মাঠজুড়ে সবুজ ধানখেত। খেতজুড়ে বিচরণ করছে হাঁস। সেই খেতের পানিতেও ভাসছে মাছ। ধানখেতে এমন হাঁস-মাছের সমন্বিত চাষ শুধু চোখ জুড়ায় না, অর্থনৈতিকভাবে লাভবানও করে তুলেছে শিক্ষিত যুবক আবদুর রহিমকে (৩২)। ধানখেতে হাঁস-মাছের সমন্বিত চাষে ভাগ্য বদলে গেছে তাঁর। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে প্রতিবছর তাঁর আয় প্রায় আট লাখ টাকা।

আবদুর রহিমের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের রহিমাপুর গ্রামে। তিনি ১১ বছর ধরে ধানখেতে মাছ চাষ করে নিজের ভাগ্য বদল করছেন। এলাকার অন্য চাষিদেরও তিনি নানাভাবে সহায়তা করছেন। ধানখেতে হাঁস-মাছ চাষের গুরু হিসেবে সবাই তাঁকে চেনেন।

উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে রহিমাপুর গ্রাম। ওই গ্রামের মাঠে ধান-হাঁস-মাছের সমন্বিত খামার গড়ে চাষাবাদ করছেন রহিম। শুধু মাছ আর হাঁস থেকে তাঁর বছরে আয় এখন আট লাখ টাকা। তাঁকে দেখে রহিমাপুর গ্রামসহ আশপাশের দুই গ্রামের শতাধিক চাষি ধানখেতে মাছ ও হাঁসের চাষ করছেন।

গত শুক্রবার রহিমাপুর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, রহিম ধানখেতের পাশে গড়ে তোলা খামার থেকে হাঁসের ডিম তুলতে ব্যস্ত। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে খামার থেকে বেরিয়ে এসে শোনান সমন্বিত চাষাবাদের গল্প।

রহিম জানান, তাঁর বাবা মজিবর রহমান একজন কৃষক। তাঁদের তিন একর জমিতে ধান চাষাবাদ করে তেমন লাভ হতো না। কোনো রকমে সংসার চলত। সঞ্চয় ছিল শূন্যের কোঠায়, অসুখ-বিসুখ হলে হাত দিতে হতো জমি বন্ধকে। এমন অবস্থায় ভিন্ন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০১১ সালে তারাগঞ্জ ও/এ ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাসের পর বিভিন্ন জায়গায় চাকরি খোঁজেন। কিন্তু চাকরি না পাওয়ায় একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন চাকরি নয়, কৃষিতে মনোনিবেশ করবেন তিনি। বাবার সঙ্গে বসেন। বাবা সম্মতি দিলে ২০১৩ সালে শুরু করেন চাষাবাদ। কিন্তু রহিমের চিন্তা ব্যতিক্রম কিছু করার। তিনি পরিকল্পনা করেন ধানখেতে মাছ ও হাঁস চাষের।

২০১৪ সালে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা থেকে ৫ হাজার টাকায় ২০০ হাঁসের বাচ্চা কিনে আনেন। ধানখেতের একপাশে ছোট একটা ঘর তুলে হাঁস পালন শুরু করেন। ১০৭ দিন পর সেই হাঁস বিক্রি করেন ৭৫ হাজার টাকায়। খরচ বাদে লাভ থাকে ৫০ হাজার টাকা। সেই টাকায় পরের বছর এক একর জমির চারদিকে আল বাঁধেন। সেখানে মাছ চাষ ও হাঁস চাষ শুরু করেন। এ বছরও তাঁর আয় আসে এক লাখ টাকা। ধানেরও ফলন ভালো হয়। এরপর পুরোদমে লেগে পড়েন ধানখেতে হাঁস-মাছ চাষে।

