ঢাকা শহরকে নিয়ে বহু কবি-সাহিত্যিকের রয়েছে নানা কল্পনা ও জল্পনা। কারও কারও লেখায় বেশ রোমান্টিক সব গল্পও উঠে এসেছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে এই শহরের যে রূপ পরিগ্রহ করেছে, তাতে কল্পনায় বীভৎস চিত্রটাই ধরা পড়ে। গতকাল বাংলা একাডেমি থেকে তেজগাঁও আসতে সময় লেগেছে এক ঘণ্টার বেশি!
গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণ বিভিন্ন কারণে রাস্তায় নেমে পড়ছে, বিক্ষোভ করছে। কয়েক দিন ধরে নগর ভবনের সামনে মেয়র পদে নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করে চলেছে। শাহবাগ মোড়ে ছোট ছোট দল হয়ে সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে কিছু তরুণকে মিছিল করতে দেখা গেছে। আবার কোথাও কোথাও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। এসব কিছু মিলিয়েই ঢাকা নগর যেন বিক্ষোভ, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তার শহর।
জীবনানন্দ দাশ পূর্ববঙ্গের রূপ দেখে লিখেছিলেন, ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও– আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব’। বর্তমানে ঢাকা নিয়ে এমন কবিতা লেখা কোনো কবির পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ঢাকা এখন যন্ত্রণার নগর হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে যন্ত্রণার কাব্য হয় না।
দু-দুটো সিটি করপোরেশন। রাজউকের মতো নানামুখী প্রতিষ্ঠান। অন্তত কয়েক দশক ধরে আমরা বিকেন্দ্রীকরণসহ উন্নয়নের বহু বুলি শোনে আসছি; কিন্তু ঢাকাবাসীর জীবনে দিন দিন অবনতিই ঘটেছে। আমরা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে ঢাকার ওপরই জোর দিয়েছি। নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, অফিস, আদালত– সবকিছুর কেন্দ্র হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলেছি। অন্যদিকে, অন্যান্য শহরের যত চাপ ও তাপ সবই ঢাকার ওপর এসে পড়েছে। এতে আমরা ঢাকাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ধ্বংস করেছি প্রাণ, প্রকৃতি, নদী, নালা।
আনাচে-কানাচে নির্মাণ করেছি বহুতল ভবন। এসব ভবনে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা; কিন্তু ভবনগুলোরই নেই যথাযথ নিরাপত্তাবলয়। এমনকি বহু প্রতিষ্ঠান ও ভবন নিয়মের বালাই না করে গড়ে উঠেছে, তবুও এগুলো দিব্যি টিকে আছে। ফলে কিছুদিন পরপর ভবনে আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যায়। এসব কোনোটাই স্রেফ দুর্ঘটনা নয়; পরিকল্পিত বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড! সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু ঢাকা নগরীর ইতিবাচক পরিবর্তন আসে না। বরং ক্রমেই জাহান্নামে পরিণত হচ্ছে!
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ঢাকা শহরের প্রতি আগ্রহ হারাতে পারি, বিরক্তও হতে পারি; কিন্তু এই শহর ছেড়ে যাওয়ার মতো পথ আমরা অবশিষ্ট রাখিনি। বিশেষত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গ্রামে গিয়ে সম্মানের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের কোনো ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারেনি। সুতরাং গ্রামগঞ্জও এখন হতাশার জায়গায় পরিণত হয়েছে। দিনমজুরদের পক্ষেও এখন গ্রামগঞ্জে বেঁচে থাকা কঠিন। ফলে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, নিরক্ষর, দিনমজুর, সর্বস্তরের পেশাজীবীদের প্রধান আশ্রয় এখন শহর– বিশেষত ঢাকা।
এসব অব্যবস্থাপনার কারণে বিপুল মানুষের শ্রম, দক্ষতা ও সময়ের ভয়াবহ অপচয় ঘটছে। এই বার্তাও নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক আগে থেকেই বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় জানতে পেরেছি, ঢাকা শহরকে আমরা গলা টিপে হত্যা করছি। এর পরও আমাদের রাষ্ট্রের নীতিপ্রণেতা, বৃহৎ করপোরেশনের কর্তাব্যক্তি, বহুতল ভবনের কর্তারা এই বার্তা গায়ে লাগাননি। কারণ আমরা সফল ও উন্নত জীবনের মাপকাঠি হিসেবে বিচার করেছি স্রেফ টাকাপয়সা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, ফ্ল্যাট ও বহুতল ভবনের স্বত্বাধিকার। এই বোঝাপড়ায় আমরা হারিয়েছি ঢাকা শহরের হাজার বছরের পুরোনো নদনদী, পার্ক, গাছপালা ও বিশুদ্ধ বাতাস।
এতকিছুর পরও আমাদের সুমতি ঘটেনি। এখনও আমরা এই শহর ঘিরে নানামুখী নীতি গ্রহণ করেই চলেছি, যা নগরজীবনকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। এই জীবনে প্রশান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে ঢাকার বিকল্প শহর গড়ে তুলতে হবে। একইভাবে গড়ে তুলতে হবে আমাদের গ্রামগুলোকে, যা আমরা জীবন ও জীবিকার জন্য বিকল্প হিসেবে বেছে নিতে পারি।
ইফতেখারুল ইসলাম: সাংবাদিক
iftekarulbd@gmail.
