ধারাবাহিক অস্থিরতা ও জনসাধারণের মতামত
Published: 19th, May 2025 GMT
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদমুখর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছুরিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাম্য জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেমন নানা ঘটনার কথা জানা যাচ্ছে, তেমনি সামনে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গ। অবশ্য নিরাপত্তাহীন এখন সারাদেশের মানুষই। পর্যুদস্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি কোনোভাবেই হয়ে উঠছে না। খুন-জখম-মারপিট নিত্যকার স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একের পর এক দাবি নিয়ে রাজপথে হাজির হচ্ছে। যখন তখন যেখানে সেখানে অবস্থান নেওয়ার কারণে রাজধানী প্রায়ই নিশ্চল হয়ে উঠছে। দুঃসহ যানজটে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। গত সপ্তাহে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আবাসিক সুবিধাসহ তিন দফা দাবিতে কাকরাইলে রাস্তা অবরোধ করেন। বুধবার শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন ডিপ্লোমাপড়ুয়া নার্সরা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নগর ভবন তিন দিন ধরে অবরুদ্ধ বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে। সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যরা চার দফা দাবিতে রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
এ কথা সত্য, দেড় দশকে গণতন্ত্রহীনতার কারণে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় অব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলাহীনতার পাহাড় জমে উঠেছে। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সংগত কারণেই প্রায় সব সেক্টরে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিষ্পেষিতরা রাজপথে দাবিদাওয়া জানাতে শুরু করেন। প্রথমদিকে যুক্তিগ্রাহ্য হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এলোপাতাড়ি দাবিদাওয়া ও ধারাবাহিক বিশৃঙ্খলায় প্রশ্ন করতেই হয়– সরকার কেন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হচ্ছে? সরকার বিভিন্ন বিষয়ে উদ্যোগও নিচ্ছে; তাহলে সুশাসন অনুপস্থিত কেন? তাদের অগ্রাধিকার তবে কোন কোন ক্ষেত্রে?
২.
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলবার নেই। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পুলিশকে অপব্যবহারের ফলে এই বাহিনীর যে মনোবল ভাঙে, তা ফিরিয়ে আনবার যথাযথ ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি; পূর্বাপর বিবেচনা না করে নানা তুঘলকি সিদ্ধান্ত পুলিশ বাহিনীর ওপর চাপানো হচ্ছে। সর্বশেষ বলা হয়েছে, পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র থাকবে না! হায় বিধি! সশস্ত্র সন্ত্রাসী নিধনে নিরস্ত্র পুলিশ বাহিনী আদৌ কী করে মোকাবিলা করতে যাবে– এই বিবেচনাও সরকার করছে না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় একের পর এক হিমশিম খাওয়ার দৃষ্টান্ত রাখছেন, তখন এই ব্যক্তিকে একাধারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। এর মানে কী? আমাদের দেশে কৃষি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান খাতের একটি– স্বরাষ্ট্র নিয়ে হাবুডুবু খাওয়া ভদ্রলোককেই কেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে হবে? দেশে কৃষিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ নেই!
একইভাবে কোন বিবেচনায় বা মাপকাঠিতে কোনো কোনো উপদেষ্টার হাতে তিন-চারটি করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, তা কেউ জানে না। দেশে কাজ করবার মতো ব্যক্তিবর্গের এত অভাব? এত যে সংস্কার বলে সরকারি তরফ থেকে উচ্চ নিনাদে বারতা জানানো হচ্ছে বারংবার; মন্ত্রণালয় বা আমলাতন্ত্র পরিচালনায় সরকারের ৯ মাসে আদৌ কোনো রকম সংস্কার প্রস্তাব বা উদ্যোগ দেখা গিয়েছে? না, যায়নি। যে গড্ডল প্রবাহে আওয়ামী লীগ বা আগের সরকারগুলো মন্ত্রণালয় ও আমলাতন্ত্র পরিচালনা করেছে, সেই একই ধারায় বর্তমান সরকারও নিজেদের কাজ চালাচ্ছে। কোনো পরিবর্তন নেই।
৩.
চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় ও লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগ সরকার। বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা তখনই সিদ্ধান্তটির বিরোধিতা করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের দিয়ে এ কাজ করাতে হবে, যেভাবেই হোক’ (প্রথম আলো, ১৫ মে ২০২৫)।
আমরা জানি, একটি রাষ্ট্রের যে কোনো কিছুর সাফল্য নির্ভর করে সুশাসনের ওপর। সুশাসনই তদারকি নিশ্চিত করে। যথাযথ তদারকি বা জবাবদিহি না থাকলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানও ব্যর্থ হতে বাধ্য। তবে এই বিতর্ক এখন কেন? কিংবা মিয়ানমার করিডোর? সেন্টমার্টিন নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা! দেশের মানুষের সামনে বর্তমানে বন্দর ব্যবস্থাপনা, করিডোর বা সেন্টমার্টিন বেশি জরুরি, নাকি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বেশি জরুরি?
যে গণতন্ত্রের দাবিতে, জাতিসংঘের হিসাবমতে ১ হাজার ৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন, সেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের প্রধান কর্তব্য। সেটি অনুপস্থিত হয়ে অনুল্লেখ্য কর্তব্যে সরকার মনোযোগী হয়ে ওঠায় চারদিকে নানা খাতে অস্থিরতা ও অবিশ্বাস ঘন হয়ে উঠছে। সেই কাজে সরকার গত ৯ মাসে কতখানি আগ্রহ দেখিয়েছে, তা এরই মধ্যে নানা সন্দেহের অবতারণা করেছে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বৈঠক, নানা কথাবার্তা– এসবে সাধারণ মানুষের ক্লান্তি আরও বাড়ে। সাধারণ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে এত ঢাকঢাক গুড়গুড় করতে হয় কেন? অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চিত করবে যাতে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকে; মানুষ ইচ্ছামতো নিজের ভোট দিতে পারে। এ জন্য ন্যূনতম যতখানি পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি জরুরি, তা নিয়ে সরকারকে ব্যগ্র হতে দেখি না। বরং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যমুনা টেলিভিশনের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘(বন্দর ব্যবস্থাপনা) মতৈক্যের বিষয় না। কয়দিন পরে বলবেন, আপনাদের মতৈক্য ছাড়া ট্যাক্সও উঠাবেন না।... আমি বিপ্লবের ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছি এখানে। (বন্দর ব্যবস্থাপনা) বিদেশিদের হাতে দিলে জব তৈরি হবে। দশ-পনের বছর ধরে উন্নয়নের গল্প করেছেন, কিন্তু জব ছিল না। ইয়াংম্যান আর অ্যাংরি, ইয়াংওম্যান আর অ্যাংরি!’ (১৭ মে, যমুনা টেলিভিশন)।
বিপ্লবের ম্যান্ডেট? দুঃখিত, জনগণের ম্যান্ডেট এভাবে দাবি করবার বিষয় নয়। এই ভাষা ও ভঙ্গি অগণতান্ত্রিক। যে দেশে গত দেড় দশকে অন্তত তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে মানুষকে অপমান ও লাঞ্ছিত করার পরিণতি কড়ায় গণ্ডায় ক্ষমতালোভীদের বুঝিয়ে দিয়েছে এ দেশের ছাত্র-জনতা; সেই দেশে গণতন্ত্রের বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। সাধারণ মানুষ তার দরজায় ভোটপ্রার্থীর নম্র চেহারাই দেখতে চায়। স্বৈরাচারের উদ্ধত-অহংকারী দম্ভের পরাজয় ঘটবার ৯ মাস পরও আকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সংকল্প ও নিষ্ঠার সুস্পষ্ট প্রকাশের ঘাটতি আপত্তিকর। তার বদলে অপ্রয়োজনীয় কাজের জানালা খোলার চেষ্টাও উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
আমরা ঘরপোড়া জাতি। সিঁদুরে মেঘ দেখলে তাই ভয় পাই। এ দেশে ক্ষমতার চেয়ার বড়ই আরামদায়ক। ক্ষমতাবানেরা সব পেয়েছির বাদশায় পরিণত হন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, গণতন্ত্রের জন্য যে বিপুল আত্মত্যাগ ও সুদীর্ঘ আন্দোলনের পথরেখা, তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