ময়মনসিংহে ৯ দিনে ৭ খুন, ‘তুচ্ছ কারণে’ দীর্ঘ হচ্ছে লাশের তালিকা
Published: 18th, June 2025 GMT
ময়মনসিংহে মাত্র ৯ দিনে অন্তত ৭টি হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া গেছে। ঈদের পরদিন (৮ জুন) থেকে গত সোমবার রাত পর্যন্ত ঘটা এসব খুনের অধিকাংশ ‘তুচ্ছ কারণ’ নিয়ে বিবাদ থেকে ঘটেছে বলে জানাচ্ছে পুলিশ। কখনো ১০ টাকা নিয়ে ঝগড়া, কখনো পূর্ববিরোধ, আবার কখনো পারিবারিক কলহের জেরে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিকেরা। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানোর দাবি জানান তাঁরা।
সর্বশেষ সোমবার রাত ১০টার দিকে ফুলপুর উপজেলার ভাইটকান্দি মোড় এলাকার একটি বাড়ির সেফটিক ট্যাংক থেকে নবম শ্রেণির স্কুলছাত্র আবু রায়হানের (১৬) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সে উপজেলার হরিণাদি গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে। ১৩ জুন রাত ১১টার পর থেকে নিখোঁজ ছিল সে। এ ঘটনায় রায়হানের ভাই মামুন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। স্বজনদের অভিযোগ, প্রতিবেশী এক মেয়ের সঙ্গে রায়হানের প্রেমের সম্পর্কের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ফুলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হাদি বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে মেয়েটির পরিবার বাড়িতে তালা দিয়ে পালিয়ে গেছে। তাই ধারণা করছি, তারাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।’
এ ছাড়া সোমবার ত্রিশালের হরিরামপুর ইউনিয়নের মাগুরজোড়া এলাকায় হাফিজুর রহমান (২৩) নামের এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গত রোববার রাত ১১টার স্থানীয় বাজার থেকে বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও পরদিন স্থানীয় একটি ইটভাটায় তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়। পুলিশের ধারণা, ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হাফিজুরকে হত্যা করা হয়। তবে আপাতত হত্যার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাঈম মিয়া (২৩) নামের এক কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়। তাঁকে শুক্রবার রাত ৯টার দিকে গফরগাঁও উপজেলার টাংগাব ইউনিয়নের দাওয়া দাইর দাখিল মাদ্রাসা মাঠে পূর্ববিরোধের জেরে কুপিয়ে জখম করা হয়।
পাগলা থানার ওসি ফেরদৌস আলম বলেন, চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগে নাঈমের বিরুদ্ধে থানায় ছয়টি মামলা আছে। সম্প্রতি এক বৃদ্ধকে কুপিয়ে জখম করেছিলেন নাঈম। এর জেরেই হয়তো তাঁকে হত্যা করা হয়। এ নিয়ে থানায় কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
এর আগের দিন রোববার ময়মনসিংহ নগরের মাসকান্দা এলাকায় জোবেদা খাতুন (৭০) নামের এক বৃদ্ধার অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঈদের দিন থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। তিনি ময়মনসিংহ নগরের কেওয়াটখালী মধ্যপাড়া আকন্দবাড়ি এলাকার মৃত সাহেব আলীর স্ত্রী। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা হলেও রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি বলে জানিয়েছেন ৩ নম্বর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবুল হোসেন।
১৩ জুন জেলার গৌরীপুরে চায়ের ১০ টাকা বিল দেওয়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে ছাত্রদলের নেতা হুমায়ুন কবীরকে (২২) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। হুমায়ুন সহনাটী ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বাড়ি ইউনিয়নের সোনাকান্দি গ্রামে। এ ঘটনায় নিহত যুবকের বাবা আবদুল কাইয়ুম বাদী হয়ে গৌরীপুর থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গৌরীপুর থানার ওসি দিদারুল ইসলাম।
১০ জুন মুক্তাগাছা উপজেলার কুমারগাতা গ্রামে জমিলা খাতুন নামের এক বৃদ্ধাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে তাঁর নাতি ফেরদৌসের (২২) বিরুদ্ধে। ফেরদৌস মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলে পুলিশ ও স্বজনেরা দাবি করেছেন। ঘটনার পরপর ফেরদৌসকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে।
