এত কিছুর পরও নির্বাচন নিয়ে ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলের দোলাচল কেন
Published: 11th, July 2025 GMT
নির্বাচন নিয়ে দেশে নানামুখী তৎপরতা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো যে যার মতো প্রস্তুতি নিচ্ছে, সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করছে। আবার বড় দলে মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতার সমর্থকদের মধ্যে হানাহানির ঘটনাও ঘটছে।
এরই মধ্যে গতকাল বুধবার আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগের দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার কথা জানিয়ে দেন। আগামী ১ আগস্ট থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা।
কোনো কোনো পর্যবেক্ষক সরকারের নির্বাচনী প্রস্তুতির সঙ্গে এর যোগসূত্র খুঁজছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ফোনালাপে আরও অনেক বিষয়ের সঙ্গে নির্বাচনের প্রসঙ্গও তুলেছেন বলে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। মার্কিন শুল্কনীতির সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতির সম্পর্ক থাকুক আর না-ই থাকুক, বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য খুবই উদ্বেগজনক। তিন মাস সময় পেয়েও সরকার কেন শুল্ক সহনীয় স্তরে নিয়ে আসতে পারল না, এই প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
আরও পড়ুনশুধুই নির্বাচন নাকি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন?১৩ জুন ২০২৫গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.
এখনো সেই ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলের দোলাচল! তাহলে লন্ডন বৈঠকের ফল কী হলো?
পবিত্র ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন নির্বাচন হবে জানালে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল এর বিরোধিতা করে। বিএনপির নেতারা আন্দোলনে নামার ঘোষণাও দেন এ সময়। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চলতি বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার অর্থ হলো দেশবাসীকে নির্বাচনী ট্রেনে ওঠার জন্য বাঁশি বাজানো। কিন্তু তাঁদের ট্রেনে তোলার আগে এটা পরিষ্কার করা উচিত যে কোথায় গিয়ে সেটি থামবে।এই প্রেক্ষাপটে জুনের মাঝামাঝি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়। ওই বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা আসে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের পবিত্র রমজান মাসের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে।
নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজটি করতে হবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকেই। সে ক্ষেত্রে সময়সীমা নিয়ে ধোঁয়াশা রাখার দরকার কী?
বিভিন্ন দল নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারকাজ দৃশ্যমান করার যে দাবি জানিয়েছিল, সেটা যৌক্তিক বলেই মনে করি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সব সংস্কার ও বিচার সম্পন্ন করার আগে নির্বাচন হতে পারবে না। সাম্প্রতিক সময়ে দুটিতেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে। তারা আশা করছে, জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা যাবে। ডেইলি স্টারের খবরে দেখলাম, সরকার বিএনপির কাছে যেই খসড়া পাঠিয়েছে, নিজেদের মতামতসহ তা তারা ফেরতও দিয়েছে।
আরও পড়ুনবিএনপি কি জয়ের আভাস পেয়ে প্রচলিত পথেই হাঁটছে২৯ মে ২০২৫ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার অর্থ হলো দেশবাসীকে নির্বাচনী ট্রেনে ওঠার জন্য বাঁশি বাজানো। কিন্তু তাঁদের ট্রেনে তোলার আগে এটা পরিষ্কার করা উচিত যে কোথায় গিয়ে সেটি থামবে।
নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আরও কিছু সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে, যার বেশির ভাগের সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। যেমন গত তিন নির্বাচনে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে (পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড) ১৭ হাজার নতুন সদস্য নেওয়া, সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্সের দায়িত্ব দেওয়া, বিগত সরকারের আমলে তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ না জানানো।
১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সীদের মধ্যে যাঁরা বিগত ৩টি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি, তাঁদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের ভাবনার সঙ্গেও কেউ দ্বিমত করবেন না। কিন্তু তাঁদের জন্য পৃথক ভোটার তালিকা ও আলাদা ভোটিং বুথ রাখার প্রস্তাব কোন যুক্তিতে, তা পরিষ্কার নয়। এতে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার ঝুঁকি আছে বলে মনে হয়। যেখানে ভোটারদের অর্ধেকের বেশি ১৮ থেকে ৩৩ বছরের মধ্যে, সেখানে তাঁদের আলাদা বুথ বা আলাদা তালিকা করার চিন্তা কেন? এ ধরনের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
