও বিধ্বস্ত, ঠিক তখনই মহা সুসংবাদ হয়ে আমাদের চোখের সামনে দীপ্তিমান হয়ে উঠল সূর্য। ‘সূর্য উঠেছে, ওই যে আমাদের বাড়ি’—আমরা শিশুদের মতো চিৎকার করে উঠলাম। আমাদের চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল আমাদের বাড়ির মায়াবী উঠোনে, ছাতিম ফুলের থোকায় থোকায়। সেই চিৎকার শুনে আমাদের মা–বাবারা দৌড়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আমরা দেখলাম, আমাদের মা–বাবারা অনেক বেশি সতেজ হয়ে উঠেছে। তাদের দেহে রোগের কোনো চিহ্ন নেই। তারুণ্য জ্বলজ্বল করছে তাদের সারা অঙ্গে। আমরা আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যেকে যে যার মা–বাবার সঙ্গে আলিঙ্গন করলাম। এই আনন্দের মধ্যেও আমরা খুঁজে ফিরলাম তাদের মা–বাবাদের, যারা গন্তব্যের জন্য ঝড়হীন প্রশান্ত পথ, মখমলকোমল রাস্তা আর আলোর বিন্দু বেছে নিয়েছিল। কিন্তু এই আনন্দমেলায় তাদের মা–বাবারা অনুপস্থিত। কারণ, জঙ্গলের কুহক তাদের সন্তানদের ঘরে ফিরতে দেয়নি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আল র ব ন দ আম দ র ব ব আম দ র চ আম দ র জ আম দ র ম ল আম দ র আম দ র ক আম দ র স ম দ র পথ আম দ র প য় আম দ র উৎকণ ঠ র আগ ই ল গল ম র স মন সতর ক উপদ শ প রথম আনন দ উঠল ম এই পথ করল ম

এছাড়াও পড়ুন:

পুঁজিবাজারের মাঠ খেলার জন্য প্রস্তুত: বিএসইসি কমিশনার

বর্তমানে পুঁজিবাজারের মাঠ তো খেলার জন্য পুরো প্রস্তুত। যারা বিনিয়োগ করতে চান, তাদের জন্য ভালো ফল পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার এম. আলী আকবর।

শুক্রবার (৪ জুলাই) ও শনিবার (৫ জুলাই) দুই দিনব্যাপী আশুলিয়ার ব্র্যাক সিডিএমে ক‍্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) যৌথ উদ্যোগে আবাসিক কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

কর্মশালার শুরুতে ভিডিও বার্তায় শুভেচ্ছা জানান বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।

আরো পড়ুন:

ডাটা সেন্টার বিক্রির কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি

বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণার ব্যাখ্যা দিল রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স

এছাড়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিএসইসির কমিশনার ফারজানা লালারুখ, সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মীর মোশাররফ হোসেন, ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিষ্টস ফোরামের (সিএমজেএম) সভাপতি এসএম গোলাম সামদানী ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবু আলী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কমিশনের সহকারী পরিচালক শহীদুল ইসলাম।

বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আপনারা কি ফাউল খেলতে চাচ্ছেন, এমন মাঠ নেই তাই আস্থা পাচ্ছেন না? নাকি শৃঙ্খলভাবে খেলার মাঠে আস্থা পাচ্ছেন না, যেখানে প্লেয়িং ফিল্ডে সুন্দরভাবে খেলা যায়? আমি বুঝতে পারছি না বিনিয়োগকারীরা কোন ধরনের মার্কেটের জন্য আস্থার সংকট দেখছে। আমরা চাই বিনিয়োগকারীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন। আর পুঁজিবাজারও যেন উন্নতি করে।”

তিনি আরো বলেন, “শেয়ারবাজারে আস্থা সংকট নিয়ে কথা হচ্ছে। আমি নিজেও জানি না আস্থা কখন কিভাবে, কার ওপর হয় এবং তা কতক্ষণ থাকে।তবে আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারব এই বাজারে আমার কোনো নেতিবাচক ভূমিকা নেই। এই কমিশন ব‍্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করে না। বিশ্বাস বা কনফিডেন্স কখন কোন বিষয়ে কার ওপর হয়, সেটা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন না। এই মাকেটের ব্যাপারে কোনো ধরনের নেতিবাচক ভূমিকা বিএসইসির নেই। আমরা চাই মার্কেট ভালো হোক।”

আলী আকবর বলেন, “সাধারণভাবে প্রশ্ন জাগে বিএসইসি এত জরিমানা কেন করে? যখন কেউ আইন বা বিধি লঙ্ঘন করে তখনই পেনাল্টি করা হয়। যে বা যারা পুঁজিবাজারকে ধ্বংস করবে বা করে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তবে এটা আগেও করা হয়েছে, কৌশলে। অথবা করা হয়নি।”

তিনি বলেন, “সত্য সুন্দরের সাথে অসত্যকে মিশ্রণ করা যাবে না। যিনি জরিমানা পরিশোধে রাজি, তার কোনো সমস্যা নেই। আর যিনি আপিল করবেন, সেটিও তার অধিকার। কমিশনের পক্ষে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করা সম্ভব নয়। পুঁজিবাজার ধ্বংসে যেসব চক্র সক্রিয়, বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বিএসইসি কমিশনার বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি অ্যানফোর্সমেন্টের প্রয়োজন রয়েছে। এটা না করলে বাজারকে সঠিকপথে রাখা যাবে না। পেনাল্টির ব্যাপারে দুটো অপশন, একটি আমাদের পেনাল্টির টাকা আপনি দিয়ে দেবেন। অপরটি হলো টাকা না দিয়ে আপনি আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। তবে পেনাল্টির টাকা একদিন না এক সময় আদায় হবেই।”

বিএসইসি কমিশনার ফারজানা লালারুখ বলেন, “পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিএসইসি ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের আয়োজন অব্যাহত থাকবে।”

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মীর মোশাররফ হোসেন বলেন, “তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধানে সাংবাদিকদের রিপোর্ট আমাদের বড় সহায়তা করে। অনেক সময় সাংবাদিকরা ব্যক্তিগতভাবেও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। আজকের এই প্রশিক্ষণ তাদের আরও কার্যকর রিপোর্টিংয়ে সহায়তা করবে বলে মনে করি।”

সিএমজেএফ সভাপতি এস এম গোলাম সামদানী ভূঁইয়া বিএসইসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “বাজার উন্নয়নে সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে এ ধরনের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত সময়োপযোগী।”

ঢাকা/এনটি/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