নোয়াখালীতে বৃষ্টি কমেছে। তবে বন্যার পানি নামছে ধীরগতিতে। এখনো জেলা শহর মাইজদীর প্রধান সড়ক ছাড়া বেশির ভাগ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। অনেক বাসাবাড়িও জলমগ্ন।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নোয়াখালীর ৬টি উপজেলার ৫৭টি ইউনিয়ন কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪১ হাজার ৮৪০টি পরিবারের অন্তত ২ লাখ ৩ হাজার ১০০ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। বন্যায় কবিরহাট ও সুবর্ণচর উপজেলার ৪০টি বসতঘর আংশিক এবং সুবর্ণচরের একটি বসতঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, গতকাল পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, সুবর্ণচর, সদর ও সেনবাগ উপজেলার ৪০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৪১৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকার জন্য সরকারিভাবে ৫১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত প্রতিবেদন এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উচ্চ পর্যবেক্ষক মো.

রফিকুল ইসলাম আজ শুক্রবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকাল ছয়টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় জেলা শহর মাইজদীতে ৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা আগের ২৪ ঘণ্টার তুলনায় ৪১ মিলিমিটার কম। আজ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরও কমতে পারে।

সকালে সরেজমিনে জেলা শহর মাইজদীর লক্ষ্মীনারায়ণপুর, সেন্ট্রাল রোড, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমি এলাকা, রেললাইনসংলগ্ন এলাকা, মোক্তার মসজিদ, ছাবিম মিয়া সড়ক, জেলা জজ আদালত সড়ক, হাকিম কোয়ার্টার সড়ক, আল ফারুক একাডেমি এলাকা ও মেথর পল্লি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে—এসব এলাকার বেশির ভাগ সড়কই বন্যার পানিতে ডুবে রয়েছে। সড়কের আশপাশের অনেক বাড়িঘরেও এখনো পানি। পানিবন্দী মানুষ ভোগান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।

কথা হয় লক্ষ্মীনারায়ণপুর সৈয়দ বাড়ির বাসিন্দা মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে। প্রায় হাঁটুসমান পানি মাড়িয়ে তিনি বাড়ির সামনের দোকানে যাচ্ছিলেন। আলাপকালে এই বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই তাঁদের বাড়িতে পানি জমে যায়। পানি নিষ্কাশনের ড্রেন নির্মাণের জন্য এবং বাড়ির চলাচলের সড়কটি উঁচু ও পাকা করে দেওয়ার জন্য অনেকবার তাঁরা পৌরসভা কার্যালয়ে ধরনা দিয়েছেন। এরপরও তাঁদের এলাকায় কোনো উন্নয়ন পৌরসভা করেনি। অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা দেখা দেওয়ায় বাড়ির অনেক বসতঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে তাঁদের বাড়ির বাসিন্দারা পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের টাউনহল মোড়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সড়ক এবং ইসলামিয়া সড়কের পাশের অনেক দোকানে এখনো বন্যার পানি। একই চিত্র দেখাযায় মাইজদী পৌর বাজারেও। সেখানে বন্যার পানির কারণে ক্রেতা-বিক্রেতারা সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে কেনাবেচা করছেন। ধীরগতিতে পানি নামার কারণে পানিবন্দী অবস্থায় ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন ইসলামিয়া সড়ক এলাকায় মেথর পল্লিতে বসবাসরত হরিজন সম্প্রদায়ের প্রায় ১০০ পরিবার।

বন্যার পানি মাড়িয়ে কাজে যাচ্ছেন এক বাসিন্দা। আজ সকালে নোয়াখালী শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকার সৈয়দ বাড়িতে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বন য র প ন প ন বন দ ইসল ম ম ইজদ

এছাড়াও পড়ুন:

এই অপচয় রোধে প্রয়োজন টেকসই পদক্ষেপ

প্রতিবছরের মতো এবার যে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাড়ম্বর আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন ছিল না, এটা ভালো দৃষ্টান্ত। অতীতে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিয়ে আনুষ্ঠানিকতার নামে সরকারের মাহাত্ম্য প্রচার করা হতো। 

