চলতি বছরের শুরুর দিকে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির ব্যবসায় ঋণের চাপ দ্রুত বাড়ছিল। ভারতের এই অন্যতম শীর্ষ ধনীকে তখন একে একে পুরোনো দেনা শোধ করতে হচ্ছিল।

কিন্তু গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ঘুষ ও জালিয়াতির মামলায় অভিযুক্ত হন ভারতের এই ধনী ব্যবসায়ী। প্রায় ৯০ বিলিয়ন বা ৯ হাজার কোটি ডলারের মালিক হলেও আমেরিকা ও ইউরোপের বড় ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে গড়িমসি করছিল। ঠিক সেই সময় নীরবে এগিয়ে আসে ভারত সরকার।

গত ২৪ অক্টোবর (যুক্তরাষ্ট্র সময়) দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের অনলাইন সংস্করণে এই খবর প্রকাশিত হয়।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে থাকা গোপন সরকারি নথি বলছে, মে মাসে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (ডিএফএস) রাষ্ট্রায়ত্ত লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এলআইসি) মাধ্যমে আদানি গ্রুপে প্রায় ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ৩৯০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে। যদিও এলআইসি মূলত দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে জীবনবিমা সেবা দেয়।

একই মাসে আদানির বন্দর ইউনিটের ৫৮৫ মিলিয়ন বা ৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ পুনঃঅর্থায়নের প্রয়োজন ছিল। সমপরিমাণ অর্থের জন্য একটি বন্ড ছাড়ে আদানি গ্রুপ। পরে জানা যায়, পুরো বন্ডে এককভাবে অর্থায়ন করে এলআইসি। সমালোচকেরা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন—এটা কি জনগণের অর্থের অপব্যবহার নয়?

নথি ও সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, এটি ছিল সরকারের বড় পরিকল্পনার অংশ। এর মধ্য দিয়ে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিকভাবে মদদপুষ্ট ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে অর্থ সরবরাহ করে সরকার।

ভারতের করপোরেট খাতের অর্থায়নবিষয়ক স্বাধীন বিশ্লেষক হেমেন্দ্র হাজারি বলেন, এই সরকার আদানিকে রক্ষা করবে, তার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।

সরকারি প্রণোদনা নয়, দাবি আদানির

আদানি গ্রুপ অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, এলআইসি অনেক কোম্পানিতেই বিনিয়োগ করে, কেবল আদানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে—এ ধারণা বিভ্রান্তিকর। এমনকি এলআইসি আদানি গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করে মুনাফাও করেছে। তারা আরও জানায়, ‘আমাদের প্রবৃদ্ধি মোদি সরকারের আগেই শুরু হয়েছে।’ তবে ভারতের সরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নীতি আয়োগ এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্টকে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

নথিতে দেখা যায়, নীতি আয়োগ, এলআইসি ও ডিএফএস মিলে এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করে। পরবর্তীকালে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন দেয়।

ডিএফএসের ভাষায়, এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল, আদানি গ্রুপের প্রতি বাজারের আস্থা পুনরায় তৈরিতে সহায়তা করা এবং অন্য বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা। তখন আদানি গ্রুপের অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না। তাদের মোট ঋণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে মামলা, দেশে প্রশ্রয়

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ আদানির বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণের অভিযোগ আনে। একই দিনে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসিও) আদানির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইনভঙ্গের মামলা করে। আদানি গ্রুপ পাল্টা জানায়, এসব অভিযোগ ‘ব্যক্তির বিরুদ্ধে’; এই গোষ্ঠীর কোম্পানির সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে শেয়ার কারচুপি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তোলে। এ ঘটনার সূত্রে ভারতের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) তদন্ত শুরু করে। আদানির বিরুদ্ধে করা হিন্ডেনবার্গের দুটি অভিযোগ সেবি খারিজ করলেও এখনো কিছু বিষয় অমীমাংসিত আছে।

রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের ঝুঁকি

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় এলআইসিকে প্রায় ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৩৪০ কোটি ডলার মূল্যের আদানির করপোরেট বন্ডে বিনিয়োগ এবং আরও ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলার ব্যয়ে কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে অংশীদারত্ব বাড়ানোর সুপারিশ করে। কারণ হিসেবে বলা হয়, সরকারি ১০ বছরের বন্ড থেকে আয় ছিল তুলনামূলক কম। তবে আদানির কোন কোন কোম্পানিতে এলআইসির অংশীদারি বেড়েছে, তা পরিষ্কার নয়।