রহিম বলেন, আগে তাঁদের তিন একর জমিতে শুধু বোরো ও আমনের চাষ করতেন। কিন্তু সার-কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের অগ্নিমূল্যের কারণে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ধান চাষ করলেও তা দিয়ে পরবর্তী চাষের খরচ রেখে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। এমনও হয়েছে, বোরো মৌসুমে তাঁদের উৎপাদন খরচও ওঠেনি। তাই বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন। ২০১৪ সালে ধানখেতে মাছ ও হাঁসের সমন্বিত খামার গড়ে তোলেন। আর পেছন তাকাতে হয়নি।

রহিম আরও বলেন, ‘ধানখেতে হাঁস-মাছ চাষে বাড়তি তেমন খরচ লাগে না। হাঁস-মাছ ধানখেতের পোকামাকড় ধ্বংস করে। হাঁসের বিষ্ঠা মাছের খাবার হয়। প্রথম যখন শুরু করি তখন লাভ ছিল ৫০ হাজার টাকা। বছর বছর এ লাভ বাড়তে থাকে। গত দুই বছরে ১৬ লাখ টাকার মাছ-হাঁস বিক্রি করেছি। আমার কাছে পরামর্শ নিয়ে এলাকার অনেকেই এখন ধানখেতে মাছ–হাঁসের চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।’

ওই গ্রামের শিক্ষিত যুবক এমদাদুল হকও ধানখেতে হাঁস–মাছের চাষ করে নিজের ভাগ্য বদল করেছেন। এমদাদুল বলেন, ‘ধানখেতে মাছের চাষ করছি। জমির একপাশে পুকুর করে হাঁসের খামার গড়ে তুলেছি। মাছের খরচে ধান চাষ হচ্ছে। ধান এখন ফাও আবাদ। ধানখেতে হাঁস–মাছ চাষে প্রশান্তি আছে।’ ৫০ শতক জমিতে ধানের সঙ্গে মাছ চাষ করে এখন তাঁর বছরে আয় সব মিলিয়ে এক লাখ টাকা।

রহিমের দেখানো পথে এমদাদুলের মতো ওই গ্রামের আশরাফুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান, আবু তালেব, সফি উল্লাহ, বাদশা আলম, মোস্তফা কামলা ধানখেতে মাছ-হাঁসের সমন্বিত খামার করে আয়ের পথ করে নিয়েছেন।

কৃষক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘রহিম ভাই এলাকায় প্রথম ধানখেতে মাছের চাষ শুরু করেন। তাঁকে দেখে আমার মতো অনেকেই এখন ধানখেতে মাছ চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। কোনো সমস্যা হলে সবার আগে রহিম ভাইয়ের কাছে ছুটে যাই। তিনি পরামর্শ দেন।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ধীবা রানী রায় বলেন, ধানখেতে মাছ চাষ করলে ধানের ফলন বৃদ্ধি পায়। কীটনাশক প্রয়োগ না করায় পরিবেশ যেমন দূষণমুক্ত থাকে, তেমনি জনস্বাস্থ্যও থাকে নিরাপদ।

উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘রহিম ধানখেতে মাছ–হাঁসের চাষ করে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন। তাঁর দেখানো পথে এখন অনেকেই এ পদ্ধতিতে চাষবাস করছেন। এতে মাছের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা সব সময় তাঁদের সহযোগিতা করছি।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ছ চ ষ কর র সমন ব ত ন ধ নখ ত র চ ষ কর র বছর উপজ ল করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

‘সাগরত ইলিশ ধরিত ন পারির, চোখেমুখে অন্ধহার দেহির’

বৈরী পরিবেশের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের প্রচণ্ড উত্তাল রয়েছে। ইলিশ ধরতে সাগরে নামতে পারছে না কক্সবাজার উপকূলের কয়েক হাজার ট্রলার। বেকার হয়ে পড়েছেন ১ লাখের বেশি জেলে। অধিকাংশ ট্রলার নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীতে।

