বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র বিদ্রোহী আন্দোলন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে। তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম হামলার প্রায় চার দশক পর কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) তাদের সংগঠন ভেঙে দেওয়ার এবং অস্ত্র পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে শুধু তুরস্ক নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোচড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। 

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে আবদুল্লাহ ওজালানের নেতৃত্বে পিকেকে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। সংগঠনটি শুরু থেকেই একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছিল। পাশাপাশি তুরস্কে বসবাসকারী কুর্দিদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করাও তাদের উদ্দেশ্যের অংশ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কিছু অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পিকেকের নেতাদের সহিংসতা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। 

প্রথমে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকানো যাক। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইতিমধ্যেই দুটি মেয়াদ শেষ করেছেন এবং তিনি তৃতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে চান। এ জন্য তাঁকে তুরস্কের সংবিধান সংশোধন করতে হবে অথবা পার্লামেন্টকে আগাম নির্বাচনের জন্য রাজি করাতে হবে। এই দুটি পথেই তাঁর সরকারের অতিরিক্ত রাজনৈতিক সমর্থন দরকার। এই সমর্থন বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট—জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এবং কট্টর জাতীয়তাবাদী দল ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি (এমএইচপি) দিতে পারছে না। 

সমর্থনের এই ঘাটতি পূরণ করতে পারে তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম দল পিপলস ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি পার্টি (ডিইএম)। দলটি কুর্দিপন্থী। 

আন্তর্জাতিক পটভূমিও পিকেকের এই আত্মবিলুপ্তির সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রেখেছে। গত ডিসেম্বর মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হন। আসাদ তুরস্ককে দুর্বল করতে পিকেকে যোদ্ধাদের ব্যবহার করতেন। কিন্তু আসাদ সরকারকে উৎখাত করে সিরিয়ায় এখন যে নতুন সরকার এসেছে, তারা পিকেকের প্রতি আসাদের মতো সহানুভূতিশীল নয়। পিকেকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যে সংগঠনগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র এত দিন মদদ দিয়ে এসেছে, তাদের কাছ থেকেও যুক্তরাষ্ট্র এখন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। পিকেকের সহযোগী সংগঠনগুলো একসময় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। 

পিকেকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত তুরস্কের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিয়েছে। পিকেকের সন্ত্রাসবাদ থেকে সদ্য পাওয়া মুক্তিকে ধরে রাখতে হলে, তুরস্কের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই প্রচেষ্টা শুধু তুরস্কের জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে পারে। এটি দেখাতে পারে যে রাজনৈতিক বিদ্রোহ বা সহিংসতা বন্ধ হলে তা দীর্ঘস্থায়ী ও অংশগ্রহণমূলক শান্তির পথ তৈরি করতে পারে। 

সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি গোষ্ঠীগুলোকে, বিশেষ করে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসকে (এসডিএফ) প্রায় নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করলেই ভালোভাবে রক্ষা করা সম্ভব। আরেকটি বিষয়, যেটি খুব একটা আলোচিত হয় না; কিন্তু পিকেকের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে, সেটি হলো তুরস্কের সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে ড্রোনপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার। বিশেষ করে, এই ড্রোন দিয়ে তুরস্ক পিকেকের শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে, এমনকি ইরাকের গভীর অঞ্চলেও। 

এর ফলে পিকেকের সামরিক ও কৌশলগত কার্যক্ষমতা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি হয়তো তাদের বাধ্য করেছে পুরো বিদ্রোহী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে। এসব কারণ মিলিয়ে তুরস্কের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে সহিংসতার পথ ছাড়াই কুর্দি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যেতে পারে। তবে অস্ত্রের যুগ থেকে শান্তি ও সংহতির যুগে সফলভাবে প্রবেশ করতে হলে এরদোয়ানের সরকারকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে। 

প্রথমত দরকার স্বচ্ছতা। পিকেকে বহু বছর ধরে সহিংসতা চালিয়ে এসেছে, ফলে তুরস্কের সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি ক্ষোভ স্বাভাবিক। তাই তুরস্ক সরকার ও পিকেকের মধ্যে যে আলোচনা হবে, তা স্পষ্টভাবে ও খোলাখুলি প্রকাশ করা খুব জরুরি। বিশেষ করে পিকেকেকে কোন বিষয়ে ছাড় দেওয়া হবে, সেটা মানুষকে জানানো দরকার। যেমন সিরিয়ার সশস্ত্র সংগঠন ওয়াইপিজি যেটি পিকেকের সঙ্গে সম্পর্কিত—তারা অস্ত্র ছাড়বে কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন। এই প্রক্রিয়া খুব সংবেদনশীল, তাই এতে তুর্কি পার্লামেন্ট, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত। 

