নোবিপ্রবিতে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা
Published: 15th, May 2025 GMT
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) বিগত সাড়ে ১৫ বছরের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের ঘটনার তদন্তে গঠিত ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কার্যক্রমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। কমিটির কার্যক্রমকে ‘নিষ্ক্রিয়’ আখ্যা দিয়ে নোবিপ্রবি প্রশাসনের কাছে ফ্যাসিবাদের দোসর ও ছাত্রলীগের বিচারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার (১৫ মে) শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগের দোসর অভিযুক্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং বারবার তদন্তের আশ্বাস দিয়ে বিষয়গুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, এই কমিটি নিষ্ক্রিয়। প্রতিবেদন দিতেও টালবাহানা করছে। যারা অপরাধ করেছে তাদের রক্ষা করতেই এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে।
আরো পড়ুন:
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উঠছে দেয়াল
মুখ দিয়ে লিখেই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন চবি শিক্ষার্থীর
তারা আরো বলেন, যতদিন না নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের বিচার হবে, ততদিন তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। শিক্ষার্থীদের কণ্ঠ রোধ করা যাবে না। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাব।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নোয়াখালীর সদস্য সচিব বনী ইয়ামিন বলেন, “বিপ্লবের নয় মাস পার হয়ে গেলেও এখনো আমরা কোনো দৃশ্যমান বিচার দেখতে পাইনি। প্রশাসনের লিখিত অনুমতিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পরীক্ষা দিচ্ছে, যেখানে আমাদের জুলাই বিপ্লবে আহত ভাইয়েরা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।”
তিনি বলেন, “আমরা যখন ছাত্রলীগকে প্রতিহত করি, তখন আমাদের সুশীল সমাজ আমাদের মবোক্রেসি বলে গালি দেয়। কিন্তু তারা ছাত্রলীগের অন্যায়ের বিচার চায় না। আমরা প্রশাসনকে বলতে চাই, আপনারা ফ্যাসিবাদের দোসর ও ছাত্রলীগের বিচার করুন, অন্যত্থায় পদত্যাগ করুন।”
নোবিপ্রবিতে বিগত সাড়ে পনেরো বছরে সংঘটিত সকল প্রকার দুর্নীতি, জুলুম-নির্যাতন এবং আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের তদন্ত করে রিপোর্ট বা সুপারিশ প্রদানের জন্য এ বছরের ১৪ জানুয়ারি ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড.
এ বিষয়ে অধ্যাপক মো. আব্দুল কাইয়ুম মাসুদ বলেন, “আমাদের কাছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০টির অধিক অভিযোগ জমা পড়ে। এই অভিযোগগুলোর মধ্যে কিছু ছিল বিগত ১৫ বছরে প্রমোশন না পাওয়া, দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এই অভিযোগগুলো দায়ের করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরাও ৬ থেকে ৮ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে।”
তিনি বলেন, “আমরা যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক বিগত সরকারের আমলে প্রমোশন না পাওয়ায় অভিযোগ করেছিলেন। বাকি অভিযোগগুলোর ঘটনা তদন্ত করে আমরা খুব শিগগিরই পরবর্তী প্রতিবেদন জমা দেব। কিছু সংখ্যক অভিযোগে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় আমরা সেগুলো আমলে নিচ্ছি না।”
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল বলেন, “ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি আমাদের কাছে শিক্ষকদের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তসাপেক্ষে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।”
