বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাকা উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের (সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংক) ৫৩ শতাংশ শেয়ার কিনেছিল সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ। কিন্তু এখন ব্যাংকে আর নিয়ন্ত্রণ নেই। ২০০৮ সালে নিলামের যাবতীয় শর্ত মেনে ব্যাংকটিতে ৩৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এই বিদেশি গ্রুপটি। এরই মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পুরোনো বিনিয়োগকারীরা মামলা করায় ব্যাংকটির শেয়ার কেনাবেচা আটকে যায়। ফলে ব্যাংকটির বিনিয়োগ করে আটকা পড়ে যায় আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকায় চলতি বছরের এপ্রিলে পর্ষদ বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এমন পরিস্থিতিতে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ক্ষতিপূরণ চায় আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ। ব্যাংকের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ না পেলে বিনিয়োগ ফেরত চায় এবং তা না হলে এই বিরোধ নিষ্পত্তিতে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কথা বলছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ।

৭ জুলাই পুরো বিষয়টি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন আইসিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান জোসেফিন সিভারেতনাম। একই চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনকে (আশিক চৌধুরী)। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরা আপনার কাছে দ্রুত উদ্যোগ আশা করি। অন্যথায় ন্যায়বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া ছাড়া আর বিকল্প নেই।’

চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘২০০৮ সালের চুক্তিতে উল্লেখ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের শেয়ার ছাড়বে এবং আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ শেয়ারগুলো গ্রহণ করবে; যা চুক্তি কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকে সব ধরনের দায়মুক্ত। এই আশ্বাসের ভিত্তিতে আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ ২০০৮ সালে তৎকালীন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে ৩৫০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে। কিন্তু এই আশ্বাস মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, কারণ ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের সাবেক শেয়ারধারীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে। এই মামলাগুলো এখনো সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। আমরা মনে করি, আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপের স্বার্থ সুরক্ষিত নয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এই আইনি বাধাগুলো সমাধানে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরা আরও মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক চুক্তির অধীনে তার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করেছে এবং তাই চুক্তিটি এখন বাতিল ও অকার্যকর।’

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপের শেয়ারধারীদের স্বার্থ ক্রমাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাংকটিতে আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপের বিনিয়োগ নিরাপদ ও সুরক্ষিত এবং তারা ব্যাংকের সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারহোল্ডার এবং তাদের শেয়ার দায়মুক্ত, বাংলাদেশ ব্যাংক কখনো এই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। এ ছাড়া আমাদের নিয়োগ দেওয়া নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগও অনুমোদন দেয়নি; বরং বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

গভর্নরের কাছে দেওয়া চিঠিতে আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ জানিয়েছে, শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে কোনো বিনিয়োগকারী এই ব্যাংকে কোনো অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না। কোনো কৌশলগত বিনিয়োগকারীও এমন একটি প্রতিষ্ঠানে নতুন বিনিয়োগ করতে দ্বিধা করবে। কারণ, এখানে মালিকানার অনিশ্চয়তা রয়েছে। শেয়ার হস্তান্তর না করার হাইকোর্টের রায় শেয়ারের অবাধ লেনদেনে একটি বাধা হিসেবে কাজ করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ আগ্রহ নিয়ে ব্যাংকটিতে বিনিয়োগ করেছিল। এখন রাষ্ট্রীয় সহায়তায় আইনি সমাধান হলে ভালো হয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ওর য় ন ট ল ব য ব ন য় গ কর আইস ব

এছাড়াও পড়ুন:

প্রবাসীদের ভোটে আনার চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ‘প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট নিশ্চিত’ করার ঘোষণার পর তাঁদের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে ব্যাপক প্রত্যাশা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রতিনিধিত্বের বিষয় বিবেচনা এবং একই সঙ্গে প্রবাসী ভোটিংয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও সরকারের কাছে জমাকৃত প্রতিবেদনে একটি আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করে সব প্রবাসী বাংলাদেশিকে যত দ্রুত সম্ভব ভোটার তালিকায় নিবন্ধন ও তাঁদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সুপারিশ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রবাসী ভোটিং শুরু করার জন্য কাজ করছে।

