ভারতের হামলার পর কী জবাব দেবে পাকিস্তান, সামনে চারটি বড় প্রশ্ন
Published: 9th, May 2025 GMT
ভারত গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে এক নাটকীয় অভিযানে চালানোর পর জানায়, তারা পাকিস্তান ও পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মোট নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালিয়েছে। তাদের দাবি ‘বিশ্বস্ত গোয়েন্দা তথ্যে’র ভিত্তিতে ‘সন্ত্রাসীদের’ ঘাঁটি চিহ্নিত করে এ হামলা চালানো হয়েছে।
ভারতীয় সময় গভীর রাত ১টা ৫ মিনিট থেকে ১টা ৩০ মিনিট (গ্রিনিচ সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিট থেকে ৮টা) পর্যন্ত মাত্র ২৫ মিনিট স্থায়ী হয় এই হামলা। এর ফলে পুরো অঞ্চল কেঁপে ওঠে এবং বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের।
পাকিস্তান দাবি করেছে, মাত্র ছয়টি স্থানে হামলা হয়েছে। ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ও একটি ড্রোনগুলো করে ভূপাতিত করেছে তারা। তবে ভারত এ দাবির সত্যতা স্বীকার করেনি।
ইসলামাবাদ জানায়, নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর ভারতীয় বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণে ৩১ জন নিহত ও ৪৬ জন আহত হয়েছেন। নিয়ন্ত্রণরেখা হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা, যেটিকে কার্যত সীমান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অন্যদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায়, পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে তাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ১৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
গত মাসে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলার পর এই তীব্র উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ফলে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে উত্তেজনা এক নতুন বিপজ্জনক উচ্চতায় পৌঁছেছে। ভারতের দাবি, এই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও বিদেশি কুশীলবদের সরাসরি সম্পৃক্ততার অকাট্য প্রমাণ তাদের কাছে আছে।
তবে পাকিস্তান এই দাবি সরাসরি অস্বীকার করেছে। ইসলামাবাদ বলেছে, ভারত এখনো পর্যন্ত তাদের দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি।
এই হামলা কি নতুন সংঘাতের সূচনা
২০১৬ সালে উরিতে ১৯ ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারত নিয়ন্ত্রণরেখায় ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালিয়েছিল।
২০১৯ সালে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হওয়ার পর ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এটাই ছিল প্রথম সামরিক অভিযান। এরই ধারাবাহিকতায় পাল্টিপাল্টা হামলা ও যুদ্ধবিমানের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে দুই দেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেহেলগাম হামলার জবাবে পাকিস্তানে এবার যে পাল্টা আঘাত হানা হয়েছে, বিস্তৃত পরিসরের কারণে তা ছিল ব্যতিক্রমী। একসঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক তিনটি প্রধান জঙ্গি সংগঠনের অবকাঠামো লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়।
ভারতের দাবি, তারা পাকিস্তান ও পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরজুড়ে নয়টি ‘সন্ত্রাসী’ ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। লস্কর-ই-তৈয়্যেবা, জইশ-ই-মোহাম্মদ ও হিজবুল মুজাহিদিনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে এসব হামলা চালানো হয় বলে দাবি করেছে তারা।
ভারতীয় মুখপাত্রের মতে, সীমান্তের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থিত লক্ষ্যবস্তু ছিল শিয়ালকোট সীমান্ত থেকে মাত্র ৬ ও ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুটি ঘাঁটি।
ভারতের দাবি অনুযায়ী, সবচেয়ে গভীরে আঘাত হানা হয়েছে পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান ঘাঁটিতে। জায়গাটি পাকিস্তানের প্রায় ১০০ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত। এ ছাড়া পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী এবং নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে মুজাফফরাবাদে লস্কর-ই-তৈয়্যেবার একটি ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সাম্প্রতিক হামলার সঙ্গে তাদের যোগসূত্র রয়েছে বলে দাবি করেন ভারতীয় মুখপাত্র।