৮ জুন ভালুকা উপজেলার সিডস্টোর বাজার এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে সাবিনা ইয়াসমিন (৩৫) নামের এক গার্মেন্টসকর্মীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সাবিনা ত্রিশাল উপজেলার কানিহারি ইউনিয়নের তিরখী গ্রামের রুহুল আমীনের মেয়ে। ভালুকা থানার ওসি হুমায়ুন কবীর জানান, সাবিনা ৫০০ টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে কুপিয়ে ও মাথা থেঁতলে হত্যা করেন স্বামী স্বপন মিয়া (৩৯)। ১৪ জুন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি।
হত্যার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম বলেন, সাম্প্রতিক এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনার অধিকাংশই তুচ্ছ কারণে ঘটেছে। পূর্বপরিকল্পনা করে ঠান্ডা মাথায় হত্যার ঘটনা ঘটছে—এমন নয়, হঠাৎই মাথা গরম করে হত্যার ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হত্যার ঘটনা রোধে বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।
এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে নাগরিক সংগঠন ময়মনসিংহ ফোরামের কো-অর্ডিনেটর সাঈদ ইসলাম বলেন, সামাজিক অস্থিরতার পেছনে মানুষের সহশীলতা কমে যাওয়াই দায়ী। এর পেছনে পারিবারিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক অবক্ষয় প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর তৎপরতা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি মোক্ষম রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে।
আরও পড়ুনতালাবদ্ধ ঘরে নারীর গলিত লাশ, স্বামী পলাতক০৮ জুন ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হত য ক ণ ড র ন ম র এক এ ঘটন য় উপজ ল র স মব র র বব র ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
জিল হোসেন মারা গেছেন, আদালতে তাঁর লড়াই শেষ হবে কবে
জিল হোসেনের ৭২ বছরের জীবনের ৪৭ বছরই কেটেছে আইনি লড়াইয়ে। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা পাসের সনদ পেতে, এরপর ক্ষতিপূরণের দাবিতে তাঁর এই দীর্ঘ লড়াই। লড়াই এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই মারা গেছেন জিল হোসেন।
জিল হোসেনের মৃত্যুর পর তিন বছর ধরে লড়াইটা করে যাচ্ছেন স্ত্রী ও তাঁর সন্তানেরা। কিন্তু পরিবারটির বিচারের অপেক্ষা শেষ হয়নি।
পরিবার ও মামলার নথিতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে তিনি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের (কৃষি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। এই পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার ফলাফলে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করেন জিল হোসেন। কিন্তু সেই আবেদনে কাজ হয়নি।
১৯৭৫ সালে জিল হোসেন আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর প্রাপ্ত নম্বরের (১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায়) সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে।
সেই আইনি লড়াইয়ের শুরু। নিম্ন আদালত পেরিয়ে বছরের পর বছর উচ্চ আদালতেও ছুটেছেন তিনি। সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকতেন জিল হোসেন। ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। সংসারে স্ত্রী এবং চার ছেলে ও চার মেয়ে রয়েছে। আইনি লড়াই নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যান জিল হোসেন। এর পর থেকে মামলায় পক্ষ হয়ে তাঁর স্ত্রীসহ উত্তরাধিকারীরা লড়াই করে যাচ্ছেন।
বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।নূর হোসেন, বাদী জিল হোসেনের ছোট ছেলেজিল হোসেনের ছোট সন্তান নূর হোসেন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’
আরও পড়ুনশিক্ষাসনদ নিয়ে ৪৮ বছরের আইনি লড়াই: ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় বাস্তবায়নে বাধা নেই০৮ অক্টোবর ২০২৩নূর হোসেন আরও বলেন, ‘মা এবং ভাইবোনেরা এখন মামলা চালাচ্ছি। মায়ের বয়স ৬৯ বছর। তিনিও নানা রোগে ভুগছেন। তিনিও চূড়ান্ত রায় দেখে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। বাবা মারা যাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো অনুশোচনা নেই, এটা কষ্টের।’
আইনি লড়াই
জিল হোসেন যখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (কৃষি) দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরোনো পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। ময়মনসিংহের মুনসেফ আদালতে করা মামলায় জয়ী হন তিনি। আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