com
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সেমিনারে বক্তারা
জিও টেক্সটাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্বীপ তৈরি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেন্ট মার্টিনের প্রবালের কোনো ধরনের ক্ষতি না করে দ্বীপটির আয়তন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়া টেকনাফসহ দেশের অন্যান্য এলাকায়ও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর রমনায় অবস্থিত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) শহীদ প্রকৌশলী ভবনের কাউন্সিল হলে ‘অ্যাপ্লিকেশন অব জিও টেক্সটাইলস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক আয়োজিত এক সেমিনারে এই তথ্য উঠে আসে। আইইবির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এ আয়োজন করে।
আইইবির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ সেলিমের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- আইইবির সহসভাপতি (হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট) প্রকৌশলী শেখ আল আমিন, সম্মানী সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. সাব্বির মোস্তফা খান, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সম্পাদক প্রকৌশলী মো. মোস্তফা–ই–জামান প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুল হক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইইবির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. সায়েদুর রহমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শামীম আখতার বলেন, জিও টেক্সটাইলের ব্যবহার ব্যাপক। নদী রক্ষায় এই প্রযুক্তি অনেক কার্যকর। এছাড়া সেতুর গোড়ায় মাটির ক্ষয় রোধে জিও টেক্সটাইল ব্যবহার হচ্ছে। পুরকৌশলে জিও টেক্সটাইল নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও সিভিল ইঞ্জিনিয়াররাও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডে জিও টেক্সটাইলের ব্যাপক ব্যবহার হয়। এটি প্রকৌশল ক্ষেত্রে আশীর্বাদস্বরূপ। তাই এই প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রয়োজন। কিন্তু জিও টেক্সটাইলের উন্নতি নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। জিও টেক্সটাইল নিয়ে প্রচুর গবেষণা করা প্রয়োজন।
মূল প্রবন্ধে মাহবুবুল সড়ক নির্মাণ, ড্রেনেজ সিস্টেম, উপকূলীয় মাটি ক্ষয় রোধ, কৃষি, ড্রেজিং, নদীর পাড় রক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জিও টেক্সটাইলের ব্যবহার ও কার্যকারিতা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, জিও টেক্সটাইল একদিকে যেমন টেকসই ও পরিবেশবান্ধব, অন্যদিকে এর খরচও তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়া সুয়েজ ব্যবস্থাপনা, নদীর পাড় রক্ষা এবং পাহাড় ধস রোধেও এই প্রযুক্তি কার্যকর। পাহাড়ের ঢালে পাটের কার্পেট দিয়ে ঢেকে দিলে সেখানে বৃষ্টির কারণে মাটি ক্ষয় হবে না। এছাড়া সেখানে কার্পেটের সঙ্গে সঙ্গে গাছও লাগানো হয়। এতে করে পাহাড় ধস রোধ করা সম্ভব।
মাহবুবুল বলেন, নদীর পাড়ে ভূমির উপরিভাগের আকার অনুযায়ী জিও ব্যাগ ব্যবহার করলে নদীর পাড় রক্ষায় তা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। এ সময় তিনি জিও টেক্সটাইল নিয়ে গবেষণার ওপর জোর দেন। বিশেষ করে নারকেলের খোসা নিয়ে আলাদা একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনেরও সুপারিশ করেন।