ঢাকা/ফাহিম/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ন ব প রব কম ট র আম দ র ন ত কর তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
বউ-শাশুড়ির হাত ধরে আয়ের পথে নারীরা
চারদিকে সবুজ মাঠ। মাঝখানে কর্মমুখর একটি গ্রাম বাহাদুরপুর। কয়েক বছর আগেও গ্রামটির অনেক পরিবারে আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। নারীদের ঘরে বসে অলস সময় কাটত। দরিদ্র পরিবারের নারীরা আয়ের পথ খুঁজে পাওয়ায় সেই চিত্র এখন অনেকখানিই বদলেছে। এই সুযোগ করে দিয়েছেন সাবিনা বেগম। সবার কাছে তিনি প্রিয় ‘সাবিনা আপা’।
কুটিরশিল্পের ১৬ ধরনের কাজে পটু সাবিনা পরিশ্রম করে শুধু নিজের ভাগ্য বদল করেননি, গ্রামের অনেক দরিদ্র নারীকে নকশার কাজ শিখিয়ে আর্থিক উপার্জনের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর সহায়তায় সুই–সুতা দিয়ে কাপড়ে নকশা তুলে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার অন্তত ২০০ নারী দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। সংসারে এনেছেন সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য। প্রায় প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে সাবিনা বেরিয়ে পড়েন। কাজ নিয়ে ছুটে চলেন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বাড়িতে ফেরেন। সেখানে হাতের কাজ শেখান দরিদ্র নারীদের।
স্থানীয় রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মহিলা সদস্য ববিতা বেগম বলেন, বাহাদুরপুর গ্রামে আগে কলহবিবাদ লেগেই ছিল। নারীরাও সব সময় ঝগড়া করতেন। এখন তাঁরা মিলেমিশে নকশা তোলার কাজ করে বাড়তি আয় করছেন। এ অবদান সাবিনার। তাঁর হাত ধরে নারীরা যেভাবে আয় করার পথ খুঁজে পেয়েছেন, অন্য এলাকার নারীরাও তাঁদের দেখে অনুপ্রেরণা পাবেন।
সুই–সুতার সুনিপুণ কারুকাজ
উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাহাদুরপুর গ্রাম। কাঁচা-পাকা সড়ক পেরিয়ে গ্রামে ঢোকার মুখে সবুজ ফসলের মাঠ। মাঠের ওপারের গ্রামের বাড়িগুলোর উঠানে বসে সুই–সুতা দিয়ে কাপড়ে নকশা তোলার কাজে ব্যস্ত নারীরা। গ্রামের বাসিন্দা সাবিনা বেগমের উঠানে দেখা গেল, বড় বড় জমায়েত। ২০–২৫ জন নারী পাটি পেতে বসে নকশা তুলছেন। কারও হাতে শাড়ি, কারও হাতে পাঞ্জাবি, কারও হাতে লেহেঙ্গা। সাধারণ একটি কাপড় সুই–সুতার সুনিপুণ কারুকাজে হয়ে উঠছে অসাধারণ।
সাবিনা বেগমও তাঁদের কাজে সহযোগিতা করছেন। কেউ কোথাও আটকে গেলে কাছে গিয়ে শিখিয়ে দিচ্ছেন। কাজের ফাঁকে উঠানের আমগাছের তলায় বসে নারীদের ভাগ্য বদলের গল্প শোনালেন সাবিনা।
বউয়ের স্বপ্ন, শাশুড়ির সহযোগিতা
সাবিনা বেগম বেড়ে উঠেছেন ঢাকার মিরপুরে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই বড়। ২০০৪ সালে এইচএসসি পাসের পর ২০০৬ সালে পীরগঞ্জের বাহাদুরপুর গ্রামের মমিনুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তখন দুজনই বেকার। সাবিনার পরামর্শে পীরগঞ্জ বাজারে বইয়ের দোকান দেন মমিনুল। সাবিনা শুরু করেন টিউশনি; কিন্তু গ্রামে নারীদের ওপর অকারণে নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও পারিবারিক কলহ নাড়া দেয় সাবিনার চিন্তাকে। এরপর গ্রামের নারীদের সবাইকে নিয়ে কিছু একটা করার কথা ভাবেন তিনি।
বিষয়টি শুনে সাবিনার শাশুড়ি মনোয়ারা তাঁকে উৎসাহ দেন। একপর্যায়ে ২০১৭ সালে সাবিনাকে নিয়ে পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী গ্রামে আত্মীয় সাইফুল ইসলামের বাড়িতে যান মনোয়ারা। সেখানে নারীদের নকশার কাজ করে জীবন বদলের চিত্র দেখে সাবিনা মুগ্ধ হন।
