সামাজিক মূল্যবোধকে হুমকিতে ফেলেছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন
Published: 13th, May 2025 GMT
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেশের বেশির ভাগ নারীকে প্রতিনিধিত্ব করে না বলে মনে করে ‘ট্র্যাডিশনাল শি (Traditional She)’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, যৌন পেশাকে স্বীকৃতি দেওয়াসহ কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশের বিরোধিতা করেছেন এই প্ল্যাটফর্মের নারী সংগঠকেরা। তাঁদের অভিযোগ, কমিশনের প্রতিবেদন দেশের সামাজিক বন্ধন, সাংস্কৃতিক পরিচিতি ও সম্মিলিত মূল্যবোধকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলেছে।
আজ মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ট্র্যাডিশনাল শি’র সংগঠকেরা এসব কথা বলেন। নবগঠিত প্ল্যাটফর্মটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সচেতন নারী শিক্ষার্থীরা’ গড়ে তুলেছেন বলে দাবি করেন আয়োজকেরা।
গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৪৩৩টি সুপারিশ–সংবলিত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিশনের কয়েকটি সুপারিশের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে ট্র্যাডিশনাল শি। এর মধ্যে রয়েছে অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করা, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোর করে যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, যৌন পেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা।
‘ট্র্যাডিশনাল শি’র সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেশজুড়ে বিতর্ক ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। প্রতিবেদনটি দেশের নারীবাদী আন্দোলনের মূল মূল্যবোধকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। কমিশনের প্রতিবেদন দেশের বেশির ভাগ নারীকে প্রতিনিধিত্ব করে না। এটি সেই সাহসী নারীদেরও প্রতিনিধিত্ব করে না, যাঁরা জুলাই আন্দোলনের উত্তরাধিকার গড়ে তুলেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, কমিশনের সুপারিশ সমাজের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সাংস্কৃতিক শিকড় ও নারীর মর্যাদার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। একদিকে ‘পতিতাবৃত্তি’কে পেশা হিসেবে স্বীকৃতির মাধ্যমে সেই পেশায় জড়িত নারীদের শোষণের বৈধতা দেওয়া, অন্যদিকে বহুবিবাহ বাতিলের সুপারিশ করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।
‘ট্র্যাডিশনাল শি’র আহ্বায়ক মিশকাতুল জান্নাত বলেন, কমিশনের প্রতিবেদন তৈরিতে কোনো ধর্মীয় বিজ্ঞ ব্যক্তিদের রাখা হয়নি। যাঁরা ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বেছে নিয়েছেন, তাঁদের দাবি আসেনি। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের সুপারিশ করার ক্ষেত্রে কোন দেশের মডেল অনুসরণ করা হয়েছে, তার উল্লেখ নেই। অভিন্ন পারিবারিক আইনকে ঐচ্ছিক করা হলে একই পরিবারের মধ্যে ভাই–বোন ভিন্ন ভিন্ন আইন প্রয়োগ চাইতে পারেন। এভাবে একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। ধর্মকে বারবার নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
‘ট্র্যাডিশনাল শি’র মুখপাত্র নাদিয়া মেহজাবিন বলেন, যেখানে নারীর প্রতি শোষণ হচ্ছে, সেটাকে পেশা নাম দিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইউরোপের যেসব দেশে ‘যৌন পেশা’ স্বীকৃত, সেসব দেশে এখন পেশা হিসেবে এর স্বীকৃতি তুলে নেওয়ার দাবি উঠেছে। কারণ, পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে সেখানে নারী পাচার ও সহিংসতা বেড়েছে।
আরও পড়ুননারীর জন্য ৩০০ সংরক্ষিত আসন, বিয়ে-তালাক, উত্তরাধিকারে সমান অধিকার দেওয়ার সুপারিশ ১৯ এপ্রিল ২০২৫সংবাদ সম্মেলনে ‘ট্র্যাডিশনাল শি’র সংগঠক তাবাসসুম নুপা বলেন, স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধে প্রচলিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না করে কমিশন ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ হিসেবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করার যে সুপারিশ করেছে, তা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ, এর সঙ্গে বিবাহকে যুক্ত করে বিয়েকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
নারী খেলোয়াড়দের জন্য নারী কোচ, নারী ফিজিওথেরাপিস্ট, নারী ব্যবস্থাপক রাখার বিষয়ে কমিশনের সুপারিশকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেন ‘ট্র্যাডিশনাল শি’র সদস্য সচিব রেজিয়া খাতুন। তিনি বলেন, একইভাবে হিজাব–নেকাব পরা নারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের ছবি তোলা এবং মৌখিক পরীক্ষার সময় আইডি কার্ড যাচাই–বাছাইয়ে নারীদের নিযুক্ত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তাঁরা শিগগিরই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা উপস্থাপন করবেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান প্রত্যাবাসন: প্রধান উপদেষ্টা
দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান হলো তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সংকট নিরসনে সাত দফা পদক্ষেপের প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন।
তিনি বলেন, “অর্থায়ন কমে আসছে। একমাত্র শান্তিপূর্ণ পথ হচ্ছে তাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা।”
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি’ বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা এই প্রস্তাব দেন।
তিনি বলেন, “গণহত্যা শুরুর আট বছর পরও রোহিঙ্গাদের দুর্দশা অব্যাহত রয়েছে। সংকট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেই। আন্তর্জাতিক অর্থায়নও মারাত্মক ঘাটতিতে ভুগছে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “রোহিঙ্গা সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারে এবং সমাধানও সেখানেই নিহিত।”
রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ এবং দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “এটাই সংকটের একমাত্র সমাধান। মিয়ানমারের সার্বিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় জিম্মি করে রাখা উচিত নয়।”
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সুরক্ষা অব্যাহত রাখার তুলনায় প্রত্যাবাসনে অনেক কম সম্পদের প্রয়োজন হবে। রোহিঙ্গারা বরাবরই নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চেয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সাম্প্রতিক সংঘাত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অবিলম্বে প্রত্যাবাসনের সুযোগ দিতে হবে।”
তিনি উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশ সংকটের শিকার। আমাদের সামাজিক, পরিবেশগত ও আর্থিকভাবে বিপুল চাপ সহ্য করতে হচ্ছে।”
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে মাদক পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলছে। আমাদের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ—যেমন বেকারত্ব ও দারিদ্র্য—বিবেচনায় দেশে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া সম্ভব নয়।”
টেকসই সমাধানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাত দফা পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দেন—
প্রথমত, রাখাইন অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন।
দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির ওপর চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধ এবং সম্প্রতি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু।
তৃতীয়ত, রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে আন্তর্জাতিক সহায়তা জোগাড় এবং তা পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক বেসামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
চতুর্থত, রোহিঙ্গাদের রাখাইন সমাজ ও শাসন ব্যবস্থায় স্থায়ী অন্তর্ভুক্তির জন্য আস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ।
পঞ্চমত, যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনায় অর্থদাতাদের পূর্ণ সহায়তা নিশ্চিত করা।
ষষ্ঠত, জবাবদিহি ও পুনর্বাসনমূলক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
সপ্তম, মাদক অর্থনীতি ভেঙে দেওয়া এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন করা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিশ্ব আর রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরার জন্য অপেক্ষায় রাখার সামর্থ্য রাখে না।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আজ আমাদের সংকট সমাধানে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করতে হবে। বাংলাদেশ এ লক্ষ্যে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।”
ঢাকা/ইভা