ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ গেছে ৮০০ ফিলিস্তিনির
Published: 12th, July 2025 GMT
গাজায় চরম খাদ্যাভাব আর ইসরায়েলের ব্যাপক হামলার মুখে প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। শিশুরা মারা যাচ্ছে অভুক্ত থেকে; রোগে ও বিমান হামলায়। হাসপাতালে চিকিৎসক ও ওষুধের তীব্র সংকট। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মারা যাচ্ছেন ধুঁকে ধুঁকে। পুরো উপত্যকা যেন এক বৃহৎ গোরস্তান। এসব ঘটছে অনেকটা প্রকাশ্যে। এ গণহত্যা থামাতে বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ নেই। উল্টো তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস (ওএইচসিএইচআর) জানিয়েছে, গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন-জিএইচএফের সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ জন নিহত হয়েছেন। গত মে মাসের শেষ দিকে জাতিসংঘের বারণ সত্ত্বেও মানবাধিকার সংস্থার নামে জিএইচএফ গাজায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে এ সংগঠনটি গড়ে তুলেছে।
দ্য গার্ডিয়ান অনলাইন জানায়, শুক্রবার জিএইচএফ ত্রাণ নিতে আসা আরও ১০ জনকে হত্যা করেছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। এ প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনি শরণার্থী-বিষয়ক জাতিসংঘের প্রধান ফিলিপ লাজ্জারিনি বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েল হত্যার সবচেয়ে নির্মম ও দুরভিসন্ধিমূলক পথ বেছে নিয়েছে। উপত্যকা শিশু ও ত্রাণপ্রত্যাশীদের জন্য গোরস্তানে পরিণত হয়েছে।’
ওএইচসিএইচআরের মুখপাত্র রাবিনা শামদাশানি বলেন, ৭ জুলাই পর্যন্ত ৭৯৮ ত্রাণপ্রত্যাশী নিহত হয়েছেন। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস উইদাউট বর্ডার বলেছে, গাজায় ‘চরম পুষ্টিহীনতা নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে।’ খান ইউনিসের আল নাসের হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান আহমেদ আল ফারা জানান, ইসরায়েলের বিমান হামলার বৃহস্পতিবার রাতে অন্তত ১৫ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন অনেকে। তাদের হাসপাতালে আনা হলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী নেই। এর মধ্যে হাসপাতালের পাশেই থেমে থেমে কামান থেকে গোলা ছুড়ছে ইসরায়েল।
তাঁবু গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল
ব্যাপক হামলায় গাজার প্রায় সব ভবন মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। বাধ্য হয়ে বাসিন্দারা তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন। এবার সেখানেও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের পশ্চিমাঞ্চলের আল মাওয়াসি এলাকাকে বাস্তুচ্যুতদের জন্য নিরাপদ জোন ঘোষণা করেছিল ইসরায়েল। আলজাজিরা জানায়, গতকাল শুক্রবার সেখানেই হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের সেনারা। তাঁবু গুঁড়িয়ে দিচ্ছে এবং সন্দেহ হলেই হত্যা করছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে গৃহহীন অনেককে হতাশ বসে থাকতে দেখা যায়।
দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের ‘মৃত্যু’, ইঙ্গিত ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর
ইসরায়েলের সাংবাদিক গিডিয়ন লেভি বলেছেন, ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে যে মতবিনিময় হয়েছে, তাতে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের মার্কিন অঙ্গীকার ‘মৃত ও সমাহিত’ বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এক প্রতিবেদক জিজ্ঞাসা করেন, দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান হবে কিনা? তখন ট্রাম্প বলেন, ফিলিস্তিনিদের নিজেদের শাসনের ক্ষমতা থাকা উচিত, ইসরায়েলকে হুমকি দেওয়ার নয়। এর অর্থ হলো সামগ্রিক নিরাপত্তার মতো ক্ষমতা সর্বদা আমাদের হাতে থাকবে।
লেভি আলজাজিরাকে বলেন, এ মতবিনিময় ছিল দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের ‘মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা’, যা বাস্তবে ‘অনেক আগেই মারা গেছে’। তিনি বলেন, ‘আমাদের এর মুখোমুখি হতে হবে– কখনও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র থাকবে না। আমাদের সিদ্ধান্ত ও পরিণতি সম্পর্কে ভাবতে হবে। অর্থাৎ একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চিন্তা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ দখলদারিত্ব ও বসতি স্থাপন প্রকল্প অব্যাহত থাকবে, ততক্ষণ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কোনো সম্ভাবনা নেই।’
মার্কিন সুরক্ষায় ইসরায়েলের ‘নিখুঁত অপরাধ’
