আগুনের বাংলাদেশ থেকে রক্ষার ব্যাপারে ইশতেহারে কি কিছু দেখব?
Published: 25th, October 2025 GMT
১৩ অক্টোবর ছিল আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন দিবস। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত পৃথক বাণী দিয়ে দেশের মানুষকে গালগল্প শোনান যে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ এখন দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বের রোল মডেল।
বাস্তবে প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনার পরে দেশের মানুষ দেখতে পায় আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে কয়লা হওয়া মানবদেহ। আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর গড়ে ১৮ লাখ মানুষ অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আগুনে ২১৪ জন মারা গেছে, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। জাপানে প্রতি ১ লাখে আগুনে মৃত্যু ০.
আমরা সব সময়ই বলে আসছি, বাংলাদেশের যেকোনো দুর্ঘটনায় যত বেশি মানুষ ঘটনাস্থলেই মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মারা যায় উদ্ধার না হতে পেরে বা উদ্ধার হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এই বিষয়ে আমরা দুজনই অনেক দিন ধরে সচেতন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অতীত বা বর্তমানের কেউই এখন পর্যন্ত কর্ণপাত করেনি।
আমাদের দেশে এই আটকা পড়ে মারা যাওয়ার ব্যতিক্রমী ঘটনা দেখা গেল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে। অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে পূর্বপ্রস্তুতি এবং অগ্নিঝুঁকি নিরসনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা থাকলে যেকোনো প্রকারের দুর্যোগ থেকে মানুষের জীবন বাঁচে, সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনার সম্ভব হয়। আমাদের বিল্ডিং কোড এবং ফায়ার লাইসেন্স নেওয়ার গাইডলাইনে এসব বিধান স্পষ্ট করে লেখা আছে। কিন্তু কেউ মানে না, এবং সরকারি কর্মচারীরা কেউ মানছে কি না দেখার চেয়ে নিজেদের অবৈধ সুবিধার দিকেই নজর দেন। ফায়ার কোড না মানার বিপরীত অবস্থা দেখা যায় ঢাকার মিরপুরের ঘটনাতে। শুধু ছাদের দরজা খোলা রাখলেই এই ১৬ জনের মৃত্যু আমাদের দেখা লাগত না—সেই হিসাবে এটা খুনের অপরাধের সমতুল্য কাজ। কিন্তু বিচার কি হবে?
সেই তাজরীন গার্মেন্টস বা রানা প্লাজার বিচার এখনো পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও হাতেনাতে প্রমাণ আছে।
পুরো বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হলো ঢাকার বিমানবন্দর। দেশের অন্যান্য স্থানে অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস বিভাগ আগুন সময়মতো নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার জন্য সব সময় যে যুক্তিগুলো শোনায় দেশের মানুষকে, যেমন চলাচলের জন্য সুপরিসর রাস্তার অভাব, মানুষের ভিড়, পানি সরবরাহের অভাব; যার কোনো যুক্তি বিমানবন্দরের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
গত সরকারের আমলে বনানীতে সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে অগ্নিনির্বাপণে জড়িত গাড়িগুলো থেকে নির্গত পানি ওপরের দিকের ফ্লোরগুলোতে পৌঁছাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট গাড়িগুলোতে উঁচু ভবনে অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় সিঁড়ির অভাবে। যেখানে সিঙ্গাপুর বা ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে ১৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছানোর সক্ষমতা রয়েছে, বাংলাদেশে অনেক জেলায় আগুন লাগার ঘণ্টাখানেক পরও দেখা যায় তথ্যই ঠিক জায়গায় পৌঁছায় নাই।
আরও পড়ুনএ শহরে আগুনে পুড়ে মানুষ মরে, আমাদের কোনো অনুভূতি নেই১৫ অক্টোবর ২০২৫দেশের সব আগুনের ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের যন্ত্রপাতি সনাতনি যুগের। ফায়ার সার্ভিসের ওয়েবসাইট অনুসারে, তাদের সেন্টার আছে সারা দেশে ৪৯০টি। প্রস্তাবিত জনবল ৩১ হাজার ১৬৯ জন। তাদের সর্বমোট ইকুইপমেন্ট বা যন্ত্রপাতি আছে ৪ হাজার ৩৯৪টি মাত্র। ২০২৪ সালে মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৬,৬৫৯টি। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত শুধু ওয়ার্কপ্লেস ফায়ার ইনসিডেন্টের ১৫২টি ঘটনা ঘটেছে, যাতে ১৩১ জন মারা গেছে এবং ৫৭৮ জন আহত হয়েছে।
সেই হিসাবে এত দুর্বল অবস্থানে থেকেও আমাদের ফায়ার সার্ভিসের ভাইয়েরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন, তা কিন্তু বলাই যায়। কিন্তু আমরা তাঁদের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই কি তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে ফেলছি না?