আদানি গ্রুপের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক কাঠামো নিয়ে কাজ করেন অস্ট্রেলীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের পরিচালক টিম বাকলি। তিনি বলেন, ভারত সরকারের সমর্থন থেকে বোঝা যায়, আদানি ‘ভিন্ন নিয়মে’ ব্যবসা চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। বাকলি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, ভারতের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক কাজ আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, স্বজনতোষণনির্ভর পুঁজিবাদ এখনো বেঁচে আছে এবং দারুণভাবে তা চলছে।’

বন্ধুত্বের মূলধন

আদানির ব্যবসার শিকড় ভারতের গুজরাটে। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক উত্থানও সেখানেই। ১৯৯১ সালে মুন্দ্রায় গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার পর থেকেই মোদি-আদানির সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৪ সালে মোদির নির্বাচনী প্রচারণায় আদানি গ্রুপের বিমান ব্যবহার করেছেন। মোদির সঙ্গে গৌতম আদানির সখ্য নিয়ে ভারতের বিরোধী রাজনীতিকেরাও সব সময় সরব।

গৌতম আদানি আজ ভারতের অর্থনীতির প্রতিটি শাখায় জড়িয়ে আছে। যেমন দেশটির মোট পণ্য পরিবহনের ২৭ শতাংশ আদানির বন্দরের মাধ্যমে হয়; বিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে তিনি সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিনিয়োগকারী; এমনকি ২০২২ সালে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন এনডিটিভি অধিগ্রহণ করেন তিনি। এমনকি ওই সময় তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনীতে পরিণত হন। তাঁর সামনে ছিলেন কেবল ইলন মাস্ক।

ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত

ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় প্রস্তাব দেয়, প্রায় ৩৪০ কোটি ডলারের বন্ড বিনিয়োগের বড় অংশ এলআইসি যেন আদানি গোষ্ঠীর দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে করে। এর একটি হলো তাদের বন্দর ইউনিট আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড। ভারতীয় একটি ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থার হিসাবে, এই প্রতিষ্ঠানের ঋণমান ‘এএএ’ এবং তাদের মুনাফার হার ৭ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। যেখানে ১০ বছরের সরকারি বন্ডে আয় ছিল প্রায় ৭ দশমিক ২ শতাংশ।

আরেকটি প্রতিষ্ঠান ছিল তাদের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ইউনিট আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেড। তাদের ঋণমান ‘এএ’ এবং তারা বিনিয়োগে মুনাফার হার ছিল সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিচ এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণমান দিয়েছে মাত্র বিবিবি মাইনাস।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের আইনবিশেষজ্ঞ কুশ আমিনের ভাষায়, এলআইসি দরিদ্র মানুষের জীবনবিমা প্রতিষ্ঠান। এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ তাদের মূল লক্ষ্য ও দায়বদ্ধতার পরিপন্থী। তারা প্রকৃতই স্বাধীন সংস্থা হলে এই সিদ্ধান্ত নিত না।

আদানি গোষ্ঠী বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের বন্দর কোম্পানি আদানি পোর্টস, সিমেন্ট কোম্পানি আম্বুজা সিমেন্টস, পরিবেশবান্ধব গ্রিন এনার্জি ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন খাতের বেশ কিছু কোম্পানির ঋণ–নির্ভরতা কমছে। সেগুলোর ঋণমান ‘এএএ’। তবে কোম্পানি স্পষ্ট করে বলেনি, কোন ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এই মূল্যায়ন দিয়েছে।

এদিকে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন, প্রায় ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে এলআইসি যেন আদানির কয়েকটি কোম্পানিতে নিজেদের অংশীদারি বাড়ায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আদানি গ্রিন এনার্জিতে এলআইসির অংশীদারি ১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে এবং আম্বুজা সিমেন্টসে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হয়।

অস্ট্রেলীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের টিম বাকলির মতে, যখন আদানি নানা আইনি ও আর্থিক চাপে আছেন, ঠিক সেই সময় সরকারের এই সমর্থন তাঁকে কার্যত রক্ষা করছে; অর্থাৎ সম্পদ বিক্রি করতে হয়নি। বাকলির ভাষায়, যদি ভারতের সরকারই আদানিকে বারবার অর্থ জোগায়, তাহলে তিনি কেনই–বা নিজের সম্পদ বিক্রি করবেন? শেষ পর্যন্ত তো ভারতের জনগণকেই তাঁকে উদ্ধার করতে হচ্ছে।

(ভাষান্তরিত ও ঈষৎ সংক্ষেপিত)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র টন প স ট র সরক র সরক র র র ঋণম ন এন র জ ব যবস দশম ক বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