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরদারিতে ইসরায়েল ‘নিখুঁত অপরাধ’ করছে। কারণ মার্কিন সমর্থন গাজায় দায়মুক্তির সঙ্গে এ অপরাধ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। কাতারের দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের পাবলিক পলিসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তামের কারমাউত আলজাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরদারিতে নিখুঁত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। যেহেতু ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুরক্ষা ও সমর্থন পাচ্ছে, সেহেতু তারা এটি করতে দ্বিধা করছে না। তিনি বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না থাকত, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, এ যুদ্ধ অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত। দুঃখজনকভাবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অত্যন্ত সু-সমন্বিত যুদ্ধ। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র– উভয়ের স্বার্থই একে অপরের সঙ্গে জড়িত।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ন হত য ক তর ষ ট র র ইসর য় ল র আম দ র অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ছয় সপ্তাহে ত্রাণ নিতে যাওয়া ৭৯৮ জনকে হত্যা
গাজায় একমুঠো খাবারের আশায় ত্রাণকেন্দ্রে ছুটে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নৃশংসতা থামছে না। গত ছয় সপ্তাহে ত্রাণকেন্দ্রে যাওয়া এমন অন্তত ৭৯৮ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। বিতর্কিত এই ত্রাণকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থিত সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)।
গাজায় জিএইচএফ কার্যক্রম শুরু করে গত ২৬ মে। এর আগে টানা ১১ সপ্তাহ উপত্যকাটিতে ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ রেখেছিল ইসরায়েল। জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্র এমন সব স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে ইসরায়েলি সেনারা মোতায়েন রয়েছেন। সংস্থাটির দেওয়া খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। শুরু থেকেই জিএইচএফের ত্রাণ কার্যক্রমের সমালোচনা করে আসছে জাতিসংঘ।
গতকাল শুক্রবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেন, ‘২৭ মে থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ৭৯৮ জনকে হত্যার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে জিএইচএফের ত্রাণগুলোর আশপাশে। আর ১৮৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে ত্রাণ নিতে যাওয়ার পথে।’
ওএইচসিএইচআর জানিয়েছে, ত্রাণকেন্দ্রে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের হত্যার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে গাজার বিভিন্ন হাসপাতাল, কবরস্থান, ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, এনজিও, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে। হামলার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২৭ মে থেকে ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগের শরীরে গুলির আঘাত রয়েছে।
তবে ত্রাণ নিতে যাওয়া মানুষের ওপর গুলি চালানোর তথ্য নাকচ করে দিয়েছে জিএইচএপফ। সংস্থাটির একজন মুখপাত্রের দাবি, গাজায় জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট ত্রাণকেন্দ্রগুলোতেই সবচেয়ে ‘প্রাণঘাতী’ হামলার ঘটনা ঘটেছে। আর ইসরায়েল বলছে, ত্রাণ যেন হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতেই ত্রাণকেন্দ্রগুলোর কাছে ইসরায়েলি সেনাদের মোতায়েন করা হয়েছে।
‘কসম, আমার মেয়ে নিষ্পাপ ছিল’
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার মানুষ হত্যা করছে ইসরায়েল। গতকাল উপত্যকাটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত ২১ মাসে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় প্রায় ৫৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। একই সময়ে আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। ইসরায়েলের হামলায় নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
এমন পরিস্থিতিতে কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস ও ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়ে আশাবাদী তিনি। গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে দুই পক্ষ সংঘাত পুরোপুরি বন্ধের চেষ্টা চালাবে।
সংঘাত বন্ধের দিকে এগোনোর কথা বললেও বৃহস্পতিবারেই মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকায় একটি চিকিৎসাকেন্দ্রের কাছে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলায় ১০ শিশুসহ ১৬ জন নিহত হয়েছেন। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, রক্তের ভেতরে কয়েকজন নারী ও শিশুর দেহ পড়ে আছে। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গাধায় টানা গাড়িতে করে শিশুদের নিথর দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
নিহত এক শিশুর মরদেহের পাশে বসে ছিলেন তার মা সামাহ আল-নোউরি। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘কসম, আমার মেয়ে কিছু করেনি। ও নিষ্পাপ ছিল। ও স্বপ্ন দেখত যুদ্ধ শেষ হবে, আবার স্কুলে যেতে পারবে। আমার মেয়ে তো কেবল এখানে চিকিৎসা নিচ্ছিল। কেন ওকে মেরে ফেলা হলো?’