পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের চারা রোপণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে সরকার। গত ১৫ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বন-১ অধিশাখা থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু ঘাটাইলে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিতে এই প্রজ্ঞাপনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে। সমকালের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে প্রজ্ঞাপনের পরই লাগানো হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার আকাশমনির চারা। চলছে আরও নিষিদ্ধ গাছের চারা রোপণের প্রস্তুতি। নিষেধাজ্ঞা মানছেন না বন বিভাগ, নার্সারি ও সামাজিক বনায়নের অংশীজনরা।
ঘাটাইলে মোট বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। ৯০-এর দশকে ‘সামাজিক বনায়ন’ কর্মসূচি চালু করে বন বিভাগ। এই কর্মসূচির বলি হয় এখানকার প্রাকৃতিক বন। সামাজিক বনায়নের দখলে চলে গেছে প্রায় ১৫ হাজার একর প্রাকৃতিক বনভূমি। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কৃত্রিমতার ছোঁয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বন থেকে বিলুপ্ত অর্ধ শতাধিক দেশি প্রজাতির গাছ। বিলুপ্ত পশু-পাখি।
১৫ মে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার পূরণে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি পর্যায়ে আগ্রাসি প্রজাতির গাছ রোপণের পরিবর্তে দেশীয় ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করতে হবে। ঘাটাইলে এই প্রজ্ঞাপন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। স্কুল শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার নিষিদ্ধ করলেও বিট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বনের জমিতে সামাজিক বনায়নে প্রতিদিন লাগানো হচ্ছে আকাশমনির চারা।
সাগরদীঘি বিট অফিসের তথ্যমতে, সামাজিক বনায়নের আওতায় ৬০টি প্লটে গাছ লাগানোর কাজ চলমান। সরেজমিন দেখা গেছে, ৩০টি প্লটেই আকাশমনির চারা রোপণ করা হয়েছে। আয়তন ভেদে কোনো প্লটে এক হাজার, কোনো প্লটে ৫০০ চারা রোপণ করা হয়েছে। সামাজিক বনের স্থানীয় সভাপতি আব্দুল মজিদের নামে একটি এবং তাঁর দুই ছেলের নামে দুটি প্লট রয়েছে। মজিদ জানান, বিট কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করে একটিতে গামারি এবং দুটিতে আকাশমনির চারা রোপণ করেছেন। মোট দুই হাজার আকাশমনির চারা লাগানো হয়েছে।
দুটি প্লট বরাদ্দ পেয়ে ১০ দিন আগে এক হাজার আকাশমনির চারা রোপণ করেছেন সাগরদীঘির ফজরগঞ্জ গ্রামের আমিনুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য, প্রতিটি চারার দাম ধরা হয়েছে সাত টাকা। সাগরদীঘি বিট কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান আনসারীর দাবি, প্লটগুলোতে দেশীয় প্রজাতি গাছের চারা লাগানো হচ্ছে।
বটতলি বিটে বনের জমিতে আকাশমনির নার্সারি করেছেন স্থানীয় বনের সভাপতি রাজু মিয়া। তিনি বলেন, ‘আকাশমনির চারা নিষিদ্ধ। তবে পাবলিকের কাছে কিছু চারা বিক্রি করেছি।’
