নোয়াখালীতে বন্যার পানি নামছে ধীরগতিতে, মানুষের দুর্ভোগ
Published: 11th, July 2025 GMT
নোয়াখালীতে বৃষ্টি কমেছে। তবে বন্যার পানি নামছে ধীরগতিতে। এখনো জেলা শহর মাইজদীর প্রধান সড়ক ছাড়া বেশির ভাগ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। অনেক বাসাবাড়িও জলমগ্ন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নোয়াখালীর ৬টি উপজেলার ৫৭টি ইউনিয়ন কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪১ হাজার ৮৪০টি পরিবারের অন্তত ২ লাখ ৩ হাজার ১০০ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। বন্যায় কবিরহাট ও সুবর্ণচর উপজেলার ৪০টি বসতঘর আংশিক এবং সুবর্ণচরের একটি বসতঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, গতকাল পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, সুবর্ণচর, সদর ও সেনবাগ উপজেলার ৪০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৪১৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকার জন্য সরকারিভাবে ৫১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত প্রতিবেদন এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উচ্চ পর্যবেক্ষক মো.
সকালে সরেজমিনে জেলা শহর মাইজদীর লক্ষ্মীনারায়ণপুর, সেন্ট্রাল রোড, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমি এলাকা, রেললাইনসংলগ্ন এলাকা, মোক্তার মসজিদ, ছাবিম মিয়া সড়ক, জেলা জজ আদালত সড়ক, হাকিম কোয়ার্টার সড়ক, আল ফারুক একাডেমি এলাকা ও মেথর পল্লি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে—এসব এলাকার বেশির ভাগ সড়কই বন্যার পানিতে ডুবে রয়েছে। সড়কের আশপাশের অনেক বাড়িঘরেও এখনো পানি। পানিবন্দী মানুষ ভোগান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।
কথা হয় লক্ষ্মীনারায়ণপুর সৈয়দ বাড়ির বাসিন্দা মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে। প্রায় হাঁটুসমান পানি মাড়িয়ে তিনি বাড়ির সামনের দোকানে যাচ্ছিলেন। আলাপকালে এই বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই তাঁদের বাড়িতে পানি জমে যায়। পানি নিষ্কাশনের ড্রেন নির্মাণের জন্য এবং বাড়ির চলাচলের সড়কটি উঁচু ও পাকা করে দেওয়ার জন্য অনেকবার তাঁরা পৌরসভা কার্যালয়ে ধরনা দিয়েছেন। এরপরও তাঁদের এলাকায় কোনো উন্নয়ন পৌরসভা করেনি। অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা দেখা দেওয়ায় বাড়ির অনেক বসতঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে তাঁদের বাড়ির বাসিন্দারা পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের টাউনহল মোড়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সড়ক এবং ইসলামিয়া সড়কের পাশের অনেক দোকানে এখনো বন্যার পানি। একই চিত্র দেখাযায় মাইজদী পৌর বাজারেও। সেখানে বন্যার পানির কারণে ক্রেতা-বিক্রেতারা সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে কেনাবেচা করছেন। ধীরগতিতে পানি নামার কারণে পানিবন্দী অবস্থায় ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন ইসলামিয়া সড়ক এলাকায় মেথর পল্লিতে বসবাসরত হরিজন সম্প্রদায়ের প্রায় ১০০ পরিবার।
বন্যার পানি মাড়িয়ে কাজে যাচ্ছেন এক বাসিন্দা। আজ সকালে নোয়াখালী শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকার সৈয়দ বাড়িতেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন য র প ন প ন বন দ ইসল ম ম ইজদ
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা
মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে প্রায়ই বিজ্ঞান, স্থাপত্য বা শাসনব্যবস্থার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু এর মানবিক দিক অধরা রয়ে যায়। বিশেষ করে দরিদ্রদের প্রতি দয়া ও চিকিৎসাসেবার গল্প আড়ালে রয়ে গেছে সব সময়।
মুসলিম সভ্যতায় কীভাবে দরিদ্র ও অসুস্থদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা, আশ্রয় এবং মানসিক সান্ত্বনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা এক অপূর্ব কাহিনি।
বিমারিস্তান: দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসার আশ্রয়মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবায় ‘বিমারিস্তান’ নামের হাসপাতাল ছিল একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এগুলো শুধু চিকিৎসার জায়গা ছিল না, বরং দরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে আশ্রয়, খাদ্য ও যত্নের ব্যবস্থা ছিল। বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত নগরে, বিশেষ করে বড় রাজধানীগুলোতে বিমারিস্তান ছিল। দামেস্কে বিমারিস্তানের নাম ছিল ‘নুরি’, বাগদাদে ‘আদুদি’।
প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহ.)প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকের সময়, ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এতে চিকিৎসক নিয়োগ করেন এবং তাঁদের বেতনের ব্যবস্থা করেন। সমাজের স্বাস্থ্য রক্ষায় কুষ্ঠরোগীদের জন্য পৃথক স্থানে বিনা মূল্যে খাদ্য ও যত্ন দেওয়া হতো।
অন্ধদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সাহায্যকারী নিয়োগ করা হতো। খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।’ (ইবনে আসাকির, তারিখে দিমাশক, ৪৪/১২৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)
আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালও ছিল, যা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হতো। দূরবর্তী অঞ্চলে মহামারি মোকাবিলায় ৪০টি উটের কাফেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হতো।
মিসরে প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় আহমদ ইবন তুলুনের সময়, ৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে, ফুসতাতে। এর নাম ছিল ‘বিমারিস্তান আতিক’।
এর জন্য ওয়াক্ফ তহবিল রাখা হয়েছিল, এবং শর্ত ছিল যে এটি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য, সৈন্য বা দাসদের জন্য নয়। এর বার্ষিক খরচ ছিল ৬০ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। ইবন তুলুন নিজে প্রতি সপ্তাহে এটি পরিদর্শন করতেন এবং জুমার দিনে মুসল্লিদের জন্য জরুরি সেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ছিল ১ লাখের বেশি বইয়ের গ্রন্থাগার। (মাকরিজি, খিতাত, ২/৪০৫, দারু সাদির, কায়রো, ১৮৫৩)
সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।সালাহউদ্দিন আইয়ুবি বিমারিস্তান ‘নাসিরি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মিসর ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিমারিস্তান ছিল মনসুর কালাউনের প্রতিষ্ঠিত বিমারিস্তান, ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। এখানে নারী-পুরুষ সবার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল, চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ছিল না। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো।
সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। রাতের দীর্ঘ সময় রোগীদের জন্য কষ্টকর হতো, তাই ফজরের আজান দুই ঘণ্টা আগে দেওয়া হতো, যাতে রোগীরা সকালের আশায় উৎফুল্ল হয়। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।
সুস্থ হওয়ার পর রোগীদের পোশাক ও কিছু টাকা দেওয়া হতো, যাতে তারা তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে না বাধ্য হয়। এই বিমারিস্তান ২০০ জনের বেশি দরিদ্র রোগীকে বাড়িতে চিকিৎসা দিত। (মাকরিজি, খিতাত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৭)
দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসাগ্রন্থমুসলিম সভ্যতার চিকিৎসকেরা লক্ষ করেন, চিকিৎসা কখনো কখনো ধনীদের কাছে ব্যবসায় পরিণত হন। তাই তাঁরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে বা ছোট চিকিৎসকেরা তাদের সহজে চিকিৎসা দিতে পারেন। এই গ্রন্থগুলোয় স্থানীয় ও সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতো; কারণ, ভারত বা চীন থেকে আমদানি করা ওষুধ ছিল দামি।
আরও পড়ুনইসলামে দারিদ্র্য দূরীকরণের ৮টি ব্যবহারিক উপায়০২ নভেম্বর ২০২৫আবু বকর আর-রাজি: তিনি দরিদ্রদের প্রতি অসাধারণ দয়া দেখাতেন এবং তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন: ‘বুরউ সা’আত’ (তাৎক্ষণিক চিকিৎসা) এবং ‘মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব’ (যার কাছে চিকিৎসক নেই), যাকে ‘তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন’ (দরিদ্রদের চিকিৎসা) বলা হয়।
তিনি লিখেছেন, ‘অনেক চিকিৎসক ওষুধ ও খাবারের কথা লেখেন, যা শুধু রাজাদের ভান্ডারে পাওয়া যায়। আমি সাধারণ ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে চিকিৎসার একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখতে চাই, যাতে সবাই এর সুবিধা পায়।’ (আল-রাজি, মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব, পৃষ্ঠা ১৫, দারুল কুতুব, বৈরুত, ১৯৮৫)
মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো।ইবনে জাজ্জার কায়রাওয়ানি: তিনি কখনো দরিদ্রদের কাছ থেকে চিকিৎসার ফি নিতেন না। তিনি তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দরিদ্ররা স্বাস্থ্য ও রোগ–সম্পর্কিত বইয়ের সুবিধা পায় না। তাই আমি এমন একটি গ্রন্থ লিখলাম, যাতে সহজলভ্য ওষুধ দিয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করা যায়।’ (ইবনে জাজ্জার, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ১০, দারুল ফিকর, কায়রো, ১৯৯০)
ইবনে আকফানি: তিনি গুনইয়াতুল লাবিব ফি গাইবাতিত তাবিব (চিকিৎসক না থাকলে জ্ঞানীর সম্পদ) গ্রন্থে জরুরি রোগের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য রক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন।
জামালুদ্দিন ইউসুফ মাকদিসি: তিনি ‘তিব্বুল ফুকারা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ধনীরা সুস্বাদু খাবার খায়, তাই তাদের রোগ বেশি। দরিদ্ররা সাধারণ খাবারে সন্তুষ্ট থাকে, তাই তাদের রোগ কম। কিন্তু দরিদ্ররা অসুস্থ হলে তাদের জন্য সহজ ও সস্তা ওষুধ দরকার।’ (মাকদিসি, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ৮, দারুল মারিফা, বৈরুত, ১৯৯২)
মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো। চিকিৎসকেরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তারা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে। এই ঐতিহ্য দেখায়, ইসলামি সভ্যতা কেবল জ্ঞান বা শক্তিতে নয়, মানবিকতা ও দয়াতেও শ্রেষ্ঠ ছিল।
আরও পড়ুনআপনার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিচ্ছেন তো২১ জুন ২০২৫