আমাদের দেশে পার্টির শেষ নেই। নানান পার্টি। একেকটির একেক চরিত্র—চান্দা পার্টি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, গ্যাঞ্জাম পার্টি, ফার্স্ট পার্টি, থার্ড পার্টি, ব্যান্ড পার্টি। আছে নানান নামের পলিটিক্যাল পার্টি। এদের মধ্যে আবার ওয়ানম্যান পার্টিও আছে। তবে যে হারে পার্টির সংখ্যা বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে নতুন পার্টির নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
এমনই এক পার্টির নেতার কল্পিত সাক্ষাৎকার, যেখানে সাংবাদিকের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘এই যে আপনি পার্টি করেছেন, সারা দেশের মানুষ তো আপনাকে চিনবে না।’ নেতা সগর্বে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন—
: আপনি কোন যুগে বাস করেন, ভাই? আপনি খালি বলেন, আপনিও একটা পার্টির জন্ম দেবেন, দেখবেন কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক শ ক্যামেরা হাজির হয়ে গেছে। ব্রেকিং নিউজ হবে, বিভিন্ন চ্যানেলের স্ক্রলে আপনার নাম যাবে, টক শোতে ঘন ঘন ডাক পড়বে। প্রচারের জন্য আপনাকে কিছুই করতে হবে না, তারাই নানা রং লাগিয়ে সুন্দর সুন্দর শিরোনামে নিউজের সঙ্গে সঙ্গে কনটেন্টও ছাড়বে। সারা দেশে পয়সা ছাড়া খবর পৌঁছে যাবে।
: কিন্তু রাজনীতিতে তো খরচাপাতি আছে?
: এইটাও কোনো সমস্যা নয়, মতলববাজ ব্যবসায়ীরা বসে আছে ইনভেস্ট করার জন্য। সুতরাং টাকার অভাব হবে না।
: তারা টাকা দেবে কেন, তাদের লাভ?
: তারা দান করবে, আপনি তাদের কুকীর্তির লাইসেন্স প্রদান করবেন।
: কিন্তু দল করে আপনার লাভ?
: আমি নেতা হলাম। কথা বললেই নানান রঙের কয়েক ডজন মাইক্রোফোন আমার সামনে সাজানো থাকবে। ম্যালা চ্যানেল তো, ওদেরও খবর দরকার। ভোট পাই না পাই, আজকাল কিন্তু ‘ওয়ানম্যান পার্টি’রও কদর আছে। একসময় এদের অনেকে মন্ত্রীও ছিলেন। ওনারা জোটে যান, তবে ভোটে হারেন।
গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে নীতিমান রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে কথা নয়, কাজ দিয়ে। যাতে সুসময়েই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে: কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে যদি সমস্যায় পড়েন?
: সুর চেঞ্জ করে ফেলব। স্ট্রেট পল্টি।
: নির্বাচন এলে কী করবেন?
: এই চামড়ার মুখে যত প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব সব দেব।
: কিন্তু প্রতিশ্রুতি যদি রক্ষা না করেন?
: জনগণ জানে, নির্বাচনের আগে অনেকেই অনেক কথা বলে। ওই সব মনের কথা নয়, মুখের কথা। জনগণ এসব বিশ্বাস করে না।
: জনগণ কি আপনার সঙ্গে আছে?
: আছে কি না জানি না, তবে সবাই সবকিছুই জনগণের ওপর দিয়া চালিয়ে দেয়, আমিও দিলাম। রাজনীতির নীতি কজন মেনে চলে?