দেশের প্রধান নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২–এর ২৭(১) ধারার মাধ্যমে বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি ভোটারদেরকে ডাকযোগে ব্যালটে ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ২০০৮ সালে উক্ত আইনি অধিকার দেওয়ার বছরেও প্রবাসীদের জন্য কখনোই পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থায় ভোট গ্রহণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ২০০৮-২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো প্রবাসী ভোটার ভোট দিতে পারেননি।

২০০৮ সালে আইনি বিধান করার আগে দুজন নির্বাচন কমিশনার অনাবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে যুক্তরাজ্য সফর করেন। ওই আলোচনায় বেশির ভাগ অনাবাসী বাংলাদেশি দূতাবাসে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করে ব্যক্তিগতভাবে ভোট প্রদানের প্রক্রিয়া চালু করার পরামর্শ দেন। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে এ প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে নূরুল হুদা কমিশন সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণে একটি সেমিনার আয়োজন করে। এ সেমিনারের সুপারিশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের সচিবের নেতৃত্বে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। ২০২০–এর নভেম্বর মাসে কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হবে।

প্রবাসী ভোটিং নিশ্চিত করতে নাসির কমিশন ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটি বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা, প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেসব দেশে অবস্থান করছেন, সেসব দেশের বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ওই সব দেশের সময়ের ব্যবধান বিবেচনা করে প্রাথমিকভাবে প্রক্সি ভোটিং, পোস্টাল ভোটিং ও অনলাইন ভোটিং নিয়ে খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট মতামত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দুটি দল ব্যতীত সব দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই প্রবাসী ভোটিং চালু করার পক্ষে। যদিও কোন পদ্ধতিতে এটি নিশ্চিত করা হবে, সে বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। আমার জানামতে, কমিশন বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শক্রমে সম্ভাব্য পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে।

প্রবাসী ভোটিং খুব সহজ নয়। এর প্রতিটি পদক্ষেপেই চ্যালেঞ্জ আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভোটার নিবন্ধনপ্রক্রিয়া থেকেই চ্যালেঞ্জ শুরু হয়। ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএর (২০২১-২২) এক জরিপ থেকে দেখা যায়, জরিপ করা ৮৭ শতাংশ দেশে প্রবাসী ভোটার রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সক্রিয় নয়। ফলে অনেক ভোটারের ছবি তোলা বা বায়োমেট্রিক দেওয়ার জন্য দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে যেতে চান না। আবার নির্বাচন কমিশন কত সময়ের জন্য প্রবাসী হিসেবে নিবন্ধন দেবে, সেটা আরেক জটিলতা। কারণ, একজন প্রবাসী ভোটার নির্বাচনের অব্যবহিত আগে নিবন্ধিত হয়ে নির্বাচনের পরই স্থায়ীভাবে ওই দেশ ত্যাগ করতে পারেন। যে কারণে অনেক দেশ শুধু একটি নির্বাচনের জন্য, আবার কোনো কোনো দেশ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রবাসীদের নিবন্ধন দিয়ে থাকে। এসব জটিলতার কারণে উল্লিখিত জরিপ অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রবাসী ভোটারদের গড় নিবন্ধন হার মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ।

শুধু নিবন্ধন নয়, প্রবাসী ভোটিংয়ের যে কয়টি পদ্ধতি আছে, তার প্রতিটির দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জ আছে। তারপরও কোনো কোনো দেশে প্রবাসীদের ভোট প্রদানের হার উল্লেখ করার মতো। ওই জরিপ অনুযায়ী এ রকম দেশের সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ।

উদাহরণ হিসেবে স্লোভাকিয়া ও রাশিয়ার কথা বলা যেতে পারে। স্লোভাকিয়ায় ২০২০ সালের সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৪৪ লাখ ৩২ হাজার ৪১৪ জন এবং সার্বিক ভোট প্রদানের হার ছিল ৬৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। ওই সময় দেশটির প্রবাসী ভোটারের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ১১৬ জন এবং ভোট প্রদান করেছিল ৩ হাজার ৮৬১ জন ভোটার (৯৩.৮০%)।