বটতলি বিটের ২২টি প্লটে চারা রোপণ প্রক্রিয়া চলমান। শনিবার সরেজমিন দেখা যায়, খাগরাটা আজমল হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে সামাজিক বনায়নের অংশীদার হাবিবুর রহমান আকাশমনির চারা রোপণ করছেন। ওই এলাকার অধিকাংশ প্লটেই লাগানো হচ্ছে নিষিদ্ধ গাছের চারা। এ বিষয়ে জানতে বটতলি বিট কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরিবেশবিদদের মতে, এই প্রজাতির গাছ মাটি থেকে অত্যধিক পানি শোষণ করে, ফলে মাটির আর্দ্রতা কমে যায় এবং শুষ্ক বা মৌসুমি জলবায়ু যুক্ত এলাকায় এটি ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়। এই গাছের পাতায় থাকা টক্সিন গোড়ায় পড়ে মাটিকে বিষাক্ত করে তোলে, যার ফলে উর্বরতা নষ্ট হয়। এগুলোর চারপাশে অন্য কোনো গাছ সহজে জন্মাতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শেফালি বেগমের ভাষ্য, মনুষ্যসৃষ্ট কোনো বনে পাখি ও প্রাণী বাস করতে পারে না। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়ন করায় বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় বৃক্ষ, পাখি ও প্রাণিকুল। ধ্বংস হচ্ছে বনের বাস্তুসংস্থান চক্র। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে প্রাকৃতিক বনের বিকল্প নেই।
ঢাবির মৃত্তিকা, পানি পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আখতার হোসাইন খান জানান, সামাজিক বনায়নের নামে এমন কিছু করা উচিত না, যা প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করবে। সামাজিক বনায়ন করতে হবে রাস্তার আশপাশে পতিত জমিতে। 
ঢাবির উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন বলেন, প্রাকৃতিক এই বনে প্রায় ১০ প্রজাতির বৃক্ষ ছিল। ছিল বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী। সামাজিক বনায়নে প্রকৃতিকে বিবেচনা করা হয়নি। জীববৈচিত্র্যকে বিবেচনা করা হয়নি। বিবেচনা করা হয়েছে গাছগুলো বড় হলে কেটে সরকার নেবে কিছু আর স্থানীয়রা নেবে কিছু। এভাবে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করায় বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়ে গেছে। বিদেশি বৃক্ষ আকাশমনি গাছের পাতা পড়লে জমি অনুর্বর হয়ে যায়। ফসল নষ্ট হয়ে যায়। আকাশমনি গাছ লাগানো যাবে না। যদি সামাজিক বনায়ন করতেই হয়, তবে দেশীয় বৃক্ষ লাগাতে হবে।
ধলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা সাব্বির হোসাইনের ভাষ্য, স্থানীয় পর্যায়ের সভাপতি-সম্পাদকদের সঙ্গে সভা করে নিষিদ্ধ গাছ রোপণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এর পরও কেউ এ ধরনের গাছ রোপণ করলে বরাদ্দ প্লট বাতিল করা হবে।
ঘাটাইলে বনের সভাপতি ইউএনও আবু সাঈদ বলেন, বনের জায়গায় কেউ নিষিদ্ধ গাছ রোপণ করলে আর তাঁর সঙ্গে বন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকলে চিহিৃত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন সমকালকে বলেন, আকাশমনি লাগানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোথায়ও লাগানো হলে তা তুলে দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানো হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ট কর মকর ত প র ক ত ক বন বন র জ পর ব শ ব স কর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বিভাজনের বিপরীতে মিলনের সাধনা