আসলেই রাজনীতি করলে একটি নীতির প্রশ্ন আসে। সেই নীতির প্রতি কতজনের প্রীতি আছে, কতজনের ভীতি আছে, আর কজন সেই নীতিকে ইতি করে দিয়েছেন, সেই ইতিহাস অনেকেরই জানা।
যাঁরা এই রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন, তাঁরা নেতা। তবে এই নেতা ও নীতিকে অনেকে সমার্থক করে ফেলেন। মনে রাখতে হবে, নেতার কথাই নীতি নয়, নীতির ধারক হচ্ছেন নেতা। তবে আমাদের এখানে অনেক নেতার প্রিয় নীতির নাম দুর্নীতি, যা মহামারির রূপ ধারণ করেছে।
নীতি শব্দের আগে ‘দু’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে শব্দটি তৈরি হয়েছে। যা অন্যায়, অনিয়ম, নীতিবিরুদ্ধ, সেটাই দুর্নীতি। দুর্নীতির প্রধান কারণ হচ্ছে লোভ।
অক্সফোর্ড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক বুকম্যান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে বটে; কিন্তু সবার লোভ মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।’ এই লোভের কারণে অনেকেই দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। দেখা দেয় আর্থিক বিশৃঙ্খলা। ফলে দুর্নীতির গতি আর নীতির দুর্গতি অতিশয় ক্ষতির প্রভাব ফেলে সর্বত্র। কারণ, মানুষ তাকেই ভালোবাসে, যার নীতি ও আদর্শ আছে। সে জন্য রাজনীতিতেও দেখা যায় কেউ গালি খায়, কেউ তালি পায়।
কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কথা চিন্তা করুন। ভদ্রলোক প্রায় ১০ বছর শাসনক্ষমতায় ছিলেন। তারপর পদত্যাগ করলেন, কিন্তু দেশত্যাগ নয়। বরং পদত্যাগের পর তিনি নির্ভয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষের মতো। বিভিন্ন শপে গিয়ে কেনাকাটা করছেন। সেই ছবিও ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। ট্রুডোর এই জীবনযাত্রা থেকে অনেক রাজনীতিবিদেরই অনেক কিছু শেখার আছে।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ময়দানে খুব গুরুত্বপূর্ণ নেতা কিংবা ব্যক্তির ভাষণ দেওয়ার আগে নানান বিশেষণ দেওয়া হয়, যেমন এবারে ‘ঐতিহাসিক ভাষণ’ দেবেন ‘সংগ্রামী জননেতা’, ‘বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর’, ‘জ্বালাময়ী বক্তা’.
এখন যে কারও ভাষণকে ঐতিহাসিক ভাষণ, যত ফ্যাসফেসে কণ্ঠই হোক না কেন, বলা হয় বলিষ্ঠ কণ্ঠ। তবে জ্বালাময়ী শব্দটির সঙ্গে আমি একমত। কারণ, বেশির ভাগ রাজনৈতিক ভাষণই এখন জ্বালাময়ী, যা শুনলে আমাদের শরীরে জ্বালা ধরে যায়। যদিও রাজনৈতিক এসব জ্বালাযন্ত্রণার মধ্যেই আমাদের বসবাস।
রাজনীতিতে মনোনয়ন-বাণিজ্য ও ভোট বিক্রি অত্যন্ত গর্হিত একটি দুর্নীতি। নির্বাচনী প্রচারণা যেমন ব্যয়বহুল, নির্বাচনে মনোনয়নও একটি লেনদেনভিত্তিক প্রক্রিয়া, যা একধরনের রাজনীতির নীতিহীনতা। আসছে নির্বাচন—ভয়, না জানি কোন মাত্রায় এই লেনদেন হয়!
