লিচুর ফলনে এমন বিপর্যয় ৬০ বছরেও দেখেননি চাষি
Published: 2nd, May 2025 GMT
পাবনা সদর উপজেলার দাপুনিয়া গ্রামের চাষি নুরুল ইসলাম। ৯৬ বিঘা জমিতে লিচু বাগান রয়েছে তাঁর। গত বছর মুকুল এলে বিক্রি হয়েছিল ৭৮ লাখ টাকায়। এবার ১ টাকায়ও বিক্রি করতে পারেননি। তাঁর ভাষ্য, আত্মীয়স্বজনকে দেওয়ার মতো লিচুও নেই। ঈশ্বরদীর বাশেরবাদা গ্রামের চাষি আবুল কালাম আজাদ বলছিলেন, ‘আমার ৬০ বছরের জীবনে বাগানের গাছে এত কম লিচু দেখিনি।’
লিচু উৎপাদনের জন্য খ্যাতি রয়েছে পাবনার ঈশ্বরদী ও সদর উপজেলার। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয় ফলটি। চলতি মৌসুমে লিচুর রাজধানীখ্যাত ঈশ্বরদীতে ফলনে বিপর্যয় ঘটেছে।
বুধবার সদর ও ঈশ্বরদী উপজেলার অন্তত ১৫টি লিচু বাগান ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ গাছে গুটি বা মুকুল নেই। যেসব গাছে গুটি আছে, তা সংখ্যায় খুব কম। আগে একটি থোকায় ৫০-৬০টি লিচু থাকলেও এবার আছে পাঁচ-সাতটি। গাছে শুধু নতুন পাতা। চাষিরা আক্ষেপ করে বলেছেন, লিচুর ফলনে এমন বিপর্যয় আগে দেখেননি।
এর কারণ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্রকে দুষছেন কিছু চাষি, বাগান মালিক ও জনপ্রতিনিধি। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়াসহ কয়েকটি কারণে এলাকার লিচুগাছে এবার ফলন কমেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে, চলতি বছর পাবনায় ৪ হাজার ৭৭৮ হেক্টর জমির বাগানে লিচুগাছ রয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার ৭৯০ টন। এ লক্ষ্য অর্জন হবে না বলে আশঙ্কা করছেন কৃষিবিদ ও বাগান মালিকরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাবনার লিচুর সুনাম সারাদেশে। বাগান করে অনেকেই লাভবান হয়েছেন। এবারও ভালো ফলনের আশা করছিলেন তারা। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেন বাগান মালিকরা। সদর উপজেলার দাপুনিয়া, মাধাপুর, নাজিরপুর, ঈশ্বরদীর আওতাপাড়া, সিলিমপুর, সাহাপুর, রূপপুর, বক্তারপুর, জয়নগর, রূপপুর, চররূপপুর, তিনগাছা, বাঁশেরবাদা এবং আটঘরিয়া ও চাটমোহরে শত শত বিঘা বাগানে সারি সারি লিচু গাছ রয়েছে।
এরই মধ্যে জেলার বাগানগুলোর গাছে লিচুর মুকুল ও গুটি সেভাবে আসেনি, নতুন পাতায় ছেয়ে গেছে বাগান। কৃষি বিভাগ ও চাষিরা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবার এক-দশমাংশ গাছে মুকুল ও গুটি এসেছে, ৯০ শতাংশে আসেনি। গত বছর ৩০ শতাংশ গাছে মুকুল ছিল। এতে হতাশ বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। যেসব গাছে কিছু গুটি আছে, সেগুলোর পরিচর্যা করছেন তারা। পানি, সেচসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখছেন।
আওতাপাড়া গ্রামের চাষি টুটুল হোসেন বলেন, পাবনা শহর থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেতে সড়কের দুই পাশে অনেক লিচু বাগান রয়েছে। পাবনার অংশে যত বাগান আছে, সেখানে কিছু লিচুর মুকুল এলেও রূপপুরের দিকে শুধু নতুন পাতা। ঈশ্বরদীর ছলিমপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো.
এবার মুকুল আসার সময় ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাপক বৃষ্টি হওয়ায় ফলন অস্বাভাবিক কম হয়েছে বলে জানান পাবনা খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক। তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র এ জন্য দায়ী নয়।
একই ধরনের কথা বলেছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ নাজমুল
ইসলাম। তিনি বলেন, বৈরী আবহাওয়া, পরাগায়ণনে জটিলতা ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার লিচুর মুকুল ও গুটি কম হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে এ ফলন বিপর্যয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’
তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’
ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।
ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’
পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।
গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।
তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।
দারফুর থেকে পালিয়ে আসা লোকজন তাবিলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