অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যায়ক্রমে ৮-৯ লাখ টন চাল আসবে। আমদানি শুরুর পর চালের দাম বাড়া বন্ধ হয়েছে। মোটা চাল যেটা আছে, সেটার দাম তিন থেকে পাঁচ টাকা কমেছে। আমরা আরও চাল আনতে থাকব। দাম বাড়ার আর সুযোগ দেব না বরং চালের দাম আরও কমবে।

গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা খাদ্যদ্রব্য খালাস কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে উপদেষ্টা নগরীর পতেঙ্গায় নির্মাণাধীন সাইলো পরিদর্শন করেন। এ সময় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড.

মো. জিয়াউদ্দিন, খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল খালেক ও বন্দর চেয়ারম্যান এস এম মনিরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কের অবনতি সত্ত্বেও ভারত থেকে চাল আমদানির প্রশ্নে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বাণিজ্যকে আমরা রাজনীতির সঙ্গে মিলাচ্ছি না। ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং সেখান থেকে আমদানি খরচ তুলনামূলক কম ও সস্তা। সে জন্য সেখান থেকে পণ্য আমদানি অব্যাহত আছে। পাশাপাশি মিয়ানমার আমাদের কাছে আরও চাল বিক্রি করতে চাচ্ছে। পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমরা আমদানির ব্যবস্থা করেছি। সব মিলিয়ে ৮-৯ লাখ টন চাল আসবে।’ 

আসন্ন রমজান মাস ঘিরে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তা নিয়ন্ত্রণে সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে? এমন প্রশ্নে উপেদষ্টা বলেন, ‘রমজান মাসে খাদ্য মন্ত্রণালয় বিশেষ করে চাল ও গম সবচেয়ে বেশি দেখাশোনা করে। বাকি কিছু আইটেম দেখভাল করে টিসিবি। তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। টিসিবিও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতি উপজেলায় প্রতিদিন দুই টন চাল বিক্রি শুরু হয়েছে এ মাস থেকে। রমজান মাসেও এটি থাকবে। সারাদেশে ৫০ লাখ লোকের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু হয়েছে।। দরিদ্র শ্রেণির ৫০ লাখ লোক মাসে ৩০ কেজি করে চাল পাবে ১৫ টাকা দরে। আশা করছি, রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য সহনশীল থাকবে।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: খ দ যপণ য রমজ ন ম স টন চ ল আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ভারতকে দূরে ঠেলে আমেরিকাকে যে মূল্য দিতে হবে

যে মুহূর্তে ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি শাস্তিমূলক হিসেবে স্পষ্টতই প্রতিভাত হচ্ছে, ঠিক সে মুহূর্তে দিল্লিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়াটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

মোদির বার্তাটি পরিষ্কার। সেটি হলো—ভারত একটি সার্বভৌম শক্তি এবং ‘পশ্চিম বনাম বাকি বিশ্বের’ দ্বন্দ্বে কোনো পক্ষ বেছে নিতে ভারতকে বাধ্য করা যাবে না। মোদির বার্তা হলো, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত তার নিজস্ব পথেই চলবে।

আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থে ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বড় শক্তি আর নেই। কারণ, ভারতের জনসংখ্যা বিশাল, ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ এবং ভারত পারমাণবিক ক্ষমতাসহ সামরিক শক্তির দিক থেকে চীনকে মোকাবিলা করার সক্ষমতা রাখে।

চীন এশিয়ায় আধিপত্য করতে চায় এবং একটা সময়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে সরিয়ে দিতে চায়। চীনের এই উচ্চাভিলাষ ভারতই ঠেকিয়ে দিতে পারে।

আরও পড়ুনট্রাম্প আবার যেভাবে মোদিকে ধোঁকা দিলেন২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় থেকেই মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা বুঝে গিয়েছিলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য ধরে রাখতে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার অংশীদারি অত্যন্ত জরুরি।

এটা শুধু কথার কথা ছিল না। গত দশকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত নিরাপত্তা সম্পর্ক দ্রুত গভীর হয়েছে। বিশেষত সামরিক সমন্বয়, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং প্রযুক্তি সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই দুই দেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

এই অগ্রগতির একটি অংশ হয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময়। তখন তিনি চীনের ওপর চাপ বাড়ান এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তা সহায়তা কমিয়ে দেন। এর ফলে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা আরও বাড়ে।

ভারত তখন তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এর ফল আজ স্পষ্ট—ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি যৌথ সামরিক মহড়া করে। যুক্তরাষ্ট্রই এখন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার।

যুক্তরাষ্ট্র বহুবার ভারতের স্বার্থ উপেক্ষা করেছে। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা শুরু করলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে তারা ভারতের কাছ থেকে পূর্ণ আনুগত্য আশা করেছিল। কিন্তু ভারত ইসরায়েল ও তুরস্কের মতো অন্যান্য মার্কিন মিত্রদের মতো এই চাপ মানেনি। বরং ভারত রাশিয়ার সস্তা তেলের আমদানি আরও বাড়ায়।

কিন্তু এসব অগ্রগতি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এমন অনেক কাজ করেছে, যা ভারতের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলভাবে বের হয়ে যাওয়া (যা বাইডেনের সময়ে ঘটলেও মূল চুক্তি ট্রাম্প করেছিলেন) মার্কিন নেতৃত্বের বিচক্ষণতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে। কারণ, এই পদক্ষেপে কার্যত আফগানিস্তান আবার তালেবানের দখলে ফিরে যায়।

২০২২ সালে উদ্বেগ আরও বাড়ে। কারণ, বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানকে আইএমএফ থেকে ঋণ পেতে সাহায্য করে। এরপর তারা পাকিস্তানের মার্কিন তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলো আধুনিকায়নের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের এক চুক্তি অনুমোদন করে। এতে শীতল যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে আমেরিকার অস্ত্র দেওয়ার তিক্ত স্মৃতি আবার ভারতের সামনে চলে আসে।

