কেবল দেখার জন্যই যে আলো চাই, তা নয়। আলোর প্রয়োজন আরও বহু কাজে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানান শাখায় আলোকশক্তির ব্যবহার বহুমাত্রিক। রোগনির্ণয় ও রোগের চিকিৎসায় আলোর প্রযুক্তিগত ব্যবহার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানবকল্যাণে আলোর কিছু ব্যবহার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:
অণুবীক্ষণযন্ত্রে আলোরোগের ধরন ও জীবাণু শনাক্ত করার কাজে অণুবীক্ষণযন্ত্র বা মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন। মাইক্রোস্কোপে লেন্সের সাহায্যে ক্ষুদ্র বস্তুকে বড় করে দেখা যায়। ধরা যাক, কারও দেহে একটি টিউমার হয়েছে। টিউমারটি অস্ত্রোপচারের সাহায্যে অপসারণ করা হলো। ধাপে ধাপে প্রক্রিয়াজাত করে মাইক্রোস্কোপের নিচে এ টিউমারের ধরন পরীক্ষা করা যাবে। এ টিউমারের ভেতর যে কোষ রয়েছে, তা স্বাভাবিক কি না, এতে কোনো ক্যানসার কোষ আছে কি না কিংবা কোষের বিন্যাস কেমন—সবই জানা যাবে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে। কফ, প্রস্রাব, ক্ষতস্থানের রস প্রভৃতি নমুনায় জীবাণুর উপস্থিতি ও জীবাণুর ধরন নিশ্চিত করার জন্যও মাইক্রোস্কোপ আবশ্যক।
দর্পণে রোগনির্ণয়দর্পণ বা আয়নায় আলোর প্রতিফলনকে কাজে লাগানো হয়। মুখের ভেতরের অংশ পরীক্ষা করে দেখতে দন্তচিকিৎসকেরা দর্পণের সহায়তা নেন। মুখগহ্বরের একেবারে ভেতর পর্যন্ত বা শেষ প্রান্ত পর্যন্ত সহজেই দেখা যায় এসব দর্পণের সাহায্যে। রোগীও খুব একটা অস্বস্তি বোধ করেন না। নাক কান গলা বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজেও দর্পণ ব্যবহার করা হয়।
এন্ডোস্কোপ ও কোলোনোস্কোপএন্ডোস্কোপ ও কোলোনোস্কোপে ব্যবহার করা হয় লেন্স। অর্থাৎ এখানেও রয়েছে আলোকপ্রযুক্তি। খাদ্যনালি বা পাকস্থলীর ভেতরটা দেখতে চিকিৎসককে সহায়তা করে এন্ডোস্কোপ। অন্যদিকে বৃহদান্ত্রের ভেতরটা দেখার জন্য কাজে আসে কোলোনোস্কোপ।
রোগনির্ণয়ে আলোর আরও ব্যবহাররক্তে নানান কিছুর মাত্রা নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় স্পেকট্রোফটোমিটার নামের একটি যন্ত্র। একটি নমুনায় কোনো একটি নির্দিষ্ট উপাদান ঠিক কী পরিমাণে আছে, তা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য থেকেই জানতে পারা যায় এ যন্ত্রের সাহায্যে। অন্যদিকে আবার এক্স–রে, সিটি স্ক্যান বা এমআরআইয়ের ফিল্ম স্পষ্টভাবে দেখার জন্য যে বক্সে রাখা হয় (ভিউ বক্স), সেখানেও থাকে আলো।
চিকিৎসায় লেজার ও ফটোথেরাপিনানান রোগের চিকিৎসায় লেজারপদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়। এটিও আলোকশক্তিরই এক রূপ। চোখের সমস্যা সমাধানে যে ল্যাসিক করানো হয়, সেটি লেজারভিত্তিক একটি পদ্ধতি। ত্বকের বিভিন্ন সমস্যারও সমাধান হয় লেজারের সাহায্যে। নবজাতকের জন্ডিসের চিকিৎসায় ফটোথেরাপি দেওয়া হয়। সেখানে ব্যবহার করা হয় নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি।