প্রবাসী ভোটার সংখ্যা কম থাকায় এবং তাদের অবস্থান অল্প কয়েকটি দেশে থাকায় সফলতার সঙ্গে দেশটি প্রবাসী ভোটিং কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পেরেছিল। অন্যদিকে রাশিয়ার ২০১৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ১০ কোটি ৯০ লাখ ৮ হাজার ৪২৮ জন ও সার্বিক ভোট প্রদানের হার ছিল ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ওই সময় দেশটির প্রবাসী ভোটারের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৯৫৭ জন এবং ভোট প্রদান করেছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৩৬৬ জন ভোটার (৯৮.০২%)। বলা বাহুল্য, রাশিয়ার ওই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে প্রবাসী ভোটিং পাইলটিং করার উদ্যোগের জন্য আমি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে সতর্কতার সঙ্গে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা, যেসব দেশ সফলভাবে সম্পাদন করতে পেরেছে এবং যেসব দেশ এখনো সফল হতে পারেনি, সেসব দেশের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে আশা করি।

অন্যদিকে যেসব দেশে প্রবাসীদের ভোট প্রদানের হার ২০ শতাংশের কম, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গুয়াতেমালা (১.১৫%), পর্তুগাল (১.৮৮%), আর্জেন্টিনা (২.৭৯%), আলজেরিয়া (৪.৬৮%) এবং ইউক্রেন (৭.২৭%)। ভোটার নিবন্ধন ও ভোট প্রদান প্রক্রিয়ায় চ্যালেঞ্জের কারণে ভোট প্রদানের হার এত কম।

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবাসী ভোট গ্রহণকারী দেশ ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন। ভারত ব্যক্তিগতভাবে হাজির হয়ে, মালয়েশিয়া পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে, সিঙ্গাপুর ব্যক্তিগতভাবে হাজির হয়ে কিংবা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে, ইন্দোনেশিয়া ব্যক্তিগতভাবে হাজির হয়ে কিংবা ব্যালটের মাধ্যমে কিংবা মোবাইল ব্যালটের মাধ্যমে, থাইল্যান্ড ব্যক্তিগতভাবে হাজির হয়ে প্রধানত আগাম ভোটিংয়ের মাধ্যমে এবং ফিলিপাইন ব্যক্তিগতভাবে হাজির হয়ে কিংবা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে কিংবা সীমিত ইন্টারনেট ভোটিংয়ের মাধ্যমে ভোট প্রদান করে। এসব দেশে প্রবাসী ভোট প্রদানের হার আলাদাভাবে ৩৫ শতাংশের বেশি নয়।

উদাহরণ হিসেবে এশিয়ার দুটি দেশ নিয়ে আলোচনা করা হলো। ভারত ২০১০ সাল থেকে প্রবাসী ভোটিং চালু করে। ২০২৪ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ভারতের অনাবাসী জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মাত্র ১১ হাজার ৮৪৬ জন প্রবাসী ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছিল এবং তাদের ক্ষুদ্র একটা অংশ ভোট দিয়েছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯৯ হাজার ৮৪৪ এবং ২৫ হাজার ৬০৬ জন। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৪ ও ২ হাজার ৯৫৮ জন (২.৪%)। দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা থেকে দেখা যায়, ভোটাররা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দূতাবাসে গিয়ে ভোট প্রদানে উৎসাহ দেখান না।

২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় সশস্ত্র বাহিনী, সরকারি কর্মচারী ও ছাত্রদের জন্য প্রবাসী ভোটিং চালু ছিল। ২০১১ সালে সংসদের সিলেক্ট কমিটি বিদেশে বসবাসকারী সব মালয়েশিয়ানের জন্য প্রবাসী ভোট চালু করার পরামর্শ দিলে আইন সংশোধন করা হয়।

নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রবাসী ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত দূতাবাসে ভোটাররা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেয়। বর্তমানে দেশটি অনলাইনে ভোটার নিবন্ধন ও পোস্টাল ভোটিং প্রক্রিয়ায় প্রবাসী ভোট নিশ্চিত করে। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রবাসী ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছিল ৫৪ হাজার জন।

