১৯ শয্যার ভবনে চলে ৫০ শয্যার ঘিওর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নানা সংকট-ভোগান্তি
Published: 26th, May 2025 GMT
বেলা তখন ১১টা। মেয়ের পেটব্যথা নিয়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছেন রসুলপুর গ্রামের গৃহবধূ ডলি বেগম। চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা দেন। সেগুলো করাতে প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে জানতে পারেন, পরীক্ষা করা সম্ভব নয়—যন্ত্র বিকল। হতাশ হয়ে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালের গেটের সামনের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে যান তিনি।
এই চিত্র মানিকগঞ্জের ৫০ শয্যার ঘিওর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। অল্প জায়গা, বিকল যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক ও জনবলসংকটে প্রতিদিনই কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা।
৫০ শয্যার হাসপাতালে অবকাঠামো ১৯ শয্যার১৯৮২ সালে স্থাপিত এই কমপ্লেক্সে আগে ছিল ৩১ শয্যার একটি দোতলা ভবন। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয় এবং নতুন করে তিনতলা একটি ভবন নির্মিত হয়। কিন্তু পুরোনো ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দুই বছর আগে ভেঙে ফেলা হয়। ফলে বর্তমানে শুধু ১৯ শয্যার নতুন ভবনেই পুরো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম চলছে।
এতে চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন জরুরি ও বহির্বিভাগে আসেন ২০০ থেকে ২৫০ জন রোগী। ভর্তি হন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন। কিন্তু স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক সময় রোগীদের মেঝেতে রাখতে হয়। এ তথ্য জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা বিপুল রায়।
জনবলসংকট চরমে৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হলেও এখনো ৩১ শয্যার জনবলকাঠামো অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ১৭ জন চিকিৎসক প্রয়োজন, আছেন ১৪ জন। মেডিসিনের কনসালট্যান্ট পদে নিযুক্ত চিকিৎসক সংযুক্তিতে মানিকগঞ্জে আছেন। অবেদনবিদের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। মেডিকেল অফিসার পদে ৪ জনের জায়গায় আছেন ৩ জন। এর বাইরে তৃতীয় শ্রেণির ৭০টি পদের মধ্যে ২৩টি শূন্য। আর চতুর্থ শ্রেণির ২৩টি পদের মধ্যে ১২টি শূন্য। জনবল ঘাটতির কারণে চাপ বাড়ছে, রোগীরা পাচ্ছেন না প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা।
যন্ত্রপাতি আছে, সচল নেইঅস্ত্রোপচার কক্ষ ২০১৮ সালে উদ্বোধন করা হলেও চালু হয়নি। এক্স-রে মেশিন অ্যানালগ, কিন্তু কক্ষ না থাকায় ব্যবহারযোগ্য নয়। প্যাথলজি যন্ত্রটি প্রায় দুই মাস ধরে নষ্ট হয়ে আছে। ফলে রক্ত, প্রস্রাবসহ অধিকাংশ পরীক্ষা বন্ধ। এ বিষয়ে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট তাপস কুমার বসাক বলেন, প্রায় দুই মাস আগে প্যাথলজি যন্ত্রে ত্রুটি দেখা দেয়। এ কারণে অধিকাংশ প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা বন্ধ।
সরেজমিনে যা দেখা গেলরোববার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলা ভবনের এক পাশে পুরুষ এবং আরেক পাশে নারী ওয়ার্ডে গাদাগাদি করে রোগীরা ভর্তি আছেন। অনেকের সঙ্গে আসা স্বজনেরা বসে আছেন মেঝেতে।
অপারেশন থিয়েটারের দরজায় তালা ঝুলছে। প্যাথলজি কক্ষ ফাঁকা, পরীক্ষা বন্ধ। তিনটি ছোট কক্ষে চলছে প্রশাসনিক কার্যক্রম।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালের চোখের চিকিৎসকের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন রোগী চিকিৎসার জন্য বসে আছেন। দুজন জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স তাঁদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।