চোখের জন্য আরও আলোচোখ পরীক্ষার সময় দূরের লেখা পড়তে বলা হয়। একজন ছয় মিটার দূর পর্যন্ত ঠিকভাবে পড়তে পারলে বলা হয়, তাঁর ‘ভিশন ৬/৬’। তাহলে কি সব চক্ষুবিশেষজ্ঞের চেম্বারের দৈর্ঘ্য ছয় মিটার হতেই হয়? না। একদমই তা নয়। তিন মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ঘরেই একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞ এ পরীক্ষা করে ফেলতে পারেন অনায়াসে। কীভাবে, জানেন? আলোর প্রতিফলনকে কাজে লাগিয়ে। তিন মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ঘরের দৈর্ঘ্য বরাবর এক প্রান্তে বসে থাকা একজন তাঁর পেছন দিকের দেয়ালে থাকা বর্ণগুলোকে তাঁর সামনে ঠিক বিপরীত দিকে রাখা আয়নায় কতটা স্পষ্টভাবে দেখতে পান, তা থেকেই বোঝা যায়, ছয় মিটার দূরত্বে তাঁর দৃষ্টিশক্তি কেমন। কারণ, তাঁর পেছনের দেয়াল থেকে সামনের আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে আলো আবার তাঁর চোখে ফেরত আসছে। অর্থাৎ আলোর অতিক্রান্ত পুরো পথের দূরত্ব ছয় মিটারই হচ্ছে। চোখের ভেতরকার বেশ কিছু পরীক্ষা করার জন্য চক্ষুবিশেষজ্ঞরা একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করেন, যার নাম স্লিট ল্যাম্প। এতেও আছে আলোর ব্যবহার। আবার ধরুন, কারও রেটিনা, অপটিক ডিস্ক বা রক্তনালি দেখা প্রয়োজন। তখন একজন চিকিৎসক অফথ্যালমোস্কোপ নামে আরও একখানা ছোট যন্ত্রের সাহায্য নেন। এতেও হয় আলোর ব্যবহার।
অস্ত্রোপচারে আলোঅস্ত্রোপচারের টেবিলে এমনভাবে আলোর ব্যবস্থা করা হয়, যাতে ছায়া না পড়ে। এর ফলে শল্যচিকিৎসক কাজটি করেন নির্বিঘ্নে। ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতিতে শল্যচিকিৎসা করার ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয় ক্যামেরাযুক্ত আলোক সরঞ্জাম। পেটে ছোট ছোট ছিদ্র করে এ সরঞ্জামের সাহায্যেই পেটের ভেতরকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাইরে থেকে দেখতে পান একজন শল্যচিকিৎসক।
ইনফ্রারেড বা অবলোহিত রশ্মিব্যথা সারাতে ইনফ্রারেড রশ্মির সাহায্য নেওয়া হয়। এটি আলোর এক বিশেষ রূপ। নির্দিষ্ট যন্ত্রের মাধ্যমে দেহের নির্দিষ্ট অংশে এ রশ্মি প্রয়োগ করা হয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।
অতিবেগুনি রশ্মিকিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করার কাজে অতিবেগুনি আলোকরশ্মি কাজে লাগানো যায়। নমুনায় নির্দিষ্ট জিনের উপস্থিতিও নির্ণয় করা যায় অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে।
ডা.
রাফিয়া আলম: ক্লিনিক্যাল স্টাফ, নিউরোমেডিসিন বিভাগ,
স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর র ব যবহ র খ র জন য ছয় ম ট র চ ক ৎসক আল র প পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সোচ্চার ইহুদি পরিবারগুলোতে অসন্তোষ তুঙ্গে, ঘটছে ভাঙন পর্যন্ত
ডিসেম্বরের এক শীতের দিন। বড়দিনের ছুটিতে ডালিয়া সারিগের ৮০ বছর বয়সী বাবা তাঁর ভিয়েনার বাড়িতে এলেন। এর আগে সারিগ স্কিইং ট্রিপ থেকে ফিরেছেন।
সারিগের বাবা এসেছিলেন তাঁর সৎমেয়েকে নিয়ে যেতে। সে সারিগের পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে এসেছিল।
সারিগ নিশ্চিত ছিলেন, এটি হয়তো তাঁর বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হতে যাচ্ছে। কারণ, তাঁদের রাজনৈতিক মতবিরোধ এবার তুঙ্গে উঠতে চলেছে।
‘আমি বিদায় বলেছিলাম। তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলাম,’ আল–জাজিরাকে বলেন সারিগ। ‘যখন বিদায় বলি, তখন জানতাম, হয়তো আর কখনো দেখা হবে না।’
সারিগের সঙ্গে তাঁর পরিবারের টানাপোড়েন চলছে অনেক বছর ধরেই। ৫৬ বছর বয়সী সারিগ একজন ফিলিস্তিনপন্থী কর্মী। তিনি তাঁর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণ করেন।