দুর্নীতিপ্রেমিক রাজনীতিবিদেরা তাদের নানান কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যা নিয়মনীতির চূড়ান্ত লঙ্ঘন। ফলে প্রতিবাদে জেগে ওঠে জনতা। আর জনতা জাগলে এই ধরাকে সরা জ্ঞান করা অরাজকদের পরাজিত হতে হয়। আর এই পরাজিত শক্তির কী পরিণতি হয়, তা তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছিই। এসব কারণেই হলো অভ্যুত্থান, গঠিত হলো নতুন সরকার। একের পর এক চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় সরকারের সামনে। দিন যতই যায়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ছোট ছোট গোষ্ঠী নতুন নতুন দাবি নিয়ে হাজির হয়। এসব আন্দোলনকারীর কাছে যেন জিম্মি হয়ে পড়ে সরকার। জিম্মি হয় সাধারণ মানুষ।
ক্ষোভ, বিক্ষোভ, অনশন, অবস্থান, মানববন্ধন, কর্মবিরতিসহ নানান কর্মসূচিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশ, দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সবকিছুই। রাজনৈতিক অচলা অবস্থা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। পরিস্থিতি ঠেকাতে সিরিজ বৈঠক করেও সময়মতো সুরাহা হয় না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির দিকে যেন কারোরই নজর নেই। শাহবাগ থেকে যমুনা আন্দোলনের নতুন ঠিকানা।
একসময় পুলিশের গাড়ি দেখলেই আন্দোলন-মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত। আর এখন পুলিশ যেন দর্শক। হাতে লাঠি থাকলেও অন্যায়ের পিঠে ওঠে না। দেখে মনে হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কোনো কাজ নেই। চারদিকে মবের ভয়, না জানি কখন কী হয়। এই মব কারও কাছে ভায়োলেন্স, কারও কাছে জাস্টিস। সুযোগসন্ধানীরা তৎপর। চান্দাই যেন এখন বড় ধান্দা। যে যেভাবে পারছে এই সুযোগে কার্য উদ্ধার করছে।
বৈশাখ গেল, দুটি ঈদ গেল। নানা রকম কর্মসূচি হলো। কেউ আনন্দ পেল, কেউ কষ্ট পেল, কেউ কেউ সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। চরিত্র পাল্টানোর প্রতিযোগিতায় অনেকেই এগিয়ে গেল। দিন যতই যাচ্ছে, ‘দালাল’-জাতীয় ব্যক্তিদের জায়গা শক্ত হচ্ছে। মিশে যাচ্ছে পরিবর্তনের স্রোতে। মুখোশ পাল্টে সাজছে ভালো মানুষ। এই কাতারে শিল্পী, সাংবাদিক, আমলা, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই আছেন। সাধারণ মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে এসব সার্কাস দেখছে।
এই করতে করতে শুরু হলো নির্বাচন-যুদ্ধ। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে সরকারি অবস্থানের পক্ষ নিল কেউ কেউ। কেউ আবার চরম বিপক্ষে। গণতন্ত্রের জন্য সোচ্চার আওয়াজ। কিসের গণতন্ত্র? কেমন গণতন্ত্র? যারা গণতন্ত্রের জন্য মাঠ গরম করছে, তারা কি আচার-আচরণ কিংবা দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক?
কর্মীরা রাজপথে থাকে, নীতিনির্ধারণে তাদের ভূমিকা নেই। ফলে সংসদেও দেখা যায় তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতিফলন। রাজনৈতিক দলের কাজ কী? শাসন? দখল? দুর্নীতি? নাকি জনগণের সেবা? তারা কার কাছে জবাবদিহি করবে? জবাবদিহি শব্দটাই যেন উধাও। তাই সংসদে স্পিকারের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে কিংবা ‘না’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘না’ জয়যুক্ত হয়েছে। ‘হ্যাঁ’-কে ‘না’ বলার কিংবা ‘না’-কে ‘হ্যাঁ’ বলার সাহস কারও নেই। ফলে হাতের তালুতে আঘাত পেলেও সব শক্তি ঢেলে টেবিল চাপড়ে সম্মতি বা অসম্মতি জানায়।
ডিসেম্বরে, নাকি ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন, এ নিয়ে তর্কবিতর্ক, শোডাউন আর টক শোর দাপটে বাজার গরম হয়ে ওঠে। কেউ বলেন বিচার সময়সাপেক্ষ আর সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং এর ওপর নির্ভর করে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা যাবে না।
ঈদের সময় ঘোষিত হলো, এপ্রিলের শুরুতে হবে নির্বাচন। ব্যস, শুরু হয়ে গেল মিটিং-মিছিল, ‘মানি না মানি না’ স্লোগান। আর কেউবা ঘোষিত সময়ের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করলেন। কিন্তু ‘মানি না’ দলের শোডাউন বেশ জুতসই হওয়ায় জাতি চিন্তিত হয়ে পড়ল—আমাদের ভাগ্যে কি আদৌ নির্বাচন আছে? আবারও খই ফোটা শুরু হলো টক শোতে। শুধু টিভি চ্যানেলেই নয়, ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলেও টক শো, দর্শক শো, নেতা শো, সাংবাদিক শো—শোয়ের শেষ নেই। একই ব্যক্তির নানান নামে নানান শো চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে চিন্তা হয়, মানুষ এত কথা বলে কী করে? কারণ ব্যবসা। যত কথা তত ভিউ, যত ভিউ তত ব্যবসা। অর্থাৎ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়ে, অশান্তি যত বাড়ে, টক শোর টক এবং টকারও তত বাড়ে।
