ময়মনসিংহে মাত্র ৯ দিনে অন্তত ৭টি হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া গেছে। ঈদের পরদিন (৮ জুন) থেকে গত সোমবার রাত পর্যন্ত ঘটা এসব খুনের অধিকাংশ ‘তুচ্ছ কারণ’ নিয়ে বিবাদ থেকে ঘটেছে বলে জানাচ্ছে পুলিশ। কখনো ১০ টাকা নিয়ে ঝগড়া, কখনো পূর্ববিরোধ, আবার কখনো পারিবারিক কলহের জেরে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিকেরা। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানোর দাবি জানান তাঁরা।

সর্বশেষ সোমবার রাত ১০টার দিকে ফুলপুর উপজেলার ভাইটকান্দি মোড় এলাকার একটি বাড়ির সেফটিক ট্যাংক থেকে নবম শ্রেণির স্কুলছাত্র আবু রায়হানের (১৬) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সে উপজেলার হরিণাদি গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে। ১৩ জুন রাত ১১টার পর থেকে নিখোঁজ ছিল সে। এ ঘটনায় রায়হানের ভাই মামুন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। স্বজনদের অভিযোগ, প্রতিবেশী এক মেয়ের সঙ্গে রায়হানের প্রেমের সম্পর্কের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

এ বিষয়ে ফুলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হাদি বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে মেয়েটির পরিবার বাড়িতে তালা দিয়ে পালিয়ে গেছে। তাই ধারণা করছি, তারাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।’

এ ছাড়া সোমবার ত্রিশালের হরিরামপুর ইউনিয়নের মাগুরজোড়া এলাকায় হাফিজুর রহমান (২৩) নামের এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গত রোববার রাত ১১টার স্থানীয় বাজার থেকে বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও পরদিন স্থানীয় একটি ইটভাটায় তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়। পুলিশের ধারণা, ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হাফিজুরকে হত্যা করা হয়। তবে আপাতত হত্যার প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাঈম মিয়া (২৩) নামের এক কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়। তাঁকে শুক্রবার রাত ৯টার দিকে গফরগাঁও উপজেলার টাংগাব ইউনিয়নের দাওয়া দাইর দাখিল মাদ্রাসা মাঠে পূর্ববিরোধের জেরে কুপিয়ে জখম করা হয়।
পাগলা থানার ওসি ফেরদৌস আলম বলেন, চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগে নাঈমের বিরুদ্ধে থানায় ছয়টি মামলা আছে। সম্প্রতি এক বৃদ্ধকে কুপিয়ে জখম করেছিলেন নাঈম। এর জেরেই হয়তো তাঁকে হত্যা করা হয়। এ নিয়ে থানায় কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুনচায়ের বিল নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা, ছাত্রদল নেতাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা১৩ জুন ২০২৫

এর আগের দিন রোববার ময়মনসিংহ নগরের মাসকান্দা এলাকায় জোবেদা খাতুন (৭০) নামের এক বৃদ্ধার অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঈদের দিন থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। তিনি ময়মনসিংহ নগরের কেওয়াটখালী মধ্যপাড়া আকন্দবাড়ি এলাকার মৃত সাহেব আলীর স্ত্রী। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা হলেও রহস্য উদ্‌ঘাটন করা যায়নি বলে জানিয়েছেন ৩ নম্বর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবুল হোসেন।

১৩ জুন জেলার গৌরীপুরে চায়ের ১০ টাকা বিল দেওয়া নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার জেরে ছাত্রদলের নেতা হুমায়ুন কবীরকে (২২) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। হুমায়ুন সহনাটী ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বাড়ি ইউনিয়নের সোনাকান্দি গ্রামে। এ ঘটনায় নিহত যুবকের বাবা আবদুল কাইয়ুম বাদী হয়ে গৌরীপুর থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গৌরীপুর থানার ওসি দিদারুল ইসলাম।