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো গণতন্ত্র। এই ঐতিহাসিক শান্তির সুযোগ তখনই সফল হবে, যদি তা প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে হয়—যার মধ্যে থাকবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা এবং মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা আরও জোরদার করার মতো কার্যকর পদক্ষেপ। 

এরদোয়ানের সরকার চাইলে এ বিষয়ে দ্রুত কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের সাম্প্রতিক আদেশ মেনে কুর্দি রাজনৈতিক নেতা সেলাহাত্তিন দেমিরতাশকে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে একটি বড় বার্তা দেওয়া সম্ভব। যখন ওজালানকে মুক্তির চিন্তা হচ্ছে, তখন সরকারের উচিত অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের বিষয়েও খেয়াল রাখা। যেমন ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলু ও ভিক্টোরি পার্টির নেতা উমিত ওজদাগের অবস্থার দিকেও নজর দেওয়া দরকার। 

পিকেকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত তুরস্কের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিয়েছে। পিকেকের সন্ত্রাসবাদ থেকে সদ্য পাওয়া মুক্তিকে ধরে রাখতে হলে, তুরস্কের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই প্রচেষ্টা শুধু তুরস্কের জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে পারে। এটি দেখাতে পারে যে রাজনৈতিক বিদ্রোহ বা সহিংসতা বন্ধ হলে তা দীর্ঘস্থায়ী ও অংশগ্রহণমূলক শান্তির পথ তৈরি করতে পারে। 

সিনান উলগেন ইস্তাম্বুলভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইডামের পরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য একট ত রস ক র স র জন ত ক ব শ ষ কর এরদ য় ন য র জন দরক র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আইফোন থেকে স্যাটেলাইটে জরুরি বিপদবার্তা পাঠিয়ে জীবন বাঁচালেন এক পর্বতারোহী

বিপদে পড়লে প্রযুক্তি যে জীবন রক্ষা করতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো অঙ্গরাজ্যে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা তার উদাহরণ। সম্প্রতি দুর্গম এক পর্বত থেকে নামার সময় ১০ হাজার ফুট উঁচুতে আহত হন এক পর্বতারোহী। সে সময় ফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় তিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। এরপর আইফোনের স্যাটেলাইট এসওএস সুবিধা কাজে লাগিয়ে জরুরি বিপদবার্তা পাঠান তিনি। আইফোন থেকে পাঠানো জরুরি বিপদবার্তায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যবহারকারীর অবস্থানের তথ্য যুক্ত থাকায় উদ্ধারকারীরা সহজে তাঁকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। ফলে প্রাণে বেঁচে যান সেই পর্বতারোহী।

৫৩ বছর বয়সী ওই পর্বতারোহী স্নোমাস পর্বতশৃঙ্গে অভিযান চালাচ্ছিলেন। সফলভাবে শৃঙ্গে পৌঁছানোর পর তিনি নিচে নামার জন্য ‘গ্লাইডিং’ নামের একধরনের কৌশল অবলম্বন করেন। এ পদ্ধতিতে সাধারণত পর্বতারোহীরা নিয়ন্ত্রিতভাবে ও দ্রুত নিচে নামেন। কিন্তু নামার সময় একটি দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। গুরুতর আঘাতের কারণে তিনি আর চলাফেরা করতে পারছিলেন না। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। এমন এক পরিস্থিতিতে আইফোনের স্যাটেলাইট এসওএস সুবিধার মাধ্যমে তিনি স্যাটেলাইট সংযোগ ব্যবহার করে পরিবারের একজন সদস্যকে বার্তা পাঠান। বার্তা পাওয়ার পরপরই দ্রুত উদ্ধারকারী দল সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে নিকটবর্তী শহরে নিয়ে আসে।

অ্যাপল ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইফোন ১৪ সিরিজের মাধ্যমে স্যাটেলাইট এসওএস সুবিধা চালু করে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দুর্গম অঞ্চল বা নেটওয়ার্কবিহীন স্থান থেকেও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জরুরি বার্তা পাঠানো সম্ভব। গ্লোবাল স্টার নামের একটি স্যাটেলাইট প্রতিষ্ঠান এই সেবা পরিচালনা করে থাকে।

সূত্র: নিউজ১৮

সম্পর্কিত নিবন্ধ