তবে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল খুবই হতাশাজনক।  বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩১০ জন পরীক্ষার্থী। পাস করেছে ১০ লাখ ৬ হাজার ৫৫৪ জন। অকৃতকার্য হয়েছে ৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৪৬ জন। পাসের হার ৬৮ দশমিক শূন্য ৪; যা গতবার ছিল ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড যুক্ত করলে অকৃতকার্য শিক্ষার্থী ৬ লাখের বেশি।  

এই যে জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হলো, এর জন্য তাদের দায়ী করা যায় না। দায়ী হলেন শিক্ষার অভিভাবক বা রক্ষকেরা। বাংলাদেশে যখন যেই সরকার আসে, তাদের মতো করে একটি শিক্ষানীতি বা কমিশন করে। কিন্তু সেই শিক্ষানীতি বা কমিশন শিক্ষার মানোন্নয়নে আদৌ ভূমিকা রাখছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা হয় না। 

এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার কম হওয়ার জন্য শিক্ষার অভিভাবকেরা যেসব কারণ চিহ্নিত করেছেন, তাকে ‘ঐচ্ছিক’ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। মূল কারণ তাঁরা এড়িয়ে গেছেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ‘আমাদের কোনো টার্গেট ছিল না যে পাসের হার এত করব, বাড়াব, নাকি কমাব। আমাদের মিশন ছিল পরীক্ষা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা।’ 

সুন্দরভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করা শিক্ষা বোর্ড তথা সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব। এতে কৃতিত্ব নেওয়ার কিছু নেই। মূল কথা হলো নীতিনির্ধারকেরা শিক্ষার সমস্যাটি কীভাবে দেখেছেন এবং তার প্রতিকারে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন। করোনার কারণে দুই বছর ঠিকমতো বিদ্যালয়ে পাঠদান হয়নি, এটা সত্য; কিন্তু তার আগে কিংবা পরেও পাঠদান সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। প্রতিটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর মান যাচাই করার কথা থাকলেও সেটা হয় না। এ কারণেই এসএসসিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অকার্যকর হয়।

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, শ্রেণিকক্ষের চেয়ে কোচিং করতে শিক্ষার্থীদের বেশি উৎসাহিত করা হয়। আগে কোচিং সেন্টার ছিল শহরাঞ্চলে, এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও প্রসারিত হয়েছে। কোচিং মানে শিক্ষা নয়, পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে, কী উত্তর  হবে; সেটা শিক্ষার্থীকে জানিয়ে দেওয়া। বহু বছরের কু–অভ্যাসে আমরা শিক্ষাকে এই স্তরে নিয়ে এসেছি। 

প্রতিটি দেশের একটি শিক্ষা–দর্শন থাকে, যার উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ ও ভবিষ্যতে তাকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। আমাদের শিক্ষার নীতিনির্ধারকেরা এর ওপর কখনো জোর দেননি।  অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের অনেকের পড়াশোনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ করে মেয়েশিক্ষার্থীদের। এটা কেবল পরিবার বা রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি নয়, মানবসম্পদেরও অপচয়। 

শিক্ষা খাতের প্রতি পূর্বাপর সব সরকারই উদাসীনতা দেখিয়ে আসছে। এমনকি গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারও শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি। শিক্ষার মানোন্নয়নে সর্বস্তরে মেধাবী শিক্ষকদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, সময়মতো পাঠ্যবইসহ শিক্ষার সব উপকরণ শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। আর মেধাবীরা তখনই এই পেশায় আসবেন, যখন সম্মানজনক বেতন–ভাতা পাবেন। 

এসএসসি পরীক্ষায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়া ঠেকাতে সরকারকে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ঠকমতো পাঠদান ও মান যাচাই হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তদারকি জোরদার করার বিকল্প নেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