সারিগের বাবা-মা জায়োনিজমে বিশ্বাসী। এ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতবাদ (যেকোনো পন্থায়) একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়, যা ফিলিস্তিনিদের কাছে তাঁদের জন্য এক দুর্দশা ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত।
ডালিয়া সারিগের সঙ্গে তাঁর পরিবারের টানাপোড়েন চলছে অনেক বছর ধরেই। ৫৬ বছর বয়সী সারিগ একজন ফিলিস্তিনপন্থী কর্মী। তিনি তাঁর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণ করেন।ডিসেম্বরে বাবার সঙ্গে ওই সাক্ষাতের সময় সারিগ জানতেন যে জানুয়ারিতে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে তিনি ফিলিস্তিনপন্থী একটি বিক্ষোভ করবেন, যা একটি টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার করবে। তিনি যে কর্মী দলের সদস্য, তারা তাঁকে টিভি সাক্ষাৎকারের জন্য মনোনীত করেছে। গাজায় ইসরায়েলি নিধনের প্রতিবাদে আগেও তিনি এগিয়ে গেছেন।
‘পরে সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। দ্রুতই সেটা আমার পরিবারের কাছে পৌঁছে যায়,’ বলেন সারিগ।
সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার পর সারিগ শুনেছিলেন, তাঁর বাবা, বন্ধুদের বলেছিলেন, ‘আমার কাছে সে (সারিগ) মৃত।’ তিনি (বাবা) নিজেও ভিয়েনা থাকতেন।
‘কিন্তু তিনি (বাবা) কখনো এ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেননি, কখনো কিছু জানাননি। তিনি সম্পর্কটাই ছিন্ন করে দেন।’
সারিগের ৭৭ বছর বয়সী মা জার্মানিতে থাকেন। এক সপ্তাহ পর তিনি একটি বার্তা পাঠান।
এখনো সেটা (মায়ের বার্তা) আমার ফোনে আছে। সেখানে লেখা, ‘আমি তোমার রাজনৈতিক কর্মসূচি মেনে নিতে পারি না। তুমি একজন বিশ্বাসঘাতক, তুমি নিজের বাসা নোংরা করছ…আর যদি কখনো তোমার মত বদলাও, তবে আমরা আবার স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পারি। সুস্থ থেকো।’ডালিয়া সারিগ, ফিলিস্তিনপন্থী ইহুদি নারীসারিগ বলেন, ‘এখনো সেটা আমার ফোনে আছে। সেখানে লেখা, “আমি তোমার রাজনৈতিক কর্মসূচি মেনে নিতে পারি না। তুমি একজন বিশ্বাসঘাতক, তুমি নিজের বাসা নোংরা করছ…আর যদি কখনো তোমার মত বদলাও, তবে আমরা আবার স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পারি। সুস্থ থেকো।”’
এর পর থেকে সারিগ আর মা–বাবার সঙ্গে কথা বলেননি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েল—ইহুদি পরিবারে মতবিরোধ অস্বাভাবিক নয়। তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে এ বিভাজন আরও প্রকট হয়েছে।
ওই দিন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা চালায়। ইসরায়েলের দাবি, এতে ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন ও দুই শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে হামলার জবাবে ৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় বিরামহীন তাণ্ডব শুরু করেছে ইসরায়েল। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বোমা হামলায় এই উপত্যকায় ৬১ হাজার ৭০০–এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
‘আমার মতে, উদারপন্থী জায়োনিস্টদের মধ্যে সবচেয়ে মজার দিক হলো, ৭ অক্টোবরের পর বেশির ভাগ ডান পন্থায় ঝুঁকলেও সংখ্যালঘু একটি অংশ ইসরায়েল ও জায়োনিজম থেকে আরও বিমুখ হয়েছে,’ বলেন লেখক ও জায়োনিজমবিরোধী বুদ্ধিজীবী ইলান প্যাপে।