একই ব্যক্তি কত ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছেন, কী হলে কী হবে, কী না হলে কী ঘটবে। কী উচিত, কী অনুচিত। একজন অভিনয়শিল্পীর চেয়ে ‘টক’-শিল্পীদের পর্দায় উপস্থিতি বেশি, ফলে তারাও অভিনয় তারকার মতো ‘টক’ তারকা। সময়ের পরিবর্তনে টকারও বদলেছে। কিছু পুরোনো মুখের প্রস্থান, নতুন মুখের আগমন ঘটেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন চলন্ত গাড়িতে ব্রেকের মতো সবকিছুই থেমে গেল। কারণ লন্ডনের একটি বৈঠক, যেখানে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। এই ইঙ্গিতে রাজনৈতিক রণসংগীতের সমাপ্তি ঘটল।
রাজনৈতিক তর্জনগর্জনে কিছুটা বিরতি দেখা দিলে টকাররাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন টক শো চলবে কী করে? সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে কী নিয়ে কথা বলবেন? ইস্যু কী? অনুসন্ধানে বেরিয়ে এল এক নতুন ইস্যু। নির্বাচনের তারিখের মধ্যে খোঁজ পাওয়া গেছে দুটি শব্দ ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’। ব্যস, আবার গরম হয়ে উঠল টক শোর আসর। এটা যদি সেটা হয়, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। ‘যদি’, ‘কিন্তু’ থেকে এখন আবার তারিখ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। শুরু হয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতা। টক শোতে নতুন সুর।
কথায় আছে, ‘কথায় কথা বাড়ে’, কেউ আবার এই কথা ধরে ভিন্ন অর্থ করে। ‘যত মত তত পথ’—এটি একসময় ছিল সুবচন। সেই বচনে পচন ধরলে মূল অর্থের চেয়ে ভুল অর্থের আশঙ্কাই বেশি।
‘কথা কম কাজ বেশি’—বাক্যটি অনেকেই মনে রাখতে পারেন না। তাই তর্কে কেউ কারও কাছে হারেন না। অনেকে এটাও ভুলে যান যে শ্রোতাদের মধ্যেও তাঁদের চেয়ে জ্ঞানী বা গুণী মানুষ থাকতে পারে। এমন মানুষও থাকতে পারে, যাদের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই, প্রয়োজনও নেই। কারণ, তারা উদয়াস্ত জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত।
তবে ভবিষ্যতে একটি ভেজালবিহীন নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে নীতিমান রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে কথা নয়, কাজ দিয়ে, যাতে সুসময়েই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
হানিফ সংকেত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ব দ র জন ত ত র জন ত ক ন র জন অন ক ই আম দ র ব যবস সরক র সবক ছ
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা মিশ্র হলো কেন
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। রক্তক্ষয়ী সেই দিনগুলোর স্মৃতি এখনও তাজা। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারেরও এক বছর হতে চলল। তার ‘পারফরম্যান্স’ও আলোচিত হচ্ছে গুরুত্বসহ। যেসব রাজনৈতিক দল ও পক্ষের সমর্থনে সরকারটি এসেছিল– বিগত সময়ে তাদের ভূমিকাও হচ্ছে আলোচিত। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুতরা মাঠে অনুপস্থিত। তাদের নেতৃস্থানীয় অংশটি অবস্থান করছে বিদেশে। অনেকের নামে শুরু হয়েছে বিচার। সংস্কারের আলোচনাও চলমান। তবে বেশি আলোচনায় নির্বাচন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্বাচন ঠিকমতো হয়নি। তিন-তিনটি ভুয়া নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যথেচ্ছাচার করে যাচ্ছিল সরকার। তাদের অপকর্ম নতুন করে বর্ণনার কিছু নেই। শেখ হাসিনার অন্ধ সমর্থক ছাড়া বিপুল অধিকাংশ জনগণ এ বিষয়ে একমত। জনগণের এ অংশটি ‘একটি দণ্ডে একাত্ম হয়ে’ সরকার পতনের আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে সে ঐক্য অবশ্য নেই। কেননা, হাসিনা সরকারের পতন বাদে অন্যান্য প্রশ্নে তাদের মতপার্থক্য রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যেও আছে মতপার্থক্য। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন এই সময়ের প্রধান এজেন্ডা। এগুলো নিয়েও মতপার্থক্য কম নয়। সেটা গভীরতর হতেও দেখা যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ধরে রাখা। দলগুলো সর্বক্ষেত্রে ঐকমত্য পোষণ করবে, তা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রে মতের ভিন্নতাকে ইতিবাচকভাবেও দেখা হয়ে থাকে। তবে ব্যতিক্রমী সময়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আসা সরকারের কাছে দাবি করা হয় ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’।