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ৫০ বছরের বেশি সময় আমরা পার করে এসেছি। এই সময়ে আমাদের চেনা পৃথিবী পাল্টে গেছে বিপুলভাবে। বিশেষভাবে যদি বিবেচনায় নিই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গতিপথ, তবে পরিবর্তন মনে হবে অবিশ্বাস্য, প্রায় যেন শ্বাসরুদ্ধকর। বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ত্বরিত জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তির এবং প্রযুক্তি পাল্টে দিচ্ছে মানুষের জীবন। বিজ্ঞানের কল্যাণে উৎপাদনশীলতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। এত বিপুল সম্পদ মানবসভ্যতা অতীতে আর কখনো উৎপাদন করেনি। সম্পদের বাহুল্য বাড়িয়ে দিয়েছে ভোগ ও অপচয়ের মাত্রা। তবে একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতা ‘উন্নত’ হিসেবে গণ্য হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধা ও সংশয় ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, ধর্মের সঙ্গে ধর্মের, সমাজের সঙ্গে সমাজের এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব–সংঘাত, অবিশ্বাস, ঘৃণা ও সহিংসতা ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে। এসব সংঘাতের পেছনে নানা কারণ সক্রিয় থাকলেও প্রায়ই দেখা যায় তা নিচ্ছে ধর্মীয় রূপ এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার হয়ে উঠছে সংঘাতের হাতিয়ার। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যবহৃত হচ্ছে ধর্ম তথা ধর্মের বিকৃতি। এক ধর্মের বয়ান হাজির করা হয় অপর ধর্মকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, সমাজে বিভাজন দাঁড় করিয়ে। বিভাজনের দ্বারা চিহ্নিত অপর যে সব সময় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, তা নয়। বিভক্তির চক্রাবর্তে তলিয়ে যাওয়া কলুষিত সমাজে নিজ ধর্মের মধ্যেও এমন ‘অপর’ তৈরি হয়। যার ফলে আমরা দেখি মাজারে আক্রমণ, বাউলদের আঘাত হানা, গানবাজনা বন্ধ, নিদেনপক্ষে পরিহার করা ইত্যাদি আচরণ। ‘অপর’ তৈরির কলুষ যে অমানবিকতা লালন করে চরম নৃশংসতা ঘটাতে পারে, তার উদাহরণ একাত্তরের বাংলাদেশ। বিশ শতকের ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুর মুসলিম নিধন ঘটেছে মুসলমানদের হাতেই। মিলনের আদর্শ সব সময় তাই অন্ধকার শক্তির চক্ষুশূল, যাদের আক্রমণের বড় লক্ষ্য হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রাদর্শ। বিভাজন চাপিয়ে দিতে ধর্মধারা ও সেক্যুলার বাইনারি নিয়ে চলে নানা খেলা, সেক্যুলার ও সেক্যুলারিজমের ফারাক মুছে দিয়ে ধর্ম ও সেক্যুলারিজমকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী করা হয়।

বিভক্তির চক্রাবর্তে তলিয়ে যাওয়া কলুষিত সমাজে নিজ ধর্মের মধ্যেও ‘অপর’ তৈরি হয়। যার ফলে আমরা দেখি মাজারে আক্রমণ, বাউলদের আঘাত হানা, গানবাজনা বন্ধ, নিদেনপক্ষে পরিহার করা ইত্যাদি আচরণ। ‘অপর’ তৈরির কলুষ যে অমানবিকতা লালন করে চরম নৃশংসতা ঘটাতে পারে, তার উদাহরণ একাত্তরের বাংলাদেশ।দুই.

কৃষ্ণ এই সময়ে আলোকের পথে যাত্রায় রিলিজিয়াস ও সেক্যুলারের মিলনক্ষেত্রগুলো শনাক্ত করা গুরুত্ব বহন করে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বহুত্ববাদের স্বীকৃতি যেমন স্বাভাবিক ও কাম্য, তেমনি দেখতে হবে সেক্যুলার চিন্তার প্রসারিত সীমানা, যা ধর্মসত্তার সঙ্গে মিলন-পরিসর তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলার সাংস্কৃতিক ধারা আমাদের জন্য প্রেরণা ও শক্তির আধার। এর তিন মহাপুরুষ লালন, নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ। বাংলার লোকধর্ম, লোক জীবনধারা ও লোকাচারের সাংগীতিক দার্শনিক রূপ ফুটে উঠেছে লালনের গানে সুরে পরম্পরায়। ধর্মাদর্শে তিনি গভীরভাবে প্রোথিত। তবে সেই ধর্মে মিলন-মিশ্রণ-সমন্বয়ের এমন গভীরতা যে তাঁকে বিশেষ ধর্মাবলম্বী হিসেবে চিহ্নিত করা দুরূহ। ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’—এই গানের যে বিস্তার ও গভীরতা, তা আমাদের অপার করে দেয়। ঔপনিবেশিক শাসনে পিষ্ট গ্রামের বাউল এই গান শোনাচ্ছেন দুনিয়াবাসীকে, জগৎজুড়ে জাতি–ধর্মের মধ্যে বিভেদ যাঁরা মেলে ধরেছেন তাঁদের কথার অসারতা, ‘জগৎ জুড়ে জাতের কথা, লোকে গল্প করে যথাতথা।’ এমন বিশ্বজনীন বিস্তারের পাশাপাশি যখন শুনি নিবিড় উচ্চারণ, ‘লালন বলে জাতের ফাতা/ ডুবাইছি সাধবাজারে’, তখন চমকে যেতে হয় বাণীর গভীরতায়। সাধবাজার বলতে যে ইঙ্গিতময়তা, সেটা তো আজকের পণ্যশাসিত ভোগবাদী সমাজের অন্তঃসারশূন্যতার পরিচয় দেয়। চিত্তের চেয়ে আমরা বিত্তে মজেছি বেশি, সাধকে করে তুলেছি বাজারি; বিসর্জন দিয়েছি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। এখানে মনে পড়ে তরুণ বাঙালি গবেষক কল্পলেখক নাসিমা সেলিমের বার্লিন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের কথা—ব্রিদিং হার্টস: সুফিজম, হিলিংস, অ্যান্টি-মুসলিম রেসিজম ইন জার্মানি। লেখক পোস্ট-সেক্যুলার স্পেসে রিলিজিয়াস ও সেক্যুলারের মিলনের উদাহরণ টেনেছেন এবং এই পরিসর তৈরিতে জার্মানিতে সাম্প্রতিক সুফিচর্চা বিশ্লেষণ করেছেন। তবে তাঁর বিশ্লেষণের আরেক মাত্রা লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন যে আধুনিক সমাজে মানুষ তো নানাভাবে পিষ্ট হচ্ছে, সভ্যতার পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপে জীবনের উপাচারের বাহুল্যের মধ্যে ধর্মীয় কিংবা সেক্যুলার, সবাই সমভাবে পীড়িত ও পিষ্ট, একই খাঁচায় বন্দী হয়ে মুক্তির আকুতি খুঁজছে। প্রাণের তাগিদ থেকে সাধবাজার ছাপিয়ে জীবনের সার্থকতা ও ফানা সন্ধানে সব মানুষের অন্তরের সংকট ও মুক্তির আকুতির রয়েছে অভিন্নতা। খোঁজার পথরেখা হয়তো ভিন্ন, কিন্তু ফানার আকাঙ্ক্ষায় কোনো ফারাক নেই, সেটাই তৈরি করে মিলনক্ষেত্র।

বাংলার সাংস্কৃতিক ধারা আমাদের জন্য প্রেরণা ও শক্তির আধার। এর তিন মহাপুরুষ লালন, নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ। বাংলার লোকধর্ম, লোক জীবনধারা ও লোকাচারের সাংগীতিক দার্শনিক রূপ ফুটে উঠেছে লালনের গানে সুরে পরম্পরায়। ধর্মাদর্শে তিনি গভীরভাবে প্রোথিত।

লালন নিয়ে যেমন দেখা দেয় ধন্ধ, একই সংকটে আমরা পড়ি নজরুলের ধর্মাদর্শ নিয়ে। বাংলার মুসলমানদের সঞ্জীবনী ইসলামি গান শোনাতে তাঁর তুলনীয় কেউ নেই। শ্যামা মায়ের চরণবন্দনাতেও তিনি অদ্বিতীয়, আবার হিন্দু-মুসলিম মিলনের আকুতি তাঁর চেয়ে প্রবলভাবে আর কেউ প্রকাশ করেননি। তাঁর ইসলামি গান প্রকৃত অর্থে জাগরণী গান, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাংগীতিক প্রতিবাদ, যেমন শ্যামাসংগীতে আছে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি আহরণের তাগিদ। তাঁকে নিয়ে সংশয় জেগেছিল মুসলমানদের মধ্যে, প্রশ্ন তুলেছিল কেউ কেউ, ‘লোকটা কাফের না শয়তান?’ ধন্ধ তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়েও, পোশাকি অর্থে তিনি ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী, ছিলেন ধর্মাচার ও প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরোধী। আবার গীতাঞ্জলি তো বটেই, তাঁর গান বহুভাবে বিবেচিত হয়েছে ঈশ্বর-বন্দনার সংগীত হিসেবে। গীতবিতান–এ তিনি নিজেও ধোঁয়াশা তৈরি করেছেন এই গানের ডালিকে ‘পূজা’ পর্যায়ের পাঠ হিসেবে চিহ্নিত করে। এই পূজা যে প্রচলিত কিংবা কোনো বিশেষ ধর্মীয় অর্থে নয়, সেটা অনেক সময় গুলিয়ে ফেলা হয়। সর্বোপরি জীবনদেবতা বলতে কোন সত্তার বাস তাঁর অন্তরে, তা তলিয়ে দেখা হয় না। জীবনের শেষ লেখায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা ভাষার সুপণ্ডিত, ইসলামি দর্শনে পারঙ্গম, রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘সুফি’ হিসেবে, তাঁর রচনার সঙ্গে পারস্যের কবি হাফেজের জীবনদর্শন এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। তাই দেখা যায়, ইতিহাসের ধারায় পোস্ট-সেক্যুলার স্পেস বঙ্গীয় সমাজে প্রাকৃতিকভাবেই প্রোথিত রয়েছে, ধর্মের সমন্বয় পেয়েছে স্বাভাবিকতা, যেই উদার পরিসরে মিলন হয় সবার।

ধর্মাদর্শের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার যে বিভাজন আরোপ করা হয়, সেখানে স্বাভাবিকতা নেই, আছে বিকৃতি। যে কারণে এমন বিভাজনের পক্ষে যাঁরা অবস্থান নেন, ফারাক প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হন, তাঁদের মানসে সহিংসতার উপাদান সহজ আশ্রয় পায়। এর বিপরীতে সমাজে বহাল থাকে সম্প্রীতির নানা উপাদান, যেখানে ভালোবাসার নিবিড়তা ও প্রেমধর্মের প্রাধান্য প্রতিফলিত হয়। সেক্যুলার মতাদর্শের ধারকদের মধ্যে স্পিরিচুয়ালিটি কিংবা বৃহত্তের অভিঘাত, ভিন্নতরভাবে হলেও, প্রতিফলিত হওয়া সম্ভব এবং বাস্তবও বটে। অভ্যস্ত চিন্তায় বদ্ধ থেকে মতাদর্শের কাঠামোতে আটকে থাকার প্রবণতায় আমরা অনেক সময় সেই বিচারে প্রবৃত্ত হই না। তালাত আসাদ সে জন্যই বলেছিলেন যে সেক্যুলারিজম হচ্ছে জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রপঞ্চ, আর সেক্যুলার হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনা। দুইয়ের যাত্রাপথ ভিন্ন, তাই দুইকে একীভূত করে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো সংগত নয়। বস্তুবাদী দর্শন কিংবা বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উভয়ের সম্মিলন সম্ভব, তেমন পোস্ট-সেক্যুলার স্পেসের অনেক উদাহরণ রয়েছে জীবনে। যেমন বলা যায় জনপ্রিয় মাজারসংগীত মাইজভান্ডারি গানের কথা, মাওলার বিদ্যাপীঠে মারফতি যে শিখন পদ্ধতি, আত্মগত পাঠ গ্রহণ, সিনায় সিনায় লেখাপড়া, অন্তরের হৃৎস্পন্দনের মধ্যে বাহিরের জীবনছন্দ অনুভব, সেই সাধনা সহজ নয়। সুফিতত্ত্বের গহিনে প্রবেশ করে সাম্যবাদী কবিয়াল রমেশ শীল লিখেছিলেন শ্রেষ্ঠ এসব মাজারসংগীত, তিন শতাধিক উপাসনার গান, যেখানে মানবের মহিমা কীর্তন ছাপিয়ে যায় আমাদের গড়া কৃত্রিম বিভেদরেখা বা বাইনারি কনস্ট্রাকশন। এসব গানের গূঢ়ার্থ ব্যাখ্যা সহজ নয়। রমেশ শীল লিখেছেন, ‘আলস্তে বেরব্বেকুম, স্মরণে নি আছে/ “কালু বালা” বলে এলে, এখন কেন পাশরিলে?’

এমনই মিলন-আকুতি আমরা দেখি বাঙালি সত্তায়, খাঁচার ভেতর অচিন পাখির গানে। ইতিহাসের ধারায় তৈরি হয়েছে বাঙালি জীবনে সমন্বয় ও সম্প্রীতির এমন অবয়ব, যা আমাদের পথের সঞ্চয়। হিংসা, উগ্রতা, হানাহানি পেরিয়ে শান্তির পরিসর নির্মাণের মালমসলা এখানেই মিলবে।