আদানিকে বাঁচাতে ৩৯০ কোটি ডলার দেওয়ার পরিকল্পনা মোদি সরকারের

চলতি বছরের শুরুর দিকে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির ব্যবসায় ঋণের চাপ দ্রুত বাড়ছিল। ভারতের এই অন্যতম শীর্ষ ধনীকে তখন একে একে পুরোনো দেনা শোধ করতে হচ্ছিল।

কিন্তু গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ঘুষ ও জালিয়াতির মামলায় অভিযুক্ত হন ভারতের এই ধনী ব্যবসায়ী। প্রায় ৯০ বিলিয়ন বা ৯ হাজার কোটি ডলারের মালিক হলেও আমেরিকা ও ইউরোপের বড় ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে গড়িমসি করছিল। ঠিক সেই সময় নীরবে এগিয়ে আসে ভারত সরকার।

গত ২৪ অক্টোবর (যুক্তরাষ্ট্র সময়) দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের অনলাইন সংস্করণে এই খবর প্রকাশিত হয়।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে থাকা গোপন সরকারি নথি বলছে, মে মাসে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (ডিএফএস) রাষ্ট্রায়ত্ত লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এলআইসি) মাধ্যমে আদানি গ্রুপে প্রায় ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ৩৯০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে। যদিও এলআইসি মূলত দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে জীবনবিমা সেবা দেয়।

একই মাসে আদানির বন্দর ইউনিটের ৫৮৫ মিলিয়ন বা ৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ পুনঃঅর্থায়নের প্রয়োজন ছিল। সমপরিমাণ অর্থের জন্য একটি বন্ড ছাড়ে আদানি গ্রুপ। পরে জানা যায়, পুরো বন্ডে এককভাবে অর্থায়ন করে এলআইসি। সমালোচকেরা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন—এটা কি জনগণের অর্থের অপব্যবহার নয়?

নথি ও সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, এটি ছিল সরকারের বড় পরিকল্পনার অংশ। এর মধ্য দিয়ে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিকভাবে মদদপুষ্ট ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে অর্থ সরবরাহ করে সরকার।

ভারতের করপোরেট খাতের অর্থায়নবিষয়ক স্বাধীন বিশ্লেষক হেমেন্দ্র হাজারি বলেন, এই সরকার আদানিকে রক্ষা করবে, তার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।

সরকারি প্রণোদনা নয়, দাবি আদানির

আদানি গ্রুপ অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, এলআইসি অনেক কোম্পানিতেই বিনিয়োগ করে, কেবল আদানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে—এ ধারণা বিভ্রান্তিকর। এমনকি এলআইসি আদানি গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করে মুনাফাও করেছে। তারা আরও জানায়, ‘আমাদের প্রবৃদ্ধি মোদি সরকারের আগেই শুরু হয়েছে।’ তবে ভারতের সরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নীতি আয়োগ এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্টকে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

নথিতে দেখা যায়, নীতি আয়োগ, এলআইসি ও ডিএফএস মিলে এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করে। পরবর্তীকালে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন দেয়।

ডিএফএসের ভাষায়, এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল, আদানি গ্রুপের প্রতি বাজারের আস্থা পুনরায় তৈরিতে সহায়তা করা এবং অন্য বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা। তখন আদানি গ্রুপের অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না। তাদের মোট ঋণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে মামলা, দেশে প্রশ্রয়

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ আদানির বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণের অভিযোগ আনে। একই দিনে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসিও) আদানির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইনভঙ্গের মামলা করে। আদানি গ্রুপ পাল্টা জানায়, এসব অভিযোগ ‘ব্যক্তির বিরুদ্ধে’; এই গোষ্ঠীর কোম্পানির সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে শেয়ার কারচুপি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তোলে। এ ঘটনার সূত্রে ভারতের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) তদন্ত শুরু করে। আদানির বিরুদ্ধে করা হিন্ডেনবার্গের দুটি অভিযোগ সেবি খারিজ করলেও এখনো কিছু বিষয় অমীমাংসিত আছে।

রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের ঝুঁকি

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় এলআইসিকে প্রায় ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৩৪০ কোটি ডলার মূল্যের আদানির করপোরেট বন্ডে বিনিয়োগ এবং আরও ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলার ব্যয়ে কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে অংশীদারত্ব বাড়ানোর সুপারিশ করে। কারণ হিসেবে বলা হয়, সরকারি ১০ বছরের বন্ড থেকে আয় ছিল তুলনামূলক কম। তবে আদানির কোন কোন কোম্পানিতে এলআইসির অংশীদারি বেড়েছে, তা পরিষ্কার নয়।