ট্রাম্পও পাকিস্তানের প্রতি এই সমর্থন আরও বাড়িয়েছেন। এর একটি বড় কারণ ছিল ব্যক্তিগত লাভ, যা কিনা ২০২৪ সালের এপ্রিলে করা লাভজনক ক্রিপ্টোকারেন্সি চুক্তিতে স্পষ্ট হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বহুবার ভারতের স্বার্থ উপেক্ষা করেছে। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা শুরু করলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে তারা ভারতের কাছ থেকে পূর্ণ আনুগত্য আশা করেছিল। কিন্তু ভারত ইসরায়েল ও তুরস্কের মতো অন্যান্য মার্কিন মিত্রদের মতো এই চাপ মানেনি। বরং ভারত রাশিয়ার সস্তা তেলের আমদানি আরও বাড়ায়।

আরও পড়ুনট্রাম্পের ধাক্কায় হতভম্ব মোদি যে কঠিন শিক্ষা নিচ্ছেন০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভারত মনে করেছে ইউক্রেন যুদ্ধ অনেক দূরের সংঘাত। এই সংঘাতের কারণে ভারত নিজের স্বার্থ ঝুঁকিতে ফেলতে চায়নি। বিশেষ করে ভারত যখন দেখেছে, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের চাপের সুযোগ নিয়ে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় জ্বালানি কিনছে, তখন ভারত রুশ জ্বালানি কেনা থেকে বিরত থাকতে পারেনি।

ভারত আগেও এমন পরিস্থিতি দেখেছে। ২০১৯ সালে ট্রাম্প যখন ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ফের আরোপ করেন, তখন ভারত তার সবচেয়ে সস্তা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি উৎসগুলোর একটি হারায়। আর সেই সুযোগে চীন ইরানের তেল অত্যন্ত কম দামে কিনতে শুরু করে এবং সেখানে নিজেদের নিরাপত্তা উপস্থিতি বাড়ায়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরও একই ধারা দেখা যায়। পশ্চিমা বাজার থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার ফলে নিষেধাজ্ঞাগুলো রাশিয়ার ওপর চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব আরও বাড়ায়।

চীন রাশিয়া থেকে স্থলপথে জ্বালানি আমদানির পথ শক্তিশালী করেছে। ফলে চীন এখন জানে, তাইওয়ান নিয়ে তারা যাই করুক, রাশিয়ার জ্বালানি পেতে তার কোনো সমস্যা হবে না। এই প্রবণতা নিঃসন্দেহে ভারতের কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। তবে এবার ভারতও সস্তা রাশিয়ান তেলের সুবিধা নিতে পেরেছে।

আরও পড়ুনমোদি কোন বিশ্বাসে চীনের দিকে ঝুঁকলেন ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের এই সিদ্ধান্তকে সহজভাবে নেয়নি। তারা ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক বসায়। ফলে মোট শুল্ক দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। পাশাপাশি তারা ভারতের বিরুদ্ধে গৌণ নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়। তারা দাবি করে ভারত নাকি ‘রাশিয়ার ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড’ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় বাধা দিচ্ছে।

অথচ ট্রাম্প রাশিয়ার তেল আমদানিকারী অন্য বড় দেশগুলোকে ছাড় দিয়েছেন। তিনি হাঙ্গেরিকে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন, কারণ হাঙ্গেরির স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর অরবান ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র।

এখন ভারতের ওপর মার্কিন শুল্কহার চীনের রপ্তানির ওপর আরোপিত শুল্ককেও ছাড়িয়ে গেছে। এটি কার্যত ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকার একধরনের অর্থনৈতিক যুদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্র মুখে বলে ভারত অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তবে তারা ভারতের স্বার্থকে গৌণ মনে করে। তারা চায়, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে ভারত এক প্রধান স্তম্ভ হোক। কিন্তু তাদের নীতিই ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

আরও পড়ুনমোদি ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনের কাছে আনছেন কেন২৬ অক্টোবর ২০২৪

ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি বেশি অস্থির হলেও আমেরিকার মূল প্রবণতা বহু প্রশাসন ধরে একই রয়েছে। এর ফলে ভারত এখন ক্রমে ক্ষুব্ধ ও অবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। তাই ভারত নিজের সক্ষমতা বাড়ানো এবং বিকল্প অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর শুরুটা তারা রাশিয়া দিয়েই করেছে।

পুতিনের দিল্লি সফর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সতর্কবার্তা হওয়া উচিত। কারণ, আমেরিকা চাপ সৃষ্টি করলে এবং নীতি বদলাতে থাকলে সম্পর্ক শুধু দুর্বলই হবে।

আমেরিকার মনে রাখা দরকার, চীনের আগ্রাসী উত্থান ঠেকানোর জন্য ভারতের সঙ্গে স্বার্থভিত্তিক নমনীয় ‘নরম জোট’ তৈরি করা আমেরিকার হাতে থাকা অল্প কিছু কার্যকর উপায়ের একটি। সেদিক থেকে দেখলে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ভারতকে যতটা দরকার, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রকে তার চেয়ে কম দরকার।

তাই ভারতকে ‘লাইন মেনে চলতে’ বাধ্য করার চেষ্টা না করে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ভারতকে সমমর্যাদার অংশীদার হিসেবে দেখা। অর্থাৎ ভারত যেমন আছে তাকে তেমনভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণ করা উচিত। যেমনটা মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা চাইছেন তেমন করে ভারতকে গড়তে যাওয়া তাদের উচিত হবে না।

ব্রহ্ম চেলানি দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিভাগের ইমেরিটাস প্রফেসর।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