১০ জুন মুক্তাগাছা উপজেলার কুমারগাতা গ্রামে জমিলা খাতুন নামের এক বৃদ্ধাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে তাঁর নাতি ফেরদৌসের (২২) বিরুদ্ধে। ফেরদৌস মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলে পুলিশ ও স্বজনেরা দাবি করেছেন। ঘটনার পরপর ফেরদৌসকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে।

৮ জুন ভালুকা উপজেলার সিডস্টোর বাজার এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে সাবিনা ইয়াসমিন (৩৫) নামের এক গার্মেন্টসকর্মীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সাবিনা ত্রিশাল উপজেলার কানিহারি ইউনিয়নের তিরখী গ্রামের রুহুল আমীনের মেয়ে। ভালুকা থানার ওসি হুমায়ুন কবীর জানান, সাবিনা ৫০০ টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে কুপিয়ে ও মাথা থেঁতলে হত্যা করেন স্বামী স্বপন মিয়া (৩৯)। ১৪ জুন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি।

হত্যার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম বলেন, সাম্প্রতিক এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনার অধিকাংশই তুচ্ছ কারণে ঘটেছে। পূর্বপরিকল্পনা করে ঠান্ডা মাথায় হত্যার ঘটনা ঘটছে—এমন নয়, হঠাৎই মাথা গরম করে হত্যার ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হত্যার ঘটনা রোধে বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।

এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে নাগরিক সংগঠন ময়মনসিংহ ফোরামের কো-অর্ডিনেটর সাঈদ ইসলাম বলেন, সামাজিক অস্থিরতার পেছনে মানুষের সহশীলতা কমে যাওয়াই দায়ী। এর পেছনে পারিবারিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক অবক্ষয় প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর তৎপরতা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি মোক্ষম রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে।

আরও পড়ুনতালাবদ্ধ ঘরে নারীর গলিত লাশ, স্বামী পলাতক০৮ জুন ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হত য ক ণ ড র ন ম র এক এ ঘটন য় উপজ ল র স মব র র বব র ঘটন র

এছাড়াও পড়ুন:

নাফি নিহান ইভার পাশে ঈশ্বরগঞ্জের সুহৃদ

সম্প্রতি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে বাসচাপায় প্রাণ হারান ৩৬ বছর বয়সী সবুজ মিয়া। একই সঙ্গে মারা যান ষাটোর্ধ্ব বাবা আব্দুস ছোবানও। প্রতিদিনই সন্তানদের জন্য কাজ শেষে কোনো না কোনো খাবার নিয়ে ফিরতেন সবুজ মিয়া। সেদিন রাতেও তাঁর তিন সন্তান অপেক্ষায় ছিল বাবার জন্য। গরম ভাত-তরকারি নিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় ছিলেন তাদের মা আকলিমা আক্তারও। তাদের অপেক্ষার প্রহর আর ফুরাবে না কোনোদিন। পরিবারটিতে কর্মক্ষম মানুষ ছিলেন এ দু’জনই। 
এমন পরিস্থিতিতে সবুজের অসহায় তিন সন্তান নাফি, নিহান, ইভার পাশে দাঁড়ায় ঈশ্বরগঞ্জ সমকাল সুহৃদ সমাবেশ। সবুজের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য সুহৃদের উদ্যোগে কিনে দেওয়া হয় শাহিওয়াল জাতের একটি বকনা গরু এবং ঈদ উপহার হিসেবে খাদ্যসামগ্রী ও পোশাক।
৪ জুন দুপুরে গরুটি নিহত সবুজের পরিবারের হাতে তুলে দিতে তাঁর বাড়ি উপজেলার বড়হিত ইউনিয়নের পাইকুরা গ্রামে যান সুহৃদরা। এ সময় নিহত বাবা-ছেলের পরিবারের প্রত্যেকের হাতে ঈদ উপহার তুলে দেন তারা। উপহার হিসেবে ছিল নিহত সবুজের স্ত্রী ও মায়ের জন্য শাড়ি এবং মেয়ে, ছোটবোন ও দুই ছেলের জন্য নতুন পোশাক। পাশাপাশি ২০ ধরনের খাদ্যসামগ্রীসহ নগদ ৪ হাজার টাকা সবুজের স্ত্রী ও মায়ের হাতে তুলে দেন ঈশ্বরগঞ্জ সুহৃদরা। 
এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঈশ্বরগঞ্জ সুহৃদের উপদেষ্টা ফেরদৌস কোরাইশী টিটু, আহ্বায়ক মুহাম্মদ আব্দুল হান্নান, সদস্য সচিব আমজাদ হোসেন সোহেল, যুগ্ম-আহ্বায়ক আমিনুল হক, বিলকিস জাহান সেতু, সুহৃদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বায়েজিদ, মনির উদ্দিন, পারভেজ মিয়া, জিল্লুর রহমান সোহাগ, মাসুম আহমেদ ও সাংবাদিক রেজাউল করিম রাজু। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সমকালের ঈশ্বরগঞ্জের সংবাদদাতা মহিউদ্দিন রানা।
এর আগে সুহৃদ সদস্যরা অসহায় পরিবারটির জন্য সহায়তার উদ্যোগ নিয়ে একটি ফান্ড গঠন করেন। সেখানে নিজেদের পাশাপাশি পরিচিতজনদের কাছ থেকেও সহায়তা চান। মানবিক দিক বিবেচনায় অনেকেই এই আহ্বানে সাড়া দেন। এতে ৩৬ হাজার টাকা, শাড়ি, থ্রি পিস, শিশুদের কাপড় পাওয়া যায়; যা দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন সুহৃদ সদস্যরা।
স্থানীয়রা জানান, বাসচাপায় নিহত আব্দুস ছোবানের একমাত্র ছেলে সবুজ। তাঁর ছোট পাঁচ বোনের বিয়ে হয়েছে। একমাত্র অবিবাহিত ছোট বোন সীমা আক্তার থাকে মা নাছিমা আক্তারকে নিয়ে। স্বামী ও একমাত্র ছেলে হারিয়ে নাছিমা পাগলপ্রায়। সবুজের মেয়ে সানজিদা ইভার বয়স ১২ বছর। একটি মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। ৯ বছরের ছেলে নাফিউল মাদ্রাসার ছাত্র। ছোট ছেলে ইফতিয়ার হাসান নিহানের বয়স চার। সে ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না। তবে বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায় অপলক তাকিয়ে থাকে পথের দিকে। যদিও এই অপেক্ষার প্রহর ফুরাবে না কোনোদিনও।
উপহার প্রদান শেষে বাবা-ছেলের কবর জিয়ারত করে প্রয়োজনে অসহায় পরিবারটির পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে নিহতের স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নেন সুহৃদ সদস্যরা। v
সমন্বয়ক 
সুহৃদ সমাবেশ ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিখোঁজ কিশোরের লাশ মিলল সেপটিক ট্যাংকে
  • বিদেশে একটি দলের সঙ্গে বসে কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন না
  • ‘একটি দলের সঙ্গে বিদেশে বসে কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন না’
  • ময়মনসিংহে ছিনতাইয়ের শিকার ব্যাংক কর্মকর্তা, ৯৯৯–এ ফোন পেয়ে ৩ জনকে আটক
  • নিখোঁজ কিশোরের লাশ মিলল সেপটিক ট্যাংকে 
  • নাফি নিহান ইভার পাশে ঈশ্বরগঞ্জের সুহৃদ
  • ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু, পুলিশ স্বাভাবিক মৃত্যু বললেও ‘অস্বাভাবিক’ বলে প্রচার
  • বেড়াতে আসা যুবকের মরদেহ পড়েছিল রাস্তায় 
  • ময়মনসিংহে বিজেএমসির জায়গায় নির্মাণ হবে বহুতল ভবন