মার্ক্সবাদ ও স্পিরিচুয়ালিটির মিলনের অনন্য উদাহরণ আমরা দেখি বিশ শতকের সাম্যবাদী আন্দোলনের বিশিষ্ট সত্তা রোজা লুক্সেমবার্গের জীবনে। জার্মান এই নারীর তাত্ত্বিক অবদান ও রাজপথের আন্দোলন, উভয়ই বিপ্লবের প্রতীক হয়ে রয়েছে। তিনি রুশ বিপ্লবের বিজয়ে উদ্বেলিত হয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের আদর্শে জার্মানিতে শ্রমিক শ্রেণির বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটাতে সচেষ্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও বিপ্লবের পর রাশিয়ায় প্রলেতারিয়েতের হাতে সব ক্ষমতা অর্পণ-সূত্রে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা তাঁকে পীড়িত করেছিল। ১৯১৯ সালে বন্দী অবস্থায় তাঁর লেখা পত্রাবলি রাজনৈতিক সাহিত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, একই সঙ্গে তা বিপ্লবী মানসের গহিন পরিচয় মেলে ধরে। কারাবন্দী রোজা লুক্সেমবার্গ বুঝি দেখতে পেয়েছিলেন আসন্ন মৃত্যুর ছায়াপাত। বন্ধুকে লিখেছিলেন তাঁর সমাধিফলকের ওপর কোন বাণী তিনি খোদিত দেখতে চান। তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেখানে লেখা থাকবে কেবল দুটি শব্দ, ‘ৎস্ভি, ৎস্ভি’, পাখির ছোট্ট কিন্তু তীক্ষ্ণ দুই ডাক। কোনো বিপ্লবী বাণী নয়, কোনো প্রার্থনা নয়, বিপ্লব আর প্রার্থনার জীবনবাদী বিস্তার নিয়ে এ ছিল তাঁর আজীবন সাধনার সারসত্য, যেন বুঝিয়ে দেয় মানব-অস্তিত্বের মাহাত্ম্য, মনে দোলা দেয়, হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনোখানে। নীলবর্ণ টিটমাউজ পাখির ডাক অনুকরণ করতে পারতেন রোজা লুক্সেমবার্গ। বাল্যকালে এমন শখ তো অনেকেরই থাকে—বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো; গাছপালা, ফলফুল, পশুপাখির সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে ধরা পড়া, যার থেকে তিনি কখনো মুক্তি পাননি, মুক্তি চাননিও। সেই অন্তরাত্মা ‘রেড রোজা’র জীবনান্তে আবারও টংকার তোলে। তিনি লিখেছেন, ‘এই পাখির ডাক, যা একাধারে স্বচ্ছ ও তীক্ষ্ণ, যেন ইস্পাতের এক ঝকঝকে সুচ, জড়ো করে আরও পাখিদের। কয়েক দিন যাবৎ চারপাশে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে, পাতার হালকা মর্মর শোনা যাচ্ছে। তুমি কি জানো বন্ধু এর অর্থ কী? এ হচ্ছে বসন্তের আগমনের প্রথম আভাস—জমাটবাঁধা বরফ ও তুষারের মধ্যে, একাকিত্বের মধ্যে, আমার মনে হয় টিটমাউজ পাখি ও আমি হচ্ছি বসন্তের আগমনীর বার্তা।’

তবে জীবন তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি, তাঁর কমরেডরাও তাঁকে বুঝতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। অচিরেই বিচারের নামে প্রহসন করে রাষ্ট্রশক্তি তাঁকে হত্যা করে। বার্লিনের ফ্রেডরিশফিল্ড কবরস্থানে তাঁর সমাধিফলক সংক্ষিপ্ত—লেখা হয়েছে ‘রোজা লুক্সেমবার্গ—মার্ডার্ড’। দুটো বার্তাই সঠিক, একটিতে লেখা হয়েছে জীবনের বাস্তব সত্য, আরেকটিতে বাস্তবের সীমানা পেরোনো সত্য। এই লেখা-অলেখার দেখা-অদেখার যুগলবন্দী ছাড়া ‘রেড রোজা’কে পূর্ণতায় বোঝা সম্ভব হবে না।

এমনই মিলন-আকুতি আমরা দেখি বাঙালি সত্তায়, খাঁচার ভেতর অচিন পাখির গানে। ইতিহাসের ধারায় তৈরি হয়েছে বাঙালি জীবনে সমন্বয় ও সম্প্রীতির এমন অবয়ব, যা আমাদের পথের সঞ্চয়। হিংসা, উগ্রতা, হানাহানি পেরিয়ে শান্তির পরিসর নির্মাণের মালমসলা এখানেই মিলবে। সংঘাত বিভাজন সহিংসতা-দীর্ণ বাস্তবতায় নানা ধর্মানুসারী কিংবা সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী মানুষ নিজ নিজ জীবনের অনিশ্চয়তা অন্তঃসারশূন্যতা মোচনের তাগিদ খুঁজে ফিরবে আপন অন্তরের প্রেরণায়, যে আত্মানুসন্ধান তাঁদের নিয়ে যাবে লালনের কাছে, মিলনের পরিসরে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