সারা বিশ্বে বর্তমানে ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বসবাস করেন, যাঁদের বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাংলাদেশি প্রবাসীরা বসবাস করেন। তাঁদের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় আনুমানিক ১৩ লাখ ৮২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যে ৭৯ লাখ, ইউরোপে ১৮ লাখ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৭ লাখ, আফ্রিকায় তিন লাখ, ওশেনিয়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার, দক্ষিণ এশিয়ায় এক লাখ, পূর্ব এশিয়ায় ৭৮ হাজার এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ২ হাজার ৫০০ জন বসবাস করেন। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতির কারণে আগামী নির্বাচনে কোনোভাবেই সব দেশে প্রবাসী ভোটিং চালু করা সম্ভব নয়।

উল্লেখ্য যে নির্বাচন কমিশন ২০২৩ সাল থেকে শুরু করে সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৯টি দেশে প্রবাসী ভোটারদের জন্য নিবন্ধন চালু করতে পেরেছে। জানামতে, আরও সাতটি দেশে শিগগিরই নিবন্ধন শুরু হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৪২ হাজারের মতো প্রবাসী ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ ইতিমধ্যে ভোটার তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, বিশেষ করে যাঁরা ২০০৮ সালের পর প্রবাসী হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন।

প্রবাসী ভোটিং চালু করতে গেলে আইন সংশোধন, একটি নিবন্ধন প্ল্যাটফর্ম তৈরি, ভোট প্রদানের প্রক্রিয়া নির্ধারণ ও প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি, ভোটার নিবন্ধন ও ভোট প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণাসহ ব্যাপকভিত্তিক এবং সময়সাপেক্ষ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এত ব্যাপকতা ও জটিলতার কারণে অ্যাঙ্গোলা ১৯৯২ প্রবাসী ভোটিংবিষয়ক আইন প্রণয়ন করে ২৯ বছর পর ২০২১ সালে আইনে সংশোধন এনে ২০২২ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রবাসী ভোটিং চালু করতে সমর্থ হয়। তা সত্ত্বেও দেশটির ৪ লাখ প্রবাসীর মধ্যে মাত্র ২২ হাজার মানুষ ওই নির্বাচনের জন্য নিবন্ধন করে।

আগেই বলেছি, প্রবাসী ভোটিংয়ের প্রতিটি পদ্ধতির দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জ আছে। যেমন বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মাধ্যমে পোস্টাল ভোটিং করলে খরচ হবে ভোটারপ্রতি ৭০০ টাকা। কুরিয়ারের মাধ্যমে এই ব্যয় পাঁচ হাজার টাকার মতো। খরচের কারণে অনেক দেশ প্রবাসী ভোটারদের কাছ থেকে এই ব্যয় সংকুলান করে। এ ছাড়া পোস্টাল ব্যালটে বিশ্বব্যাপী গড় সিস্টেম লস ২৪ শতাংশ। শেষ মুহূর্তে কোনো আসনের প্রার্থিতায় পরিবর্তন এলে পোস্টাল ভোটিং অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

প্রক্সি ভোটিংয়ের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে ভোটারের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটার সম্ভাবনা এবং অন্তত একজনের কাছে ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারা। তবে প্রক্সি ভোটিং সবচেয়ে সহজ এবং ব্যয়ও কম। অন্যদিকে দূতাবাসে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করে ব্যক্তিগতভাবে ভোট আয়োজনে অনেক দেশই অনুমোদন দেবে না।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে প্রবাসী ভোটিং পাইলটিং করার উদ্যোগের জন্য আমি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে সতর্কতার সঙ্গে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা, যেসব দেশ সফলভাবে সম্পাদন করতে পেরেছে এবং যেসব দেশ এখনো সফল হতে পারেনি, সেসব দেশের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে আশা করি।

আমরা যেন প্রবাসী ভোটিং চালু করতে গিয়ে হোঁচট না খাই ও তাড়াহুড়া না করি। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর অনেক দেশ বছরের পর বছর ধরে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার পর পাইলটিং শুরু করেছে।

ড. মো. আব্দুল আলীম নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। সদ্য সাবেক নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রবাসীদের ভোটে আনার চ্যালেঞ্জ