ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র গাজায় যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে; কিন্তু এসব পদক্ষেপ মূলত প্রতীকী। আর এখানে ক্ষোভটাও যে লোক দেখানো সেটা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ভালো করেই জানেন।

ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ যখন গাজায় অনাহারে থাকা বেসামরিক মানুষদের কাছে খাদ্যসহায়তা পৌঁছানো হলে নেতানিয়াহুর সরকারকে ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেন, তখন ইউরোপের নেতারা কিন্তু ক্ষোভে ফেটে পড়েননি; বরং তাঁরা খুব নিচু স্বরে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার কথা বলেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে মত দিয়েছেন ১৭ জন। আর বিরোধিতা করেছেন ১০ জন। ফলাফল কী হলো? ব্যবস্থা হলো খুবই লঘু। কেউ ভিসা বাতিল করলেন, কেউ আবার অ্যাকাউন্ট জব্দ করলেন। আর এর মধে৵ই নিরীহ মানুষের ওপর বোমাবর্ষণ চলতেই থাকল।

এসব আসলে ইসরায়েলকে বাধা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নয়। এটা কেবল কূটনৈতিক নাটক। আর নেতানিয়াহু? তিনি কাঁপছেন না, হাসছেন। এটা একটা খুবই পুরোনো আর পরিচিত অনুশীলন। ইসরায়েল হামলা বাড়ায়। গাজা রক্তাক্ত হয়। পশ্চিমারা অসহায়ভাবে হাত মলে আর নেতানিয়াহু হাসেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন যতই মানবাধিকার আর নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার কথা বলুক না কেন বাস্তবে তারা এর ধারেকাছে দিয়ে হাঁটে না। ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এখন পর্যন্ত প্রায় লাখো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, প্রায় গোটা গাজার বাসিন্দাদের উৎখাত করেছে এবং গাজাকে দুর্ভিক্ষের প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। এ সবকিছুর  প্রতিক্রিয়ায় ব্রাসেলস যা করছে, সেটা প্রায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের পর্যায়ে পড়ে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাণিজ্য স্থগিত বা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে বরং ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এবং জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ’ নিয়েছে। তাদের ভিসা না দেওয়া এবং তাদের সম্ভাব্য ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পদক্ষে নেওয়া হয়েছে। যেন এই দুই ব্যক্তি—যাঁরা স্পষ্টভাবে সেটলারদের সহিংসতা ও জাতিগত নিধনের পক্ষে সাফাই গান, তাঁরা প্যারিসে ছুটি কাটানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন।

ইসরায়েলের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য নির্বিঘ্নেই চলছে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইসরায়েলের মধ্যে স্বাক্ষরিত সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তির ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষকে মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে। এখন সেই অনুচ্ছেদ নীতিতে নয়, শুধু প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বেঁচে আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা বহুবার প্রমাণ করেছেন যে প্রয়োজনে তাঁরা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন। রাশিয়া, বেলারুশ ও ইরানের বিরুদ্ধে তাঁরা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু ইসরায়েলের ক্ষেত্রে সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়। এর পরিবর্তে তাঁরা ‘পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ’ করছেন বলে ফাঁপা বিবৃতি দেন।

বেজালেল স্মোট্রিচ ও ইতামার বেন–গভির কোনো প্রান্তিক চরিত্র নন। নেতানিয়াহুর বর্তমান জোটের তাঁরা কেন্দ্রীয় স্তম্ভ। স্মোট্রিচ কেবল ইসরায়েলের অর্থনীতি দেখেন না, পশ্চিম তীরে দখলদার নীতি বাস্তবায়নের বড় অংশের দায়িত্বেও তিনি রয়েছেন। বেন–গভির ইসরায়েলি পুলিশ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সেটলার আন্দোলনের প্রধান মুখও তিনি।

স্মোট্রিচ সম্প্রতি হুমকি দিয়েছেন, যদি গাজায় মানবিক সাহায্য ঢুকতে দেওয়া হয়, তবে তিনি সরকার ভেঙে দেবেন। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়াব্যবস্থা হলো ভিসা না দেওয়ার আলাপ। অথচ তিনি একসময় গাজাকে ‘মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার’ ডাক দিয়েছিলেন। ফিলিস্তিনি শিশুদের ‘ছোট সাপ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

বেন–গভির চরমপন্থী রাব্বি মেইর কাহানের অনুসারী। উসকানি ও প্ররোচনাকে বেন–গভির তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের অংশ করে তুলেছেন। তিনি সেটলারদের হাতে অস্ত্র দেওয়ার পক্ষপাতী এবং তাদের আইনি জবাবদিহি থেকে রক্ষা করার পক্ষে যুক্তি দেন। তাঁর উত্থান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি ইসরায়েলি রাজনীতিতে যে কট্টর ডানপন্থী ঢেউ চলছে, তারই উপসর্গ।

স্মোট্রিচ ও বেন–গভিরের বিরুদ্ধে প্রতীকী শাস্তির পদক্ষেপ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বোঝাতে চায়, নেতানিয়াহু একজন যুক্তিসংগত নেতা। কিন্তু তিনি কট্টরপন্থীদের হাতে জিম্মি। কিন্তু এটি পুরোপুরি একটি কল্পকাহিনি। স্মোট্রিচ ও বেন–গভির নেতানিয়াহুর বোঝা নন; বরং তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল সাগরেদ। এই কট্টরপন্থী মতাদর্শই তাঁর জোটকে আঠার মতো আটকে রেখেছে। শুধু দু-একজনকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মানে হচ্ছে, বুলেটের ক্ষতে শুধু ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সেটিকে অস্ত্রোপচার বলে চালিয়ে দেওয়ার মতো একটি লোকদেখানো আয়োজন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপের জনসাধারণকে শান্ত রাখা। ইসরায়েলের যুদ্ধযন্ত্রকে থামানো নয়।

ইসরায়েল কোনো ‘উচ্ছেদে যাওয়া অংশীদার’ নয়; বরং ইসরায়েল পশ্চিমা কাঠামোর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ইসরায়েল একদিকে যেমন সামরিক ঘাঁটি, আবার অন্যদিকে প্রযুক্তি রপ্তানিকারক ও নজরদারি প্রযুক্তির উদ্ভাবক। ইসরায়েল হচ্ছে এমন একটি ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’যেটি নানা রকম সুবিধা ভোগ করে। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা দেয়। ইউরোপীয় দেশগুলো ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করছে।

দখলদারত্ব বজায় থাকার অভিজ্ঞতা থেকে ইসরায়েল যে সব নজরদারি ও দমন-পীড়ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে, সেটি তারা বিভিন্ন দেশে বিক্রি করে।

কূটনৈতিকভাবে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বিশ্বের প্রক্সির ভূমিকা পালন করে। ইসলামবিরোধী বয়ানের মিশেলে ইসরায়েল ইরানবিরোধী প্রচারণা বাড়িয়ে চলেছে বহু পুরোনো ঔপনিবেশিক কাঠামোকেই শক্তিশালী করে।

এ কারণেই ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধগুলোকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলা হয়; কিন্তু এর জন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ রাশিয়া যখন ইউক্রেনে বোমা ফেলে, পশ্চিমা বিশ্ব তখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি তোলে; কিন্তু যখন ইসরায়েল গাজায় বোমা ফেলে, তখন তারা ‘সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানায়।

এটা শুধু দ্বৈতনীতি নয়, এটাই আসল নীতি। আর ইসরায়েল জানে কীভাবে সেই নীতিকে কাজে লাগাতে হয়।

বাণিজ্য স্থগিত, অস্ত্র বিক্রি বন্ধ এবং ইসরায়েলি নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠানো হলেই প্রকৃত চাপটা আসতে পারে। এর পরিবর্তে পশ্চিমা বিশ্ব শুধু বিবৃতি দেওয়ায় এবং কার্যকর পদক্ষেপের জায়গায় দূর থেকে দেখার পথ বেছে নিয়েছে।

জাসিম আল-আজজাওয়ি, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পদক ষ প ইউন য ন ইউর প য ব যবস থ ইসর য় ল মন ত র ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কার নিয়ে শুধু বিএনপিকে দোষারোপ করা ঐক্যের সহায়ক হবে না: মির্জা ফখরুল

সংস্কার নিয়ে শুধু বিএনপিকে দোষারোপ করে কথা বলা জাতীয় ঐক্যের জন্য সহায়ক হবে না বলে সতর্ক করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘একটি কৌশলী প্রচারণা চালানো হচ্ছে, বলা হচ্ছে, বিএনপি সংস্কার মানছে না। অথচ বাস্তবে আমরা বহু আগেই সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিয়েছি এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করার পক্ষেই আমরা কথা বলছি।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪: জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন মির্জা ফখরুল। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এ অনুষ্ঠান হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছিলেন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানে তাঁর ভিডিও বক্তব্য প্রচার করা হয়।

আরও পড়ুনসংসদে প্রতিনিধিত্ব চান জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা২ ঘণ্টা আগে

সংস্কার নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলেছি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলেছি। তাই শুধু বিএনপিকে দোষারোপ করলে তা ঐক্যের সহায়ক হবে না।’ তিনি বলেন, বিএনপি বরাবরই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাস করে এবং সে অনুযায়ী সংস্কারের প্রস্তাব দিয়ে আসছে। ২০১৬ সালে খালেদা জিয়া ‘ভিশন ২০৩০’ প্রকাশ করেছিলেন, পরে ২০২২ সালে দলীয়ভাবে ২৭ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা দেওয়া হয়, যা পরবর্তী সময়ে ৩১ দফায় রূপান্তরিত হয়।

তরুণেরাই দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন এনেছে উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘তাদের ত্যাগ ও সংগ্রামে আমরা আজকের জায়গায় এসেছি। আমরা চাই, একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে থাকবে কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও ধর্মীয় স্বাধীনতা।’

আরও পড়ুনসংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থায় বিপদ দেখছেন তারেক রহমান১ ঘণ্টা আগেজুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪: জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শক–শ্রোতাদের একাংশ। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে

সম্পর্কিত নিবন্ধ