আজ মঙ্গলবার সকালে নদী নুনিয়াছটা ফিশারি ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, জেলেরা অলস সমায় কাটাচ্ছেন। সেখানে দেখা হয় জেলে জুবাইদুল ইসলামের (২৫) সঙ্গে। সাগর উত্তাল থাকায় গত সাত দিন ইলিশ ধরতে যেতে পারেননি। সংসার কীভাবে চলবে, সে ভাবনায় দিন কাটছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘সাত দিন ধরি সাগরত ইলিশ ধরিত ন পারির। সাগর বেশি গরম। ট্রলারত বই বই টেনশন গরির (করছি)-সংসার কেনে (কীভাবে) চালাইয়ুম। ঘরত মা-বাপ, বউ আছে। তারা ঠিক মতন একবেলা খাইত ন পারের। চোখেমুখে অন্ধহার দেহির।’

জুবাইদুলের বাড়ি সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ার আলী আকবরডেইল গ্রামে। কক্সবাজার শহরের সমিতি পাড়ায় থেকে সাত বছর ধরে তিনি ট্রলারে জেলে শ্রমিকের কাজ করছেন। ট্রলার নিয়ে গভীর সাগরে গিয়ে মাছ ধরছেন। কিন্তু এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হয়নি জানিয়ে জুবাইদুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ ১৭ জুন একটি ট্রলার নিয়ে তাঁরা ১৫ জন জেলে সাগরে ইলিশ ধরতে গিয়েছিলেন। ইলিশের সন্ধানে সাগরে তাঁরা সাত দিন অবস্থান করে গত ২২ জুন ঘাটে ফিরে আসেন। তত দিনে জালে ধরা পড়ে ১৪ মণ লইট্যা মাছ। বিক্রি করে পাওয়া গেছে ৫৬ হাজার টাকা। অথচ সমুদ্রযাত্রায় ট্রলারে খরচ হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। লোকসান হলে জেলেদের সংকট বাড়ে।

পাশের আরেক ট্রলারের জেলে কামরুল হাসান (৪৫) বলেন, গভীর সাগরে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছে ভরপুর, কিন্তু সাগর প্রচণ্ড উত্তাল থাকায় সেখানে যাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাভাবে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিন সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ১৩ বছরের জেলে জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি তাঁকে।

আজ সকাল থেকেই কক্সবাজারের আকাশ ছিল মেঘলা। থেমে থেমে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। এমন আবহাওয়ায় বাঁকখালী নদীর পাঁচ-ছয় কিলোমিটার এলাকায় অবস্থান করছে তিন হাজারের বেশি ট্রলার। প্রতিটি ট্রলারে জেলে থাকেন ১৬-২২ জন। কয়েকজন জেলে ট্রলার পাহারা দিলেও বেশির ভাগ বাড়িতে চলে গেছেন।

কক্সবাজার ফিশিং বোটমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, গত ১২ জুন ৫৮ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার মুহূর্তে সাগর উত্তাল হয়ে পড়েছে। গত ১৮ দিনে সাগরে তিনটি লঘু ও নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। এখনো সাগরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া অনিরাপদ। ফলে কক্সবাজার সদরসহ মহেশখালী, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, চকরিয়া, পেকুয়া ও কুতুবদিয়ার ছোট–বড় অন্তত ৬ হাজার ট্রলার ঘাটে পড়ে আছে। কিছু ট্রলার ঝুঁকি নিয়ে সাগরের কাছাকাছি এলাকায় গিয়ে জাল ফেলে ছোট আকৃতির লইট্যা, ফাইস্যা, পোঁপা, ছুরি ধরে আনলেও ইলিশের দেখা নেই। ইলিশ ধরতে গেলে ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরে গভীর সাগরে যেতে হবে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার মতো ট্রলার নেই। ২০ জুলাই পর্যন্ত সাগরের উত্তাল পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে।

সাগর উত্তাল থাকায় কক্সবাজার উপকূলে জেলেরা ইলিশ ধরতে যেতে পারছেন না। কাটাচ্ছেন অলস সময়। আজ সকালে নুনিয়াছটা ফিশারি ঘাটে

সম্পর্কিত নিবন্ধ