চোখের চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যান উপজেলার বেগুন নার্চি গ্রামের বৃদ্ধা রেণু বেগম (৬০)। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স রাবেয়া সুলতানা তাঁকে চশমা দেন।
এ নিয়ে জানতে চাইলে রাবেয়া সুলতানা বলেন, হাসপাতালে চক্ষু চিকিৎসক নেই। রোগীদের চোখের চিকিৎসায় কম্পিউটারে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞ ব্যবস্থাপত্র দেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী রোগীদের ছোট সমস্যার চিকিৎসায় তাঁরা সহযোগিতা করেন। জটিল সমস্যা হলে জেলা সদর হাসপাতাল বা মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
প্রসূতিদের দুর্ভোগ বেশিঅবেদনবিদ না থাকায় হাসপাতালে কোনো অস্ত্রোপচার হয় না। ফলে অন্তঃসত্ত্বা নারী বা দুর্ঘটনার শিকার রোগীদের পাঠাতে হয় জেলা সদর হাসপাতালে বা বেসরকারি ক্লিনিকে।
উপজেলার আশাপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন বলেন, সম্প্রতি তাঁর গ্রামের এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। তবে অস্ত্রোপচার না হওয়ায় তাঁকে জেলা সদরে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। এতে ভোগান্তির পাশাপাশি রোগীর স্বজনদের বাড়তি খরচ হয়।
সার্বিক বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসিব আহসান বলেন, পুরোনো ভবনটি ভেঙে ফেলার পর সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। ভবন ও জনবলসংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা ঠিকভাবে দেওয়া যাচ্ছে না। এরপরও রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন ভবন নির্মাণ ও শূন্য পদ পূরণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স ম ন কগঞ জ চ ক ৎসক প য থলজ পর ক ষ উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বাস্থ্যসেবা: ডা. ধনদেব
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেমিনারে যোগ দিতে আসা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আবু জাফরের সঙ্গে তর্কে জড়ানোর কারণ জানিয়েছেন চিকিৎসক ধনদেব চন্দ্র বর্মণ। তিনি দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মন্তব্য করেন— উদ্ভট এক উটের পিঠে চলছে স্বাস্থ্যসেবা।
ডা. ধনদেব চন্দ্র বর্মণ বলেছেন, “আমরা সব সময় মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি যে, কোনো দুর্ঘটনা যেন না ঘটে। গত ২০২৩ সালের আগস্ট মাস থেকে আমি এখানে (ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) আছি। এ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা, কারো সঙ্গে মিসবিহেভ, ক্যাজুয়ালটিতে ভাঙচুর বা এরকম কিছু হয়নি। আমি খুব সুষ্ঠুভাবেই পরিচালনা করছি। আমাদের পরিচালক স্যার, সহকারী পরিচালক স্যার এবং ডেপুটি ডিরেক্টর স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা খুব সুন্দরভাবেই চালাচ্ছি। ডিজির কাছ থেকে গুরুজনের মতো ব্যবহার আশা করেছিলাম। কিন্তু, তিনি এসে সমস্যা জানতে না চেয়ে ভেতরে কেন টেবিল, এ নিয়ে কথা বলেন।”
তিনি বলেন, “আমি তিনবার উনাকে নাম বলার পরও উনি আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলছিলেন। আমার কিন্তু চাকরি বেশি দিন নাই। আর এক বছর পরেই আমি পিআরএলে চলে যাব। আমি অনেক সিনিয়র— ২০১৩-তে আমি এমএস করছি, আমাকে ২০২৫-তে সহকারী অধ্যাপক বানাইলো। জেনারেল সার্জারিতে অপারেশন থিয়েটারে, হাসপাতালের ভেতরে কোনো অপারেশন করার সৌভাগ্য এখনো আমার হয়নি বা দুর্ভাগ্য হয়নি। যেটাই হোক, এই যে প্রেক্ষাপট, এটার জন্য দায়ী, আমি মনে করি, কর্তৃপক্ষের অবহেলা। মানে আমাদের এরকম আরো ম্যানপাওয়ার আছে, যেগুলো আমরা কাজে লাগাইতে ব্যর্থ। সঠিক লোককে সঠিক জায়গায় কাজে আমরা দিতে পারি না।”