গণতন্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞ মাড়িয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত গণতন্ত্রে উত্তরণে সহায়তা জোগানো। জাতীয় নির্বাচন ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। নির্বাচন যথাসম্ভব দ্রুত সম্পন্ন করা তাই প্রধান করণীয়। জাতি হিসেবে আমাদের যা কিছু প্রয়োজন, তা অর্জন করতে হবে গণতান্ত্রিকভাবেই। তবে গত প্রায় এক বছরে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্য বললে ভুল হবে না। কবে নাগাদ নির্বাচন– সেটা এখনও সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি সরকার। নব্বইয়ে সামরিক শাসনের অবসানের পর তিন মাসের মধ্যেই কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল। সেই সরকার সংস্কারেও আগ্রহ দেখায়। কিন্তু সংস্কার তখন নির্বাচনের মুখোমুখি হয়ে সেটাকে বিলম্বিত করেনি।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি অবশ্য অনেক জটিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা সরকারটি অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় থাকতে চেয়ে অনেক বেশি সর্বনাশ করে গেছে, সন্দেহ নেই। বিশেষত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনষ্ট করে গেছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে গেলেও এ ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার প্রয়োজন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংস্কারের আবশ্যকতা কেউ অস্বীকার করে না। সরকার আয়োজিত এ-সংক্রান্ত সংলাপে সব রাজনৈতিক দলই অংশ নিচ্ছে। হালে কিছু সাংবিধানিক সংস্কারেও তাদের দেখা গেল একমত হতে। এটাকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। আরও অগ্রগতি আনা গেলে অবশ্যই ভালো হতো। কিন্তু সংস্কারে কাউকে বাধ্য করার সুযোগ তো নেই। সে কারণেই বলা হচ্ছে, ঐকমত্যের জায়গাগুলো ধরে সংস্কারের বাস্তবায়ন শুরু করা উচিত ছিল। সরকারে তেমন আগ্রহ কিন্তু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতে সংস্কার আলোচনায় কালক্ষেপণের অভিযোগও উঠছে। তবে চলতি মাসেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার কথা। এর ভেতর দিয়ে নির্বাচনের সময় চূড়ান্ত হলেই গণতন্ত্রে উত্তরণে উন্মুখ জনগোষ্ঠী আশ্বস্ত হবে।
গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষ অবশ্য দ্রুত নির্বাচনে আগ্রহী নয়। একাংশের ধারণা, বিদ্যমান বিধি ব্যবস্থায় ‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ না করে নির্বাচনে গেলে আবারও স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ঘটবে। তারা সংবিধানেও ব্যাপক সংস্কার চাইছে। বিচারে বড় অগ্রগতিও তাদের কাম্য। এসব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোয় বিরাট মতানৈক্য রয়েছে, তা অবশ্য নয়। সেটা থাকলে বিশেষত সংবিধান সংস্কার আলোচনায় কোনো অগ্রগতিই হতো না। সংকট আসলে দেখা দিয়েছে বিচার ও সংস্কারকে নির্বাচনের পূর্বশর্ত করা নিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারকেও এখানে একটি পক্ষভুক্ত মনে হচ্ছে। আলোচিত লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে অগ্রগতি হলেও সে ক্ষেত্রে রয়েছে বিচার ও সংস্কারে ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’র শর্ত। এ কারণে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না– ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। অনেক বাদানুবাদের পর এটুকু স্থির করা গেছে, এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচন। যদিও মনে করা হচ্ছে, প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক দিক থেকে এপ্রিল নির্বাচনের উপযুক্ত সময় নয়!