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বছরের পর বছর অবৈজ্ঞানিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে আমলা ও রাজনীতিবিদের হঠকারী সিদ্ধান্তে। ২০২০-২৪ সময়কালে কেবল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে ৭,০০০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে; কিন্তু এর বেশির ভাগেই জনসচেতনতা বা সক্ষমতা গঠনের উপাদান ছিল না।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দুর্যোগ প্রশমনে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে পরে খরচ করা টাকার ১০০ শতাংশই জলে গেছে। বাংলাদেশের অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা বাড়াতে বিগত সরকারগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও এখনো ব্যাপক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম আমদানিতে জটিল প্রক্রিয়া, এবং প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ পুরো বিশ্বের মধ্যে ১১তম দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত। প্রবাদে আছে, মোকাবিলা অপেক্ষা প্রতিরোধ শ্রেয়। বাংলাদেশের মতো নিম্ন সক্ষমতার দেশের জন্য দুর্যোগের পূর্ব সতর্কীকরণ ও ঝুঁকি হ্রাসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল হওয়া উচিত।এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় জনগণের জন্য দুর্যোগপূর্ণ পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কৌশল সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
আমাদের প্রথমেই দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য একটি ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে এ রকম সেন্টার দরকার, যেখানে মানুষ সহজেই যোগাযোগ করতে পারে। তার অধীন থাকবে জেলা পর্যায়ের ইউনিট। এরা কিন্তু সব রকমের দুর্যোগের জন্য (ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি) হবে। আমাদের এই সেন্ট্রালাইজ কন্ট্রোলটাই নেই। এটা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি বা জাপানের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের আদলে করা যেতে পারে। এরা দুর্যোগকালে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, এবং কোস্টগার্ডকে একক আদেশনামা ও সমন্বিত নেতৃত্বের নিচে আনার ব্যবস্থা করবে।
আরও পড়ুনআর কত শ্রমিক পুড়লে–মরলে যথেষ্ট মনে হবে২৩ অক্টোবর ২০২৫এখন আসি শুধু ফায়ার সার্ভিসের জন্য। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের উচ্চ-উচ্চতার অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিশেষায়িত উচ্চ-উচ্চতা অগ্নিনির্বাপণ ব্রিগেড গঠন করতে হবে।
২০২৪ সালের ঢাকার আগুনগুলোর মধ্যে ৭টি ছিল ১০ তলার বেশি ভবনে, কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কার্যকর সিঁড়ি ছিল মাত্র ৪টি স্টেশনে। ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকার জন্য ১০০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম এমন সিঁড়িযুক্ত অগ্নিনির্বাপক ট্রাক এবং অগ্নিনির্বাপনীয় ড্রোন সংগ্রহ করতে হবে, যা আকাশ থেকে অগ্নিনির্বাপক রাসায়নিক পদার্থ ছুড়তে সক্ষম হবে এবং উদ্ধারকাজে অংশ নিতে পারে।
প্রতিটি উপজেলাতে দরকার ১টি আধুনিক ফায়ার সার্ভিস ইউনিট, যাতে থাকবে ড্রোনসহ ডিজিটাল কমান্ড সেন্টার। নতুন অ্যাম্বুলেন্স ফায়ার হাইব্রিড গাড়ি কিনে যেকোনো ঘটনার ৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছানোর সক্ষমতা গঠন করতে হবে। যদিও এটা সফল হওয়া সম্ভব ঢাকার রাস্তায় স্পেশাল লেন এবং ছোট সাইজের গাড়ির ক্ষেত্রে। আমাদের ফায়ার ফাইটারদের বিদেশে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সরকার নিজের লোক দিয়ে এই ২০ কোটি মানুষকে সহায়তা দিতে পারবে না। এর জন্য সারা দেশে অন্তত ১ লাখ স্বেচ্ছাসেবককে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে উদ্ধারকাজের জন্য প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে এই সংখ্যা মাত্র ৬০০০। এই সংখ্যা বাড়াতে পারলে আরও ভালো। বিভাগীয় পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী অন্তত একটা হলেও হেলিকপ্টার দরকার। বর্তমান অবস্থায় বিমানবাহিনী থেকে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়।
