পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনি-বিশেষজ্ঞ ও অবেদনবিদ না থাকায় ৪১ বছর ধরে প্রসূতিদের অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। এ ছাড়া অন্য চিকিৎসকের সংকট তো আছেই। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা-সেবা।

এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে আড়াই লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। চিকিৎসক ও অবেদনবিদসংকটে এই উপজেলার বাইরে গিয়ে দরিদ্র ওই জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা করাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

৭ মে সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, দুজন চিকিৎসক চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা হলেন চিকিৎসা কর্মকর্তা শওকত ওসমান ও চিকিৎসা কর্মকর্তা এইচ এম আলভি আহম্মেদ। বহির্বিভাগে তাঁরা দুজন বেলা দেড়টা পর্যন্ত ২২৬ জন রোগীকে চিকিৎসা–সেবা দিয়েছেন। তখনো তাঁদের সামনে অন্তত ২০ জন রোগী অপেক্ষমাণ ছিলেন। এ ছাড়া জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ২২ জন।
কথা হয় মিলন সিকদার, শিরিন বেগম, আকলিমা বেগম, রীনা বেগমসহ আরও কয়েকজন রোগীর সঙ্গে। তাঁদের সবার ভাষ্য, তাঁরা খুবই গরিব। জেলা ও বিভাগীয় শহরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য তাঁদের নেই।

আইরিন বেগম সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি এসেছেন চিকিৎসা নিতে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানিয়েছেন অস্ত্রোপচার লাগবে। আইরিন বেগম বলেন, ‘এইহানে অপারেশন অইলে বোলে কোনো টাহা লাগত না। স্বামী শ্রমিকের কাজ করেন। কোনো রহমে সংসার চলে। ক্লিনিকে অপারেশন করতে বোলে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাহা লাগে। হেই টাহা এহন কোমনে পামু?’

বহির্বিভাগের ফার্মাসিস্ট নিখিল কুমার বলেন, প্রতিদিন দুই শ থেকে তিন শ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। কোনো দিন তিন শর বেশি রোগী আসেন।

জ্যেষ্ঠ নার্স বিবি আয়েশা বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী ভর্তি থাকেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রসূতিদের জন্য আধুনিক অস্ত্রোপচার কক্ষ রয়েছে, যা কোনো দিন চালুই হয়নি। সরঞ্জামও রয়েছে ৫০ লক্ষাধিক টাকার। ব্যবহার না হওয়ায় ওটি লাইট, টেবিল, ডায়াথারমি যন্ত্র, সাকার যন্ত্রসহ ৫০ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের অস্ত্রোপচারের নানা সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

লেবার ওয়ার্ডের মিডওয়াইফ হাফসা আক্তার বলেন, প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ২০০ প্রসূতির নরমাল প্রসব করানো হয়। মাসে অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন প্রসূতি আসেন, যাঁদের অস্ত্রোপচার করাতে হয়। এখানে অস্ত্রোপচার বন্ধ থাকায় তাঁদের বাইরে যেতে হয়।

দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। শুরুতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যার ছিল। ২০১৪ সালে এটিকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ওই সময় স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পুরোনো ভবন লাগোয়া আরেকটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করে।

৫০ শয্যার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ চিকিৎসকের ২১টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ আটজন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন। চিকিৎসকের বাকি ১৩টি পদ শূন্য।

দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো.

মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শুরু থেকেই গাইনি-বিশেষজ্ঞ ও অবেদনবিদ পায়নি। অথচ অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্রটি ছাড়া অস্ত্রোপচারের আধুনিক সব সরঞ্জাম তাঁদের রয়েছে। শুধু এই দুই পদের চিকিৎসক–সংকটে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন পর্যন্ত প্রসূতিদের অস্ত্রোপচার শুরুই হয়নি। এতে অস্ত্রোপচারকক্ষের সরঞ্জাম নষ্ট হচ্ছে। প্রসূতিসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ উপজেলার মানুষ। অন্য চিকিৎসকের সংকটে অন্য চিকিৎসা–সেবাও ব্যাহত হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের বড় সফলতার একটি হলো টিকাদান কর্মসূচি। সেখানেও জনবলসংকট রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বহুবার জনবলের চাহিদা পাঠনো হয়েছে। কিন্তু তা পূরণ হয়নি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স প রস ত দ র চ ক ৎসক র কর মকর ত সরঞ জ ম জন র গ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

১৬ ফুট মরা খালে, ৭২ ফুট সেতু

খালের প্রশস্ত ১৬ ফুট। এর ওপর প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২ ফুট দৈর্ঘ্যের গার্ডার সেতু নির্মাণ করছে এলজিইডি। এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। নির্মাণাধীন সেতুটির অবস্থান কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের দরাজখোলা গ্রামের ভূঁইয়া বাড়ির দক্ষিণ পাশের খালে। 
স্থানীয়দের অভিযোগ, সেতুটি হলে দুই গ্রামের সামাজিক কবরস্থানে যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে কয়েকটি পরিবারের বের হওয়ার পথও। তাই বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। বর্তমানে সেতুর কাজ বন্ধ রয়েছে।
জানা গেছে, মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের দরাজখোলা গ্রামে ভূঁইয়া বাড়ির দক্ষিণ পাশে খালের ওপর একটি সেতু নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ২০২৩ সালে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭২ ফুট দীর্ঘ ও পাকা সড়ক থেকে প্রায় ৭ ফুট উঁচু গার্ডার সেতু নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করে। একই বছরের ৩ এপ্রিল কার্যাদেশ দেওয়া হয়। সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুন অ্যান্ড সন্স। একই বছরের ২৯ মে কাজ বন্ধ রাখতে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেন দরাজখোলা গ্রামের মঞ্জুরুল হাসান ভূঁইয়া। অভিযোগের ভিত্তিতে একই বছরের ১৯ নভেম্বর কাজটি ছোট করে করার জন্য উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশের ভিত্তিতে ছয় মাস বন্ধ থাকে নির্মাণকাজ। পরে এলজিইডির কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে সেতুটি নতুন ডিজাইনে ছোট করে করবেন বলে স্থানীয়দের আশ্বস্ত করেন। কিন্তু আগের ডিজাইনে আবার কাজ শুরু করলে ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর এক মাসের স্থিতাবস্থার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। পুনরায় কাজ শুরু করলে আবার ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর ছয় মাসের জন্য কাজটি স্থগিত করার নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু আদেশ অমান্য করে কাজ শুরু করলে দাউদকান্দি থানায় ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর একটি সাধারণ ডায়েরি করেন মঞ্জুরুল হাসান ভূঁইয়া। পরে পুলিশ গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়।
এই ঘটনায় দরাজখোলা গ্রামের মুসা কলিমউল্লাহ জানান, সরকার সেতু বানায় জনগণের উপকারের জন্য, কিন্তু এই সেতু খালের তুলনায় অনেক বড় ও উঁচু। এটি নির্মাণ হলে কয়েকটি বাড়ির লোকজনের রাস্তায় উঠতে মই লাগবে। তারা সেতু চান, তবে এত বড় নয়। একই গ্রামের শরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, সেতুটির পশ্চিম পাশে দরাজখোলা, দক্ষিণে মোহাম্মদপুর গ্রামবাসীর সামাজিক কবরস্থান। এই সেতু নির্মাণ হলে কবরস্থানে যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে কোনো নদী বা বড় খাল নেই। আগেরটির মতো ছোট একটি সেতু হলেও কোনো সমস্যা নেই।
মঞ্জুরুল হাসান ভূঁইয়া জানান, বিএস জরিপ অনুযায়ী দরাজখোলা খালের প্রশস্ত ১৬ ফুট। আগে এখানে ৪ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু ছিল। এখানে পৌনে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে বড় সেতু নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে পাশের জমির মালিকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনই সরকারি অর্থের অপচয় হবে। যেহেতু ছোট খাল, তাই আগের মাপে কালভার্ট বা সেতু নির্মাণ করলে পাশের কৃষিজমি রক্ষা পাবে এবং সরকারি অর্থও বাঁচবে। তিনি বলেন, কাজ বন্ধ রাখার কথা থাকলেও গত ২০ এপ্রিল হাইকোর্টর আদেশ অমান্য করে কাজ করায় কুমিল্লা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মতিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন উচ্চ আদালত।
ঠিকাদার হারুনুর রশিদ বলেন, ‘কাজ স্থগিত আছে। উপজেলা প্রকৌশলী কাজ করতে বললে করি, কাজ বন্ধ করতে বললে বন্ধ রাখি।’
এলজিইডির দাউদকান্দি উপজেলা প্রকৌশলী জাহিদ হাসানের ভাষ্য, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলা সহকারী কমিশনার বিষয়টি তদন্ত করছেন। এগুলো সমাধান হলে আবার কাজ শুরু হবে।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