কোনো কোনো পক্ষ আবার জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তুলছে অব্যাহতভাবে। তারা এটাও বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। গণঅভ্যুত্থানের পর মব ভায়োলেন্সসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে চলেছে। প্রায় এক বছরেও এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। রাজনৈতিক সহিংসতাও চলমান। মাঠে থাকা দলগুলো দেখাচ্ছে অসহিষ্ণুতা। গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব দাবি থেকে নিয়ে পরস্পরের ভূমিকা বিষয়ে উত্তেজক বক্তব্য প্রদানও অব্যাহত। এতে সাধারণ প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতেও রাজনৈতিক পরিবেশ হচ্ছে বিষাক্ত। এ অবস্থায় স্থানীয় নির্বাচন হলেও তা শান্তিপূর্ণভাবে হবে বলে মনে হয় না। সে কারণেও দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানেই সর্বশক্তি নিয়োগ করা দরকার। তা ছাড়া জাতীয় নির্বাচন ঘিরেই তো সংকট দেখা দিয়েছে। আর গণঅভ্যুত্থানের পর যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই। এ লক্ষ্য অর্জনে সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন সহায়তাও নিতে হবে এবার। কেননা, পুলিশকে এখনও সক্রিয় করা যায়নি।
গত দেড়-দুই দশকে বিশ্বে যেসব গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করেও পদক্ষেপ নিতে হবে। তিউনিসিয়ায় সৃষ্ট আরব বসন্তের পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কি সাধারণভাবে সুখকর? এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা অবশ্য ভিন্ন। এটাও ঠিক, দেশে দেশে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ভিন্নতা থাকে। তাই তুলনায় সতর্কতা প্রয়োজন। ‘বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ’ও জরুরি। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী আর এতে ক্ষমতা গ্রহণকারী সরকারকেও সেটা করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিরও নির্মোহ মূল্যায়ন প্রয়োজন। হালে স্বয়ং অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে অগ্রগতি হওয়ায় উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থ ছাড়ে এগিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশে দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণ দেখতে আগ্রহী। সংস্কারেও আগ্রহী তারা। আওয়ামী লীগের অপরাধী অংশের বিচারে ছাড় দেওয়ার কথাও কেউ বলছে না। তবে এসব করতে গিয়ে নির্বাচন বিলম্বিত হলে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা গ্রাস করবে জাতিকে। নানা দিক দিয়ে ‘দুর্বল’ বলে বিবেচিত অন্তর্বর্তী সরকার তা সামলাতে পারবে বলেও মনে হয় না।
সরকার সবল হলে এবং মাঠে থাকা সব পক্ষের আস্থা অটুট রাখতে পারলেও নির্বাচনের জন্য কিছুটা বেশি সময় হয়তো নেওয়া যেত। অর্থনীতি বড় চ্যালেঞ্জে না থাকলেও হয়তো সম্ভবপর হতো সেটা। আর রাজনীতিতে অস্থিরতা ও ঝুঁকি কম থাকত। কিন্তু পরিস্থিতি তো জানা। চরম স্বেচ্ছাচারী একটি সরকারকে হটানোর পর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। সে কারণেও প্রয়োজন যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক পরিবেশে উত্তরণ। নির্বাচন সেই পথ প্রশস্ত করবে বৈ কি। এর ভেতর দিয়ে বিচার ও সংস্কারের দাবি নিভে যাবে বলে মনে করারও কারণ নেই। নির্বাচিত সরকার তেমন মনোভাব দেখালে জনগণ নিশ্চয় তাদের মার্জনা করবে না।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক