ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই কিস্তিতে স্মার্টফোন কেনা যাবে, কী কী শর্ত
Published: 19th, May 2025 GMT
ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই কিস্তিতে স্মার্টফোন কিনতে পারবেন গ্রাহকেরা। গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক এই সুবিধা চালু করেছে।
মোট মূল্যের মাত্র ১৫ শতাংশ জমা (ডাউন পেমেন্ট) দিয়ে স্মার্টফোন কেনা যাবে। বাকি টাকা সর্বোচ্চ ৯ মাসের কিস্তিতে মোবাইলের আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে।
উভয় মোবাইল অপারেটর ‘ফোন লক’ পদ্ধতিতে স্মার্টফোন বিক্রি করবে। গ্রামীণফোন জানিয়েছে, কিস্তি পরিশোধের সুরক্ষার জন্য গ্রাহকের কেনা স্মার্টফোনে ‘স্মার্ট লকিং’ পদ্ধতি যুক্ত করা থাকবে। অর্থাৎ এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে কিস্তি পরিশোধের জন্য গ্রাহককে নিয়মিত মনে করিয়ে দেওয়া হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কিস্তি পরিশোধ না হলে স্মার্টফোনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘লক’ হয়ে যাবে।
গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক উভয়ে চীনের মালিকানাধীন নাইজেরিয়াভিত্তিক আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পামপে লিমিটেডের সহযোগিতায় স্মার্টফোন কেনার এই সুবিধা চালু করেছে।
দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন গতকাল রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গ্রামীণফোন সেন্টারসহ নির্দিষ্ট পার্টনার আউটলেট থেকে টেকনো ও আইটেল ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন কিস্তিতে কেনা যাবে।
অন্যদিকে বাংলালিংক ১৫ মে কিস্তিতে স্মার্টফোন কেনার সুযোগ চালুর কথা জানায়। বাংলালিংকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলালিংক সেন্টার থেকে টেকনো, আইটেল ও ইনফিনিক্স ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন কিস্তিতে কেনা যাবে।
গ্রামীণফোনের চিফ প্রোডাক্ট অফিসার (সিপিও) সোলায়মান আলম বলেন, দেশে ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে আনতে তাঁরা ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই সহজ শর্তে স্মার্টফোন কেনার এই সুবিধা চালু করেছেন।
উদ্যোগটিকে সহজ ও নিরাপদ হিসেবে বর্ণনা করেন পামপে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জুন জেং। তিনি বলেন, বাংলাদেশের লাখো মানুষকে ডিজিটাল জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে এই উদ্যোগ।
মুঠোফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আইস্মার্টইউ টেকনোলজি বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রেজওয়ানুল হক বলেন, আগে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে যাঁরা স্মার্টফোন কিনতে পারতেন না, তাঁরা এখন সহজ কিস্তি তা কিনতে পারবেন। উদ্যোগটি তাঁদের জন্য এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।
স্মার্টফোনের গ্রাহকসংখ্যা কম
সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে স্মার্টফোনের গ্রাহকসংখ্যা কম। এর পেছনে ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি রয়েছে বলে মনে করেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ একসঙ্গে অন্তত ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য অনেকের নেই।
স্মার্টফোন ব্যবহারে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশনের (জিএসএমএ) তথ্যেও উঠে এসেছে। জিএসএমএর সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে ৪০ শতাংশ পুরুষ ও ২৫ শতাংশ নারী স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আগে থেকেই বলে আসছিলেন, দেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়াতে সবার জন্য সহজ কিস্তিতে তা কেনার সুবিধা চালু করা দরকার।
এখন এই সুবিধা চালু করল গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক। এত দিন দেশে শুধু ক্রেডিট কার্ডধারী ব্যক্তিরাই কিস্তি–সুবিধায় নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় মুঠোফোন কিনতে পারছিলেন।
‘সিম লক’ পদ্ধতি চায় অপারেটররা
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় কিস্তিতে মুঠোফোন কেনার সুবিধা আছে। সেসব দেশে মোবাইল অপারেটররা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ‘সিম লক’ রেখে কিস্তিতে মুঠোফোন বিক্রি করে। এমনকি ভারতেও এই সুবিধা আছে।
কিস্তিতে কোনো অপারেটরের কাছ থেকে মুঠোফোন কেনা হলে তা পরিশোধের আগপর্যন্ত অন্য কোনো অপারেটরের সিম ব্যবহার করা যায় না ‘সিম লক’ পদ্ধতিতে।
দেশের মোবাইল অপারেটররা দীর্ঘদিন ধরে কিস্তিতে স্মার্টফোন বিক্রির সুবিধা চেয়ে এসেছে। তবে এ ক্ষেত্রে তারা ‘সিম লক’ পদ্ধতি চাইছিল।
‘সিম লক’ রেখে গ্রাহকের কাছে মুঠোফোন বিক্রি করা যাবে—প্রায় দুই বছর আগে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সেখানে শর্ত ছিল, মুঠোফোনের মধ্যে দুটি সিমের একটি লক রেখে বিক্রি করতে পারবে অপারেটররা। স্থানীয়ভাবে মোবাইল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে স্মার্টফোন কিনতে হবে। কিস্তির ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট হবে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। কিস্তি হবে ৩ থেকে ১২ মাস মেয়াদি। স্মার্টফোনের দাম পরিশোধের পর লক করা সিমের স্লটটি খুলে দিতে হবে।
আরও পড়ুনস্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে বাংলাদেশ ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪বিটিআরসি সূত্র জানায়, ‘সিম লক’ রেখে কিস্তিতে স্মার্টফোন বিক্রির ব্যাপারে দুটি শর্তের বিষয়ে সম্প্রতি আলোচনা ছিল। প্রথমত, অপারেটররা নিজেরা কোনো ভর্তুকি দিতে পারবে না। কারণ, এতে বাংলালিংক, টেলিটকের মতো অপারেটর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। তবে ভর্তুকির সুবিধা যদি রাখতেও হয়, সে ক্ষেত্রে তা ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, এ সুবিধা শুধু দেশে উৎপাদিত স্মার্টফোনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। উচ্চমূল্যের স্মার্টফোনে তা দেওয়া যাবে না।
তবে সূত্র জানায়, বিটিআরসি ‘ফোন লক’ পদ্ধতির মাধ্যমে কিস্তি–সুবিধার পক্ষে মত দেয়।
গত ২ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘দেশে সবার জন্য কিস্তিতে মুঠোফোন কেনার সুবিধা নেই’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অপারেটরদের বরাতে বলা হয়েছিল, একটি সিম উন্মুক্ত রেখে মুঠোফোন বিক্রি করলে অপারেটরের জন্য তা সুবিধাজনক নয়। কারণ, একটি সিম উন্মুক্ত থাকলে গ্রাহক তখন পছন্দের অপারেটরই ব্যবহার করবেন।
অপারেটরদের চাওয়া, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুটি সিম লক রেখেই মুঠোফোন বিক্রির সুবিধা চালু করা। আবার সিম লক রেখে মুঠোফোন বিক্রির ক্ষেত্রে ছোট অপারেটররা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে বলেও তাদের এ বিষয়ে আপত্তি আছে।
আরও পড়ুনক্রেডিট কার্ড ছাড়াই কিস্তিতে স্মার্টফোন কেনার সুযোগ দিচ্ছে বাংলালিংক১৫ মে ২০২৫জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই স ব ধ ফ ন ক নত পর শ ধ র ব যবহ র ব ট আরস র জন য গ র হক স ম লক লক র খ উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।