তবে জিল হোসেনের লড়াই তখনো বাকি। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই আদালতের দেওয়া রায়েও জিল হোসেনের বহিষ্কারাদেশ বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
একই বছর হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। হাইকোর্ট ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান। এরপর ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুনসেবাদাতা বা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টির মূল্যায়ন হয়নি২৮ এপ্রিল ২০২২এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এ রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।
অতঃপর সনদ, ক্ষতিপূরণ মামলা
পরিবার ও মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাঁকে পাস নম্বর দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর নম্বরপত্রের সনদ দেওয়া হয়। তখন জিল হোসেনের বয়স ৪৭ বছর। তখন তাঁর সরকারি চাকরির বয়সসীমা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টর স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।চঞ্চল কুমার বিশ্বাস, বাদীপক্ষের আইনজীবীএরপর ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন। মামলায় অভিযোগ করেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তাঁর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে সরকারি চাকরির সম্ভাবনাও।
ক্ষতিপূরণের এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ কোটি টাকা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৪ বছর পর নিষ্পত্তি
বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৪ জুন হাইকোর্ট শর্ত সাপেক্ষে ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ স্থগিত করেন। শর্ত হিসেবে ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা ৩ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বলা হয়। এতে ব্যর্থ হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে বলেও ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, জিল হোসেন মারা যাওয়ার পর আপিল শুনানির জন্য উঠলে ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা সামনে আসে। এ অবস্থায় হাইকোর্ট আপিলকারী পক্ষকে ২৫ লাখ টাকা জমা দিয়ে আসতে বলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে ৪ নভেম্বর ওই অর্থ জমা দেয়।
বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবীবিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা আপিল খারিজ করে ২০২৩ সালের ৭ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় সংশোধন সাপেক্ষে বহাল রাখেন হাইকোর্ট। রায়ের দিন থেকে ওই অর্থের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে তারা (জিল হোসেনের পরিবার) লভ্যাংশ পাবেন বলেও জানানো হয়। অবশ্য এর আগে শর্ত অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জমা করা ২৫ লাখ টাকা ওই অর্থ থেকে বাদ যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে লিভ টু আপিল করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সঙ্গে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনটি ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ওঠে। শুনানি নিয়ে সেদিন তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন। লিভ টু আপিল ক্রম অনুসারে শুনানি হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় লিভ টু আপিলটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের গত ৩১ আগস্টের কার্যতালিকায় ৫০৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।
জিল হোসেনের পরিবারের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি পরিচালনার জন্য ২০২৩ সালের ৯ মার্চ আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস নিয়োগ পান। তাঁকে নিয়োগ দেয় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। চঞ্চল কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদন আপিল বিভাগ খারিজ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালতে অর্থ আদায়ে জারি মামলার (২০০৯ সালে করা) কার্যক্রম অগ্রসরের জন্য বাদীর উত্তারাধিকারীকারেরা আবেদন করেন।
আরও পড়ুনসনদ ও ক্ষতিপূরণের জন্য ৪৭ বছরের আইনি লড়াই ১৭ ডিসেম্বর ২০২২চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।’
আরও পড়ুন৩৩ বছর কেটে গেছে, কাজল কথা রেখেছেন০৫ আগস্ট ২০২৫