ডা. ধনদেব চন্দ্র বর্মণ বলেন, “আমার গাইনি ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার এখানে, আবার জেনারেল আছে। তার উচিত গাইনি ডিপার্টমেন্টে কাজ করা। এগুলো মিসম্যানেজমেন্ট। আসলে কী বলব, স্বাস্থ্যসেবাটা পুরাটাই একটা উদ্ভট উটের পিঠে চলতেছে। এরকম মনে হয় আমার কাছে। হ্যাঁ, আমি সাব-সেন্টার থেকে এ পর্যন্ত উঠে আসছি। সাব-সেন্টারে দেখি, যেকোনো ওষুধপত্র চুরি হয়ে যায়। টিএইচ-এ সিভিল সার্জন দেখে, এরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না, যেকোনো কাজ করতে গেলে পয়সা দিতে হয়। সব জায়গায় দুর্নীতি, এসব চিন্তা-ভাবনা করে আমার আসলে কাজ করার আর মানসিকতাই নাই। আমি সাসপেনশন চাই। আমি সরকারি চাকরি করতে চাই না। এদের চালানোর মতো মন-মানসিকতা নাই। স্বাস্থ্যসেবাটা পুরাটাই একটা উদ্ভট অবস্থায় চলতেছে। আর স্বাস্থ্য নিয়ে যারা রাজনীতি করে, পলিটিক্স করে; তারাও পলিটিক্সের সময় এসে খোঁজ নেয়, তারপর আর কোনো আলোচনা হয় না।”
“এসব নিয়ে আর গবেষণাও এ দেশে সঠিকভাবে হয় না। ফলস একটা জায়গা নীলক্ষেত, ওখানে সবাই রিসার্চ পেপার জমা দেয়, জমা দিয়ে এগুলো করে। সত্যিকারের কোনো রিসার্চই হয় না, সম্পূর্ণটাই একটা ভ্রান্তির মধ্যে চলতেছে স্বাস্থ্যসেবা। এজন্য আমি এগুলো দেখে খুব ত্যক্ত-বিরক্ত। এই লোককে (ডিজি) আমি গুরুজনের মতো মনে করছিলাম, যে আমাদেরকে গাইডলাইন দেবে। উনি এসে বলে যে, এটা কী, সেটা কী, টুল কেন নাই? উনি এসে বলত, আপনার কী কী দরকার; তাহলে আমি বলতাম যে, স্যার, আমাদের এরকম দরকার। তাহলে আমরা আরো আপগ্রেডেডভাবে কাজটা করতে পারি।”
“আমি প্রতিদিন আসি, দিন-রাত আসি। কোনো সমস্যা হলে রাত ৩টা থেকে ৪টার দিকে ছুটে আসি। এগুলো কোনো মূল্যায়ন হয় না। উনি বায়োমেট্রিক নিয়ে চিন্তা করেন। বায়োমেট্রিক দিয়ে আমাদের কী হবে, ২৪ ঘণ্টাই আমরা আসি। ২৪ ঘণ্টায় আমরা রিলেটেড থাকি। আমারে বিহেভ শিখান? আমার লাইফ শেষ। এখন আমার চাকরি শেষের দিকে। আজকে আমার ফ্রেন্ড সবাই প্রফেসর হয়ে গেছে বিভিন্ন সেক্টরে। আমার বিভিন্ন কারণে হয়নি— ট্রেনিং, পোস্ট পাইতে পাঁচ বছর দেরি করতে হইছে আমাকে। ডিজি অফিসের ডিজি দেখায় যে, আপনি যান নেতাকে ধরেন। নেতাকে ধরে ট্রেনিং পোস্ট নেন। এই ধরনের কথাবার্তা ডিজি অফিস থেকে শুনতে হয়। এজন্য আমার চাকরি আমার সাসপেনশন হলে আমি খুশি হই,” বলেন ডা. ধনদেব চন্দ্র বর্মণ।
গত শনিবার (৬ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে জরুরি বিভাগের ক্যাজুয়ালটি ইনচার্জ ডা. ধনদেব চন্দ্র বর্মণের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ইনচার্জের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ডা. ধনদেব চন্দ্র বর্মণকে। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অসদাচরণের ঘটনায় তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ডা. ধনদেব বর্মনের পরিচিত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি ময়মনসিংহ শহরে থেকে বিভিন্ন ক্লিনিকে অপারেশন করার সুবিধা নেওয়ার জন্য আগে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেননি। পদোন্নতির একটি ক্রাইটেরিয়া হলো বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন জমা দেওয়া। সেক্ষেত্রেও তার অবহেলা ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অবহেলা করে ডা. ধনদেব ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করেননি, ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষায় পাস করেননি, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষাই দেননি। পদোন্নতির ক্রাইটেরিয়াগুলো তিনি পূর্ণ করেননি। তাই, আওয়ামী সরকার তাকে পদোন্নতি দেয়নি। এই অন্তবর্তীকালীন সরকার তাকে ইনসিটু পদোন্নতি দিয়েছে। চলতি বছরের ২৯ জুলাই তিনি সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান।
ঢাকা/মিলন/রফিক