ভবন নির্মাণ ও পরিচালনায় কড়াকড়ি আরোপ করে বার্ষিক/নিয়মিত ফায়ার সেফটি অডিট বাধ্যতামূলক করতে হবে। অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম আমদানির জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণে ২০০৩ সালের ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন’ আইন সংশোধন করে নতুন বিল্ডিং ফায়ার সেফটি কোড প্রণয়ন করতে হবে। এ ছাড়া শহুরে এলাকাগুলোতে ‘ফায়ার অ্যাকসেস রোড’ এবং ভবন ডিজাইনে ‘ইমার্জেন্সি রুফ এক্সিট’ বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে আটকে পড়ার ঝুঁকি কমে। ঢাকায় ৪২০০ বিল্ডিংয়ের ফায়ার লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ। যেসব অসাধু কর্মচারীর জন্য আইন বাস্তবায়ন হয় না, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এত কিছু করে কোনো লাভই হবে না। তবে আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিককে নিজস্ব স্থাপনার অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা এবং দুর্যোগকালীন প্রাথমিক করণীয় সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
যেহেতু এই সরকারের সময় শেষের দিকে, আমরা তাই আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছি। বিএনপির ৩১ দফার ২৯ নম্বর দফায় দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা আছে। আমরাও সেই কথা বলছি। তাই আগামী ইশতেহারে এই ব্যাপারে বিস্তারিত দেখতে চাই। অন্য দলের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু জানতে পারি নাই। আমরা এ ব্যাপারে সব দলের সচেতনতা আশা করি। কারণ, পূর্বপ্রস্তুতি শুধু জীবনই বাঁচায় না, বিশ্বব্যাংকের মতে এ ক্ষেত্রে যা বিনিয়োগ করা হবে তার ৬ গুণ সম্পদ রক্ষাও করে।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক কলামিস্ট।
মোস্তফা কামাল পলাশ আবহাওয়াবিদ, ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ান, কানাডা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র ঘটন প রকল প সরক র র প রশমন র জন য রক র র ন পর য উদ ধ র আম দ র প রস ত অবস থ ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
আগুনের বাংলাদেশ থেকে রক্ষার ব্যাপারে ইশতেহারে কি কিছু দেখব?
১৩ অক্টোবর ছিল আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন দিবস। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত পৃথক বাণী দিয়ে দেশের মানুষকে গালগল্প শোনান যে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ এখন দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বের রোল মডেল।
বাস্তবে প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনার পরে দেশের মানুষ দেখতে পায় আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে কয়লা হওয়া মানবদেহ। আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর গড়ে ১৮ লাখ মানুষ অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আগুনে ২১৪ জন মারা গেছে, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। জাপানে প্রতি ১ লাখে আগুনে মৃত্যু ০.২ জন; বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ১.২৮ জন।
আমরা সব সময়ই বলে আসছি, বাংলাদেশের যেকোনো দুর্ঘটনায় যত বেশি মানুষ ঘটনাস্থলেই মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মারা যায় উদ্ধার না হতে পেরে বা উদ্ধার হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এই বিষয়ে আমরা দুজনই অনেক দিন ধরে সচেতন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অতীত বা বর্তমানের কেউই এখন পর্যন্ত কর্ণপাত করেনি।
আমাদের দেশে এই আটকা পড়ে মারা যাওয়ার ব্যতিক্রমী ঘটনা দেখা গেল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে। অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে পূর্বপ্রস্তুতি এবং অগ্নিঝুঁকি নিরসনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা থাকলে যেকোনো প্রকারের দুর্যোগ থেকে মানুষের জীবন বাঁচে, সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনার সম্ভব হয়। আমাদের বিল্ডিং কোড এবং ফায়ার লাইসেন্স নেওয়ার গাইডলাইনে এসব বিধান স্পষ্ট করে লেখা আছে। কিন্তু কেউ মানে না, এবং সরকারি কর্মচারীরা কেউ মানছে কি না দেখার চেয়ে নিজেদের অবৈধ সুবিধার দিকেই নজর দেন। ফায়ার কোড না মানার বিপরীত অবস্থা দেখা যায় ঢাকার মিরপুরের ঘটনাতে। শুধু ছাদের দরজা খোলা রাখলেই এই ১৬ জনের মৃত্যু আমাদের দেখা লাগত না—সেই হিসাবে এটা খুনের অপরাধের সমতুল্য কাজ। কিন্তু বিচার কি হবে?
সেই তাজরীন গার্মেন্টস বা রানা প্লাজার বিচার এখনো পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও হাতেনাতে প্রমাণ আছে।
পুরো বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হলো ঢাকার বিমানবন্দর। দেশের অন্যান্য স্থানে অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস বিভাগ আগুন সময়মতো নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার জন্য সব সময় যে যুক্তিগুলো শোনায় দেশের মানুষকে, যেমন চলাচলের জন্য সুপরিসর রাস্তার অভাব, মানুষের ভিড়, পানি সরবরাহের অভাব; যার কোনো যুক্তি বিমানবন্দরের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
গত সরকারের আমলে বনানীতে সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে অগ্নিনির্বাপণে জড়িত গাড়িগুলো থেকে নির্গত পানি ওপরের দিকের ফ্লোরগুলোতে পৌঁছাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট গাড়িগুলোতে উঁচু ভবনে অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় সিঁড়ির অভাবে। যেখানে সিঙ্গাপুর বা ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে ১৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছানোর সক্ষমতা রয়েছে, বাংলাদেশে অনেক জেলায় আগুন লাগার ঘণ্টাখানেক পরও দেখা যায় তথ্যই ঠিক জায়গায় পৌঁছায় নাই।
আরও পড়ুনএ শহরে আগুনে পুড়ে মানুষ মরে, আমাদের কোনো অনুভূতি নেই১৫ অক্টোবর ২০২৫দেশের সব আগুনের ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের যন্ত্রপাতি সনাতনি যুগের। ফায়ার সার্ভিসের ওয়েবসাইট অনুসারে, তাদের সেন্টার আছে সারা দেশে ৪৯০টি। প্রস্তাবিত জনবল ৩১ হাজার ১৬৯ জন। তাদের সর্বমোট ইকুইপমেন্ট বা যন্ত্রপাতি আছে ৪ হাজার ৩৯৪টি মাত্র। ২০২৪ সালে মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৬,৬৫৯টি। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত শুধু ওয়ার্কপ্লেস ফায়ার ইনসিডেন্টের ১৫২টি ঘটনা ঘটেছে, যাতে ১৩১ জন মারা গেছে এবং ৫৭৮ জন আহত হয়েছে।
সেই হিসাবে এত দুর্বল অবস্থানে থেকেও আমাদের ফায়ার সার্ভিসের ভাইয়েরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন, তা কিন্তু বলাই যায়। কিন্তু আমরা তাঁদের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই কি তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে ফেলছি না?
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বছরের পর বছর অবৈজ্ঞানিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে আমলা ও রাজনীতিবিদের হঠকারী সিদ্ধান্তে। ২০২০-২৪ সময়কালে কেবল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে ৭,০০০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে; কিন্তু এর বেশির ভাগেই জনসচেতনতা বা সক্ষমতা গঠনের উপাদান ছিল না।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দুর্যোগ প্রশমনে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে পরে খরচ করা টাকার ১০০ শতাংশই জলে গেছে। বাংলাদেশের অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা বাড়াতে বিগত সরকারগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও এখনো ব্যাপক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম আমদানিতে জটিল প্রক্রিয়া, এবং প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ পুরো বিশ্বের মধ্যে ১১তম দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত। প্রবাদে আছে, মোকাবিলা অপেক্ষা প্রতিরোধ শ্রেয়। বাংলাদেশের মতো নিম্ন সক্ষমতার দেশের জন্য দুর্যোগের পূর্ব সতর্কীকরণ ও ঝুঁকি হ্রাসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল হওয়া উচিত।এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় জনগণের জন্য দুর্যোগপূর্ণ পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কৌশল সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
আমাদের প্রথমেই দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য একটি ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে এ রকম সেন্টার দরকার, যেখানে মানুষ সহজেই যোগাযোগ করতে পারে। তার অধীন থাকবে জেলা পর্যায়ের ইউনিট। এরা কিন্তু সব রকমের দুর্যোগের জন্য (ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি) হবে। আমাদের এই সেন্ট্রালাইজ কন্ট্রোলটাই নেই। এটা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি বা জাপানের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের আদলে করা যেতে পারে। এরা দুর্যোগকালে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, এবং কোস্টগার্ডকে একক আদেশনামা ও সমন্বিত নেতৃত্বের নিচে আনার ব্যবস্থা করবে।
আরও পড়ুনআর কত শ্রমিক পুড়লে–মরলে যথেষ্ট মনে হবে২৩ অক্টোবর ২০২৫এখন আসি শুধু ফায়ার সার্ভিসের জন্য। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের উচ্চ-উচ্চতার অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিশেষায়িত উচ্চ-উচ্চতা অগ্নিনির্বাপণ ব্রিগেড গঠন করতে হবে।
২০২৪ সালের ঢাকার আগুনগুলোর মধ্যে ৭টি ছিল ১০ তলার বেশি ভবনে, কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কার্যকর সিঁড়ি ছিল মাত্র ৪টি স্টেশনে। ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকার জন্য ১০০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম এমন সিঁড়িযুক্ত অগ্নিনির্বাপক ট্রাক এবং অগ্নিনির্বাপনীয় ড্রোন সংগ্রহ করতে হবে, যা আকাশ থেকে অগ্নিনির্বাপক রাসায়নিক পদার্থ ছুড়তে সক্ষম হবে এবং উদ্ধারকাজে অংশ নিতে পারে।
প্রতিটি উপজেলাতে দরকার ১টি আধুনিক ফায়ার সার্ভিস ইউনিট, যাতে থাকবে ড্রোনসহ ডিজিটাল কমান্ড সেন্টার। নতুন অ্যাম্বুলেন্স ফায়ার হাইব্রিড গাড়ি কিনে যেকোনো ঘটনার ৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছানোর সক্ষমতা গঠন করতে হবে। যদিও এটা সফল হওয়া সম্ভব ঢাকার রাস্তায় স্পেশাল লেন এবং ছোট সাইজের গাড়ির ক্ষেত্রে। আমাদের ফায়ার ফাইটারদের বিদেশে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সরকার নিজের লোক দিয়ে এই ২০ কোটি মানুষকে সহায়তা দিতে পারবে না। এর জন্য সারা দেশে অন্তত ১ লাখ স্বেচ্ছাসেবককে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে উদ্ধারকাজের জন্য প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে এই সংখ্যা মাত্র ৬০০০। এই সংখ্যা বাড়াতে পারলে আরও ভালো। বিভাগীয় পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী অন্তত একটা হলেও হেলিকপ্টার দরকার। বর্তমান অবস্থায় বিমানবাহিনী থেকে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়।
ভবন নির্মাণ ও পরিচালনায় কড়াকড়ি আরোপ করে বার্ষিক/নিয়মিত ফায়ার সেফটি অডিট বাধ্যতামূলক করতে হবে। অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম আমদানির জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণে ২০০৩ সালের ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন’ আইন সংশোধন করে নতুন বিল্ডিং ফায়ার সেফটি কোড প্রণয়ন করতে হবে। এ ছাড়া শহুরে এলাকাগুলোতে ‘ফায়ার অ্যাকসেস রোড’ এবং ভবন ডিজাইনে ‘ইমার্জেন্সি রুফ এক্সিট’ বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে আটকে পড়ার ঝুঁকি কমে। ঢাকায় ৪২০০ বিল্ডিংয়ের ফায়ার লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ। যেসব অসাধু কর্মচারীর জন্য আইন বাস্তবায়ন হয় না, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এত কিছু করে কোনো লাভই হবে না। তবে আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিককে নিজস্ব স্থাপনার অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা এবং দুর্যোগকালীন প্রাথমিক করণীয় সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
যেহেতু এই সরকারের সময় শেষের দিকে, আমরা তাই আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছি। বিএনপির ৩১ দফার ২৯ নম্বর দফায় দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা আছে। আমরাও সেই কথা বলছি। তাই আগামী ইশতেহারে এই ব্যাপারে বিস্তারিত দেখতে চাই। অন্য দলের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু জানতে পারি নাই। আমরা এ ব্যাপারে সব দলের সচেতনতা আশা করি। কারণ, পূর্বপ্রস্তুতি শুধু জীবনই বাঁচায় না, বিশ্বব্যাংকের মতে এ ক্ষেত্রে যা বিনিয়োগ করা হবে তার ৬ গুণ সম্পদ রক্ষাও করে।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক কলামিস্ট।
মোস্তফা কামাল পলাশ আবহাওয়াবিদ, ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ান, কানাডা