আদানি গ্রুপের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক কাঠামো নিয়ে কাজ করেন অস্ট্রেলীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের পরিচালক টিম বাকলি। তিনি বলেন, ভারত সরকারের সমর্থন থেকে বোঝা যায়, আদানি ‘ভিন্ন নিয়মে’ ব্যবসা চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। বাকলি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, ভারতের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক কাজ আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, স্বজনতোষণনির্ভর পুঁজিবাদ এখনো বেঁচে আছে এবং দারুণভাবে তা চলছে।’

বন্ধুত্বের মূলধন

আদানির ব্যবসার শিকড় ভারতের গুজরাটে। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক উত্থানও সেখানেই। ১৯৯১ সালে মুন্দ্রায় গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার পর থেকেই মোদি-আদানির সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৪ সালে মোদির নির্বাচনী প্রচারণায় আদানি গ্রুপের বিমান ব্যবহার করেছেন। মোদির সঙ্গে গৌতম আদানির সখ্য নিয়ে ভারতের বিরোধী রাজনীতিকেরাও সব সময় সরব।

গৌতম আদানি আজ ভারতের অর্থনীতির প্রতিটি শাখায় জড়িয়ে আছে। যেমন দেশটির মোট পণ্য পরিবহনের ২৭ শতাংশ আদানির বন্দরের মাধ্যমে হয়; বিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে তিনি সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিনিয়োগকারী; এমনকি ২০২২ সালে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন এনডিটিভি অধিগ্রহণ করেন তিনি। এমনকি ওই সময় তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনীতে পরিণত হন। তাঁর সামনে ছিলেন কেবল ইলন মাস্ক।

ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত

ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় প্রস্তাব দেয়, প্রায় ৩৪০ কোটি ডলারের বন্ড বিনিয়োগের বড় অংশ এলআইসি যেন আদানি গোষ্ঠীর দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে করে। এর একটি হলো তাদের বন্দর ইউনিট আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড। ভারতীয় একটি ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থার হিসাবে, এই প্রতিষ্ঠানের ঋণমান ‘এএএ’ এবং তাদের মুনাফার হার ৭ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। যেখানে ১০ বছরের সরকারি বন্ডে আয় ছিল প্রায় ৭ দশমিক ২ শতাংশ।

আরেকটি প্রতিষ্ঠান ছিল তাদের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ইউনিট আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেড। তাদের ঋণমান ‘এএ’ এবং তারা বিনিয়োগে মুনাফার হার ছিল সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিচ এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণমান দিয়েছে মাত্র বিবিবি মাইনাস।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের আইনবিশেষজ্ঞ কুশ আমিনের ভাষায়, এলআইসি দরিদ্র মানুষের জীবনবিমা প্রতিষ্ঠান। এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ তাদের মূল লক্ষ্য ও দায়বদ্ধতার পরিপন্থী। তারা প্রকৃতই স্বাধীন সংস্থা হলে এই সিদ্ধান্ত নিত না।

আদানি গোষ্ঠী বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের বন্দর কোম্পানি আদানি পোর্টস, সিমেন্ট কোম্পানি আম্বুজা সিমেন্টস, পরিবেশবান্ধব গ্রিন এনার্জি ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন খাতের বেশ কিছু কোম্পানির ঋণ–নির্ভরতা কমছে। সেগুলোর ঋণমান ‘এএএ’। তবে কোম্পানি স্পষ্ট করে বলেনি, কোন ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এই মূল্যায়ন দিয়েছে।

এদিকে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন, প্রায় ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে এলআইসি যেন আদানির কয়েকটি কোম্পানিতে নিজেদের অংশীদারি বাড়ায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আদানি গ্রিন এনার্জিতে এলআইসির অংশীদারি ১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে এবং আম্বুজা সিমেন্টসে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হয়।

অস্ট্রেলীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের টিম বাকলির মতে, যখন আদানি নানা আইনি ও আর্থিক চাপে আছেন, ঠিক সেই সময় সরকারের এই সমর্থন তাঁকে কার্যত রক্ষা করছে; অর্থাৎ সম্পদ বিক্রি করতে হয়নি। বাকলির ভাষায়, যদি ভারতের সরকারই আদানিকে বারবার অর্থ জোগায়, তাহলে তিনি কেনই–বা নিজের সম্পদ বিক্রি করবেন? শেষ পর্যন্ত তো ভারতের জনগণকেই তাঁকে উদ্ধার করতে হচ্ছে।

(ভাষান্তরিত ও ঈষৎ সংক্ষেপিত)

সম্পর্কিত নিবন্ধ