শৈশবে সারিগ ইহুদি উৎসব পালন করতেন ও বয়োজ্যেষ্ঠদের থেকে জায়োনিজম সম্পর্কে শিখতেন। তাঁকে শেখানো হয়েছিল, ‘ফিলিস্তিনিরা শত্রু, তারা সব ইহুদিকে হত্যা করতে চায়…আর ইসরায়েলে থাকা ইহুদিরা শান্তি চায়, কিন্তু আরবরা তা চায় না।’‘আমি আমার ইহুদি কমিউনিটিকে হারিয়েছি’
সারিগের পূর্বপুরুষেরা ১৯৩৮ সালে নাৎসি জার্মানির অস্ট্রিয়া দখলের সময় পালিয়ে সার্বিয়ায় যান। পরে ব্রিটিশশাসিত ফিলিস্তিনে স্থায়ী হন, যা এখনকার ইসরায়েল। তবে ১৯৫০-এর দশকে তাঁদের অধিকাংশ আত্মীয়স্বজন আবার অস্ট্রিয়ায় ফিরে আসেন, যেখানে সারিগের জন্ম।
শৈশবে সারিগ ইহুদি উৎসব পালন করতেন ও বয়োজ্যেষ্ঠদের থেকে জায়োনিজম সম্পর্কে শিখতেন। তাঁকে শেখানো হয়েছিল, ‘ফিলিস্তিনিরা শত্রু, তারা সব ইহুদিকে হত্যা করতে চায়…আর ইসরায়েলে থাকা ইহুদিরা শান্তি চায়, কিন্তু আরবরা তা চায় না।’
১৮ বছর বয়সে সারিগ ইসরায়েলে যান, সেখানে তিনি বামপন্থী জায়োনিস্ট যুব সংগঠনে যোগ দেন।
১৩ বছর ইসরায়েলে থাকার সময় সারিগ একটি কিবুৎজে (সমবায়ভিত্তিক বসতি) যোগ দেন, সেনাবাহিনীতে অফিসের কাজ করেন ও বিয়ে করেন। তবে হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস পড়ার সময় তাঁর বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। সেখানে তিনি এক ফিলিস্তিনি অধ্যাপকের সঙ্গে পরিচিত হন এবং পরে ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে কাজ শুরু করেন।
সারিগ বলেন, ‘এক সন্ধ্যায় লনে বসে ওই শিক্ষক ছোট একটি গ্রাম থেকে তাঁর পরিবার উচ্ছেদ হওয়ার গল্প বলছিলেন। আমি বুঝতে পারি, আমি যা জেনেছি, সেই জায়োনিস্ট বয়ান ভুল। ভাবতে শুরু করি, আমি যদি কোনো ইহুদি রাষ্ট্র বসবাসকারী ফিলিস্তিনি হতাম, যার পূর্বপুরুষদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তবে আমি কেমন অনুভব করতাম।’
অস্ট্রিয়ায় ফিরে আসার পর পরিবারের সঙ্গে সারিগের ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক লেগেই থাকত। কখনো ঠিক করতেন, এ নিয়ে আর আলোচনা করবেন না। কিন্তু আবার কথা বলতেন, আবার ঝগড়া হতো।
আমার মতে, উদারপন্থী জায়োনিস্টদের মধ্যে সবচেয়ে মজার দিক হলো, ৭ অক্টোবরের পর বেশির ভাগ ডান পন্থায় ঝুঁকলেও সংখ্যালঘু একটি অংশ ইসরায়েল ও জায়োনিজম থেকে আরও বিমুখ হয়েছে।ইলান প্যাপে, লেখক ও জায়োনিজমবিরোধী বুদ্ধিজীবী২০১৫ সালে সারিগ জায়োনিজমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে তাঁর ইসরায়েলি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।
‘এটা আমার আন্দোলন চালানোকে সহজ করে তোলে,’ বলেন সারিগ। ‘আমি আমার ইহুদি কমিউনিটি হারিয়েছি, কারণ আমি একদিকে “অদ্ভুত” আবার অন্যদিকে “বিশ্বাসঘাতক” হিসেবে বিবেচিত হই।’
কিন্তু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে—বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘৭ অক্টোবরের পরও আমার দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা বদলায়নি’
নিউরোসায়েন্টিস্ট ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির ছাত্র ফাইসাল শরিফ জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, ‘সামাজিক বিচ্ছিন্নতা শারীরিক ব্যথার মতোই মস্তিষ্কে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অর্থাৎ সামাজিক বেদনা শুধু রূপক নয়, এটি জীববৈজ্ঞানিকভাবে বাস্তবও।’