শাশুড়ি মনোয়ারার পরামর্শে ২০১৮ সালে সাবিনা পীরগঞ্জ পল্লী উন্নয়ন কার্যালয় থেকে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। তিনি সেই প্রশিক্ষণ দেন শাশুড়ি মনোয়ারা বেগমসহ গ্রামের পাঁচ নারীকে। শাশুড়ির গাভি আর ছাগল বিক্রির ৮৫ হাজার টাকায় বাড়ির একটি কক্ষে পুরোদমে সেলাই ও হাতের কাজ শুরু করেন সাবিনা। ধীরে ধীরে কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালে তাঁর বাড়িতে আসেন ঢাকার কাপড় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান। ঢাকায় কয়েকটি কাপড়ের শোরুম আছে তাঁর। তিনি সাবিনাকে ঢাকায় নিয়ে যান। স্থানীয় এজেন্ট মনোনীত করে তাঁর হাতে তুলে দেন শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি–পিস ও কাঁথায় নকশা করার সরঞ্জাম। মান ভালো হওয়ায় বাড়তে থাকে কাজের পরিমাণ। ধীরে ধীরে তিনি গ্রামের অন্য নারীদের যুক্ত করেন এই কাজে।
২৫ জন দিয়ে শুরু
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রামের ২৫ জন দরিদ্র নারীকে নিয়ে সাবিনা গঠন করেন বাহাদুরপুর ব্যাপারীপাড়া কুটিরশিল্প সমিতি। তিনি সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশা ও কারচুপির কাজ দেন। সমিতির বাইরে থাকা গ্রামের গৃহবধূরাও তাঁর কাছে ছুটে আসেন কাজ শিখতে। সাবিনা তাঁদেরও প্রশিক্ষণ দেন। বর্তমানে এসব গৃহবধূ দুই শতাধিকে পৌঁছেছে।
কারিগরেরা লেহেঙ্গায় নকশা করার জন্য ৬০০ টাকা, শাড়িতে ৭০০ টাকা, পাঞ্জাবি ও থ্রি–পিসে ৫০০ টাকা করে মজুরি পান। সাবিনা প্রতিটি কাজের জন্য কমিশন পান ৭০ টাকা। এই আয়ের টাকায় আবাদি জমি ও পাকা বাড়ি করেছেন। কিনেছেন মোটরসাইকেল। হাঁস-মুরগি ও গাভি পালন করছেন। গাছপালায় ঘেরা বাড়িতে দুই ছেলে-মেয়ে, স্বামী ও শাশুড়িকে নিয়ে সুখের সংসার তাঁর।
স্বাবলম্বী অন্য নারীরাও
সাবিনা বেগমের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর সুই–সুতার কাজ করে এলাকার অনেক নারী এখন স্বাবলম্বী। তাঁদের কেউ মাসে পাঁচ হাজার, আবার কেউ ৯ হাজার টাকা আয় করছেন। ধুলগাড়ী গ্রামের হাফিজা খাতুন (২৭) তাঁদের মধে৵ একজন। তিনি বলেন, ১৪ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। আগে ভূমিহীন স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। এখন তাঁর আয়ে সংসার চলছে, স্বামীর আয় জমা থাকছে। ৯ শতক জমি কিনেছেন। খড়ের ঘরের জায়াগায় তুলেছেন টিনের ঘর। হাঁস-মুরগি, গরু–ছাগলও পালেন।
কৃষিকাজ করে ছয় সদস্যের সংসার চালাতে কঠিন লড়াই করতে হতো গ্রামের মিজানুর রহমানকে। এখন তাঁর দুই মেয়ে শিল্পী খাতুন ও তামান্না আক্তার নকশার কাজ করে নিজেদের পড়ার খরচ চালিয়েও প্রতি মাসে দুই–তিন হাজার টাকা জোগান দেয় বলে জানালেন তিনি।
গ্রামের বাসিন্দা সানজিদা বেগম জানান, তিন বছর আগে স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। বিষয়টি জানতে পেরে সাবিনা তাঁকে নকশা তোলার প্রশিক্ষণ দেন। এখন মাসে তাঁর আট হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
রায়পুর ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন গরিব মেয়েরা সাবিনার কাজে যুক্ত হয়ে অলস সময় কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। অনেকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করায় দিন দিন এর প্রসার ঘটছে।
উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, দরিদ্র নারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন সাবিনা। তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহজ শর্তে ঋণও দেওয়া হয়েছে। তিনি নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং অন্যদেরও এগিয়ে নিচ্ছেন।
শ্বশুরবাড়ির লোকজন ইতিবাচকভাবে নেওয়ার কারণে কাজ করা সহজ হয়েছে বলে মনে করেন সাবিনা বেগম। স্বামীর উৎসাহ আর শাশুড়ির সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে সাবিনা বলেন, ‘এখন আমার একটিই স্বপ্ন—নারীদের জীবনে দুঃখ মোচন করা। এ জন্য পীরগঞ্জ সদরে বড় একটি পোশাক কারখানা করব। পুরো উপজেলার নারীদের সংগঠিত করে সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা দেব। তাঁরা সংসারে খরচ জোগাতে অবদান রাখবেন।’