তবে এবার ভারত সরাসরি আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে হামলা চালিয়েছে। বাহাওয়ালপুর ও মুরিদকেতে লস্কর-ই-তৈয়্যেইবার স্থাপনা, সদর দপ্তর, ও ঘাঁটি ছিল এ হামলার লক্ষ্য।পাকিস্তান দাবি করছে, তাদের ভূখণ্ডের ছয়টি স্থানে ভারত হামলা চালিয়েছে। তবে সেখানে সন্ত্রাসী ঘাঁটি থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে তারা।
দিল্লিকেন্দ্রিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বিবিসিকে বলেন, এবার হামলায় লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারতের লক্ষ্যগুলো অতীতের ধারা ছাড়িয়ে গেছে। আগে বালাকোটে হামলা শুধু নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে একটি সীমান্তরক্ষিত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল।
শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, এবার ভারত সরাসরি আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে হামলা চালিয়েছে। ভারতের দাবি অনুযায়ী, বাহাওয়ালপুর ও মুরিদকেতে লস্কর-ই-তৈয়্যেইবার স্থাপনা, সদর দপ্তর ও ঘাঁটি ছিল এ হামলার লক্ষ্য। এ ছাড়া জইশ-ই-মোহাম্মদ ও হিজবুল মুজাহিদিনের অবকাঠামোতেও আঘাত হেনেছে ভারত।
রাঘবন বলেন, ‘ভারতের এবারকার জবাব আরও বিস্তৃত ও ভৌগোলিকভাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার ইঙ্গিত দেয়। একাধিক গোষ্ঠী এখন ভারতের নিশানায় রয়েছে এবং এটি একটি বৃহত্তর বার্তা দিচ্ছে।’
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হলো দুই দেশের সরকারিভাবে স্বীকৃত সীমানা, যা গুজরাট থেকে জম্মু পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভারতে পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার অজয় বিসারিয়া বিবিসিকে বলেছেন, ভারত এবার যা করেছে, তাকে ‘বালাকোট প্লাস’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এর লক্ষ্য ছিল পরিচিত সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হেনে ভারতের প্রতিরোধক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তবে একই সঙ্গে উত্তেজনা না বাড়ানোর শক্ত বার্তাও দিয়েছে তারা।
বিসারিয়া আরও বলেন, এবারের এসব হামলা ছিল আরও নিখুঁত, নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক এবং অধিক দৃশ্যমান। এ কারণে তা পাকিস্তানের পক্ষে অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ভারতীয় সূত্রগুলো বলছে, এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ‘প্রতিরোধক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ করা।
অধ্যাপক রাঘবনের মতে, ভারত সরকার মনে করে, ২০১৯ সালে বালাকোট অভিযানের মাধ্যমে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা এখন অনেকটা ক্ষয়প্রাপ্ত এবং তা নতুন করে আবার গড়ে তোলা প্রয়োজন।
ভারতের এমন হামলা অনেকটা ইসরায়েলের কৌশলের মতো উল্লেখ করে রাঘবন বলেন, ‘তারা মনে করে, প্রতিরোধ বজায় রাখতে হলে পর্যায়ক্রমে বারবার হামলা চালাতে হয়। তবে আমরা যদি ধরে নিই যে শুধু পাল্টা হামলা চালালেই সন্ত্রাসবাদ থেমে যাবে, তাহলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যখন পাকিস্তান পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হবে। আর তখন পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।’
উত্তেজনা কি আরও বড় সংঘাতে রূপ নিতে পারে
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই এ বিষয়ে একমত যে পাকিস্তানের পাল্টা জবাব অনিবার্য এবং সে ক্ষেত্রে কূটনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিসারিয়া বলেন, পাকিস্তান অবশ্যই জবাব দেবে। আসল পরীক্ষা হবে পরবর্তী পর্যায়ের উত্তেজনা কীভাবে সামাল দেওয়া যায়। এখানেই সংকটকালীন কূটনীতির গুরুত্ব প্রমাণিত হবে।
সাবেক এই ভারতীয় কূটনীতিক বলেন, পাকিস্তানকে সংযম দেখানোর পরামর্শ দেওয়া হবে। তবে মূল লক্ষ্য হবে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার পর এমন কূটনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা, যেন দুই দেশ দ্রুত বড় সংঘাতের দিকে চলে না যায়।
লাহোরভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক ইজাজ হুসেনের মতো পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে মুরিদকে ও বাহাওয়ালপুরের মতো স্থানে ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ (নির্বাচিত লক্ষ্যবস্তুতে সামরিক আঘাত) প্রায় প্রত্যাশিতই ছিল।
ড.