আরও পড়ুনআওয়ামী সমর্থকেরা কাকে ভোট দেবে২৮ জুন ২০২৫তার চেয়ে সরকারের উচিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির দিকে নজর দেওয়া ও মব ভায়োলেন্স বন্ধ করা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পাটগ্রাম ও পটিয়ার ঘটনায় সরকার অভিন্ন অবস্থান নিতে পারলে পুলিশ বাহিনীর মনোবল বাড়ত। সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত হতো।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তরুণসহ সব ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের পছন্দসই প্রতিনিধি বেছে নিতে পারবেন। এটা এখন দৃশ্যমান যে যাঁরা ‘প্রকৃত সংস্কার’ ও ‘সত্যিকার বিচারের’ পর নির্বাচন করার জন্য মাঠে-ময়দানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে আগাম নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। একটি দল তো ২৯৬টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। যাঁরা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীন নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছেন, তাঁরাও সম্ভাব্য প্রার্থীদের পক্ষে জেলায় জেলায় গিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমনকি কোন দল কত আসনে জয়ী হবে, সেই সংখ্যাও তাঁরা জানিয়ে দিচ্ছেন।
অতএব, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারের দোলাচল মোটেই কাম্য নয়। নির্বাচন তারা কবে করতে চায়, সেটি খোলাসা করে বলুক।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রস ত ত র ড স ম বর সরক র র র জন য র অর থ ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পন্ন হোক
গত বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন রকমের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে পাঁচটি সমন্বয় ও তদারকি কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন। এটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আরেক ধাপ অগ্রগতি বলে মনে করি।
নির্বাচন সুষ্ঠু করার উদ্দেশ্যে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পদায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে আট লাখের মতো সদস্য মাঠে থাকবেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ। এ ছাড়া পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ডে যে নতুন করে ১৭ হাজার সদস্যকে নিয়োগ করার কথা আছে, তাঁদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে।
নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ওপর নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া না হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। বৈঠকে নির্বাচনের আগে জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) রদবদল করার বিষয়ে আলোচনা হলেও কীভাবে সেটা হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। বদলি প্রক্রিয়ায় যাতে কেউ প্রভাব খাটাতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গত তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে যেসব প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে পারলে ভালো। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা পাওয়া যাবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়েও মনিটরিং সেল গঠন করা হবে, যাতে অনিয়ম হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারলে নির্বাচনের অনিয়ম ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। আগে নির্বাচনের সময় চার দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হতো। এবার সাত দিনের কথা ভাবা হচ্ছে। এটাও ভালো সিদ্ধান্ত বলতে হবে।
ওই বৈঠকে নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রশাসনিক দিক নিয়েই এই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের সব অংশীজনকেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। ভোটার, ভোটপ্রার্থী, সরকার ও নির্বাচন কমিশন, যে যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করলে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা অসম্ভব নয়। নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষা করার দায়িত্ব মূলত সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সহযোগিতা ছাড়া সেটা সম্ভব হবে না। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সবার কাম্য। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। ধর্ম–বর্ণ ও জাতি–নির্বিশেষে যাতে প্রত্যেক নাগরিক নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারেন, সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
সরকারপ্রধান যখন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করতে বলেছেন, তখন নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ফেব্রুয়ারি না এপ্রিল—ধোঁয়াশা থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে বলে জানানো হয়েছিল। মাঠে সক্রিয় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আওয়ামী লীগ আমলের তিনটি নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) জনগণ ভোট দিতে পারেননি। বিশেষ করে এই সময়ে যঁারা প্রথম ভোটার হয়েছেন, তাঁরা ভোট দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। এ অবস্থায় নির্বাচনের সব প্রস্তুতি যথাযথভাবে সম্পন্ন হোক এবং দেশ নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।