ফাইসাল আরও বলেন, একেকটি পরিবার প্রায়ই নিজস্ব ছোট সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যেখানে নিজস্ব নিয়মনীতি ও রাজনৈতিক অবস্থান থাকে। তিনি বলেন, ‘সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পরিবারগুলোর উচিত বিতর্ক নয়, কৌতূহল নিয়ে কথা বলা।’
‘এটাই এখন মূল ইস্যু’
ইসরায়েলে জন্ম নেওয়া সংগীতশিল্পী জনাথন অফির। ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে ডেনমার্কে চলে যান তিনি। ২০০৯ সালে প্রথম বুঝতে পারেন যে তিনি একটি পক্ষপাতদুষ্ট বয়ানের অংশ ছিলেন, যেখানে ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিভঙ্গি বাদ পড়েছিল। তিনি ইলান প্যাপের বই ‘দ্য এথনিক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন’ পড়েন। এটি তাঁর জন্য একটি ‘মোড় ঘোরানো’ মুহূর্ত ছিল।
২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় অফির প্রথম তাঁর সমালোচনামূলক মতামত প্রকাশ্যে আনেন। ৫০ দিনের ওই যুদ্ধে ৫৫১টি শিশুসহ দুই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন।
অফির ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। তা ছিল, ইসরায়েলিরা গাজার আগুন দেখছেন একটি পাহাড় থেকে, যা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়েছিল।
দ্রুতই অফিরের এক আত্মীয় তাঁকে ই–মেইলে লেখেন, তিনি যেন ‘ইন্টারনেটে পোস্ট দেওয়া বন্ধ করেন।’ বছর কয়েক পর অফির জানেন, তাঁর পরিবার রাজনৈতিক আলোচনা এড়িয়ে চলে, যাতে তাঁর মতামত স্বীকৃতি না পায়।
৭ অক্টোবরের পর অফির তাঁর আত্মীয়দের খোঁজ নেন। হামাসের হামলার স্থলের কাছাকাছি থাকতেন তাঁরা। কিন্তু তাঁর ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান বদলায়নি।
‘আমার দৃষ্টিভঙ্গি তেমন বদলায়নি। কিন্তু ইসরায়েলি সমাজ বদলে গেছে। সেদিক থেকে বলা যায়, আমরা আরও রাজনৈতিকভাবে দূরে সরে গেছি,’ বলেন অফির।
নেদারল্যান্ডসে বসবাসকারী ৪৪ বছর বয়সী ড্যানিয়েল ফ্রিডম্যান দক্ষিণ আফ্রিকায় বড় হয়েছেন। তাঁর বাবা স্টিভেন একজন শিক্ষাবিদ ও স্পষ্টভাষী জায়োনিজমবিরোধী। তাঁর মা একসময় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কাজ করতেন।
বাবা এখনো তাঁর জায়োনিস্টবিরোধী অবস্থান ধরে রেখেছেন। তবে ২০২৩ সাল থেকে গাজায় চলমান গণহত্যা নিয়ে ফ্রিডম্যান ও তাঁর মায়ের মধ্যে মতবিরোধ বাড়ছে।
আরও পড়ুনইসরায়েলে এত বড় বিক্ষোভ-ধর্মঘটের কারণ কী০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘এটাই এখন মূল ইস্যু। কিছু ইহুদি কমিউনিটির মধ্যে কথা বলা আর সম্পর্কের ওপরে এ একটা বিষয়ই এখন সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে,’ বলেন ফ্রিডম্যান।
ফ্রিডম্যান ও তাঁর মায়ের মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক ছিল। সেটি হলো, ৭ অক্টোবরের ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে। এটি পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন লিংক পাঠিয়ে তাঁরা (মা–ছেলে) একে অপরকে প্রমাণ দিতে চেষ্টা করতেন। পরে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, রাজনীতি নিয়ে আর কথা বলবেন না।
‘আমি মাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার বিশ্বাস অনেকটাই কমে গেছে,’ বলেন ফ্রিডম্যান।
আরও পড়ুনজিম্মিদের উৎসর্গ করে হলেও যুদ্ধে জিততে চান নেতানিয়াহু, বিভক্তি বাড়ছে ইসরায়েলে১৯ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনইসরায়েলবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ ২২ মার্চ ২০২৫