বিবিসিকে এই পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞ বলেন, গণমাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বক্তব্য আর প্রতিশোধ নেওয়ার দৃঢ় ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন দিনগুলোতে সীমান্তপারে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে ড. হুসেন আশঙ্কা প্রকাশ করেন, উভয় পক্ষের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ‘পরিস্থিতিকে সীমিত পর্যায়ের গতানুগতিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।’
মঙ্গলবার শ্রীনগরের একটি সড়কে পাহারা দিচ্ছেন ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরাউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব ক র কর ন ত রণর খ র লক ষ য ক টন ত
এছাড়াও পড়ুন:
আট উপদেষ্টার সমালোচনায় সাবেক সচিব
অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতি’র প্রমাণ নিজের কাছে রয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার। অবসরপ্রাপ্ত এই সচিব বলেছেন, এই উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এক সেমিনারে এ অভিযোগ করেন আব্দুস সাত্তার। তবে তিনি উপদেষ্টাদের নাম বলেননি।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি।
‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’ শীর্ষক সেমিনারটি আয়োজন করে প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। বিকেল চারটায় সেমিনার শুরু হয়ে শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। সেমিনারে প্রশাসন ক্যাডারের শীর্ষ পদের প্রায় সব কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
আব্দুস সাত্তার তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমি খুবই হতাশ। আমলাদের চরিত্র না হয় খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের রক্তের ওপর দিয়ে চেয়ারে বসা অন্তত আটজন উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ দিতে পারব। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আট উপদেষ্টার দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না’। এ সময় উপস্থিত কর্মকর্তারা ‘ঠিক ঠিক’ বলে হাততালি দেন।
সাবেক এই সচিব বলেন, কষ্ট লাগে একজন উপদেষ্টার এপিএসের অ্যাকাউন্টে ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গেলেও তাঁর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তিনি প্রশ্ন করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি মন্ত্রণালয় নূরজাহান বেগম চালাতে পারেন? স্থানীয়
সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় একজন অনভিজ্ঞ উপদেষ্টা দিয়ে চালানো ঠিক হচ্ছে?
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত এক বছরে দুর্নীতি না কমে বরং অতীতের চেয়ে বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, এক সহকারী কমিশনার (ভূমি) একটি স্কুলের জমির নামজারিতে ৩০ লাখ টাকা চেয়েছেন। ঢাকার আশপাশের একজন ইউএনও একটি কারখানার লে আউট পাশ করতে ২০ লাখ টাকা চেয়েছেন।
আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমি একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে বসি। গত বছর ৫ আগস্টের পর ওই অফিসে হাজার হাজার কর্মকর্তা–কর্মচারী ভিড় করছেন। আমার বস তারেক রহমান ডেকে বললেন, “কী হচ্ছে? এরা কারা। তাঁরা এখানে কী জন্য আসে।” আমি বলেছি, এরা সবাই বঞ্চিত। এরা গত ১৫ বছর হাসিনার আমলে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। হাসিনার পতনের পর উচ্ছ্বাসে ছুটে এসেছেন ন্যায়বিচার পেতে। উনি বলেছেন, “দলীয় অফিসে ইন–সার্ভিস কর্মকর্তারা আসা ভালো লক্ষণ নয়। আপনি তাদের অফিসে আসতে নিষেধ করে দেন।” আমি অফিসের গেটে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছি। ইন–সার্ভিস কোনো কর্মকর্তা অফিসে আসতে পারবেন না। যদি কোনো সমস্যা থাকে অফিসার্স ক্লাবে আসবেন।’
আব্দুস সাত্তারের এ বক্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একজন দায়িত্বশীল মানুষ। তথ্যউপাত্ত ছাড়া কথা বলা লোক নন তিনি। নিশ্চয়ই তাঁর কাছে প্রমাণ রয়েছে। তাঁর এই বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারের চিহ্নিত করা উচিত, ওই আট উপদেষ্টা কারা। উপদেষ্টারা এসব করলে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দোষ দিয়ে লাভ কী।
সেমিনারে সাড়ে তিন ঘণ্টার আলোচনায় বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম–দুর্নীতির বিষয় উঠে আসে। কর্মকর্তারা কীভাবে বিগত সরকারের হাতিয়ার হয়ে কাজ করেছেন, সে প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা আগামীতে যাতে কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ না করেন, সে আহ্বান করা হয়েছে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া। মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কানিজ মওলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবির, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক শাফিউল ইসলাম।
আরও বক্তব্য দেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, শহীদ আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী, শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী এবং শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দ্বীপ্তি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সরকারি কর্মকমিশনের সচিব সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম।
সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর মানুষের যে প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা পূরণ হয়নি। বাতাসে কান পাতলে অনেক কথা শোনা যায়। গত ১৫ বছরে কর্মকর্তাদের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা। অবিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে দেওয়া।
সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী বলেন, অতীতে কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে কাজ করেছেন। শেখ হাসিনাকে খুনি, ফ্যাসিস্ট করার পেছনে কর্মকর্তাদেরও ভূমিকা ছিল। ভবিষ্যতে কর্মকর্তারা যেন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ না করেন সে অনুরোধ থাকবে।
সানজিদা খান বলেন, তাঁর ছেলে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে যে চিঠি লিখে গেছে,সেটি যেন আগামী বছর থেকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ, এই চিঠির মধ্যে দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম ও ধর্মীয় অনুভূতি স্পষ্ট। আগামী প্রজন্মের মানুষ জানুক স্বৈরাচার হটাতে কীভাবে মানুষ রাস্তায় নেমেছে।
মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, মুগ্ধ মারা যায় ১৮ আগস্ট। এরপর সরকারের কাছ থেকে সহায়তার জন্য গণভবনে যেতে তাঁদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। এমনকি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নেতা–কর্মী নিয়ে তাঁদের বাসায় গিয়ে গণভবনে যেতে চাপ দেন। তবু তাঁরা গণভবনে যাননি।
সেমিনারে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, কর্মকর্তাদের যতই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তাতে কাজ হচ্ছে না। কারণ, সাহসের ঘাটতি। দেশে এখন যত আইন আছে তা যথেষ্ট। আইনের আর দরকার নেই। এখন দরকার আইনের প্রয়োগ।
শহীদ শাহরিয়ার খানের চিঠি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানান মোখলেস উর রহমান। আগামী বছর থেকে এটি কার্যকর করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, বিগত সরকারের সময় রাজনীতিবিদেরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাড়ে ১২টা বাজিয়েছে। ভালো কর্মকর্তাদের কোনঠাসা করে ফেলা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর মানুষ প্রশ্ন করতে শিখে গেছে। এখন কেউ কিছু করতে চাইলেও পারবে না। প্রশাসনকে কীভাবে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা যায় সে পথ বের করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব বলেন, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটে জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে। গত ১৬ বছরে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভঙ্গুর করে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে তাঁরা কোন পথে যাবেন। এত বছর যে পথে হেঁটেছেন সেদিকে? নাকি নতুন যে পথ তৈরি হয়েছে, সে পথে যাবেন।