যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের সাবেক পরিচালক জেমস কোমিকে ‘নোংরা পুলিশ’ বলে অভিহিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটি পোস্টকে ঘিরে গতকাল শুক্রবার এমন মন্তব্য করেন তিনি। ট্রাম্পের দাবি, কোমি ওই পোস্টের মধ্য দিয়ে তাঁকে হত্যার গোপন আহ্বান জানিয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার জেমস কোমি ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন, যেটি পরে মুছে ফেলা হয়। সেই পোস্টে সামুদ্রিক শামুকের একটি ছবি ছিল। শামুকের গায়ে লেখা ছিল ‘৮৬ ৪৭’।

‘৮৬’ সংখ্যাটি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো একটি সংকেত বোঝানো হয়। যা দিয়ে সাধারণত ‘মেরে ফেলা’ বোঝানো হয়। আর ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট।
শুক্রবার ফক্স নিউজে সম্প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ‘ওটা দিয়ে ঠিক কী বোঝায়, তা তিনি (কোমি) জানতেন। ওটার মানে ছিল হত্যা, আর সেটা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এখন কথা হলো, তিনি খুব একটা দক্ষ নন। তবে ওটার মানে বোঝার মতো দক্ষতা তো তাঁর আছেই।’

আরও পড়ুনসাবেক এফবিআইপ্রধানের পোস্টে ‘৮৬ ৪৭’ সংখ্যা নিয়ে হইচই: তিনি কি ট্রাম্পকে হত্যার আহ্বান জানিয়েছেন১১ ঘণ্টা আগে

ট্রাম্প বলেন, ‘তিনি (কোমি) প্রেসিডেন্টকে হত্যার আহ্বান জানাচ্ছেন।’ কোমিকে ‘একজন নোংরা পুলিশ’ বলে আখ্যা দেন ট্রাম্প।

পোস্টটি ডিলিট করার পর ইনস্টাগ্রামে কোমি আরেকটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেদিন সৈকতে হাঁটার সময় কিছু শামুক দেখতে পান এবং তার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। তাঁর মনে হয়েছে, শামুকগুলোতে রাজনৈতিক বার্তা লেখা আছে।

কোমি আরও লিখেছেন, ‘আমি বুঝতেই পারিনি যে কিছু লোক এই সংখ্যাগুলোর সঙ্গে সহিংসতার সম্পর্ক খুঁজে পাবে। সেটা কখনো আমার মাথায় আসেনি, তবে আমি যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরোধী, তাই পোস্টটি মুছে ফেলেছি।’

তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা এতে সন্তুষ্ট নন। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান ক্রিস্টি নোয়েম বলেন, তাঁরা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিক্রেট সার্ভিস বিষয়টি তদন্ত করছে। তিনি আরও বলেছেন, এ ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এফবিআই পরিচালক কাশ প্যাটেল বলেছেন, সংস্থাটি ‘সিক্রেট সার্ভিস’-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেবে।

জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, ‘কোমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার আহ্বান জানিয়েছেন।’

তুলসী আরও বলেন, ‘আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোমির হুমকির বিষয়টি নিয়ে সিক্রেট সার্ভিসের তদন্তকে সম্পূর্ণ সমর্থন করি।’

গতকাল শুক্রবার মার্কিন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, কোমিকে তাঁর পোস্টের বিষয়ে সিক্রেট সার্ভিস জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

ট্রাম্প গত বছরের জুলাইয়ে পেনসিলভানিয়ার বাটলার শহরে একটি নির্বাচনী সমাবেশ করার সময় হত্যাচেষ্টার শিকার হন। ওই সময় তিনি কানে আঘাত পান। এর পর থেকে আরও বেশ কিছু হুমকি পান ট্রাম্প।

কোমি ও ট্রাম্পের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনাপূর্ণ। ২০১৭ সালে ট্রাম্প তাঁকে এফবিআই প্রধানের পদ থেকে বরখাস্ত করেন। বরখাস্ত হওয়ার সময় কোমি একটি তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ওই তদন্তের উদ্দেশ্য ছিল, ট্রাম্পের সহযোগীরা আগের বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে মস্কোর সঙ্গে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখা।

ডেমোক্র্যাটদের অভিযোগ, ট্রাম্প ওই তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছিলেন। তবে ট্রাম্পের দাবি, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের ই–মেইলসংক্রান্ত তদন্তে ঠিকভাবে সামাল দিতে না পারায় তিনি কোমিকে বরখাস্ত করেছিলেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি

কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।

করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।

বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।

অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।

সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।

আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।

বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।

ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।

যা করা যেতে পারে:

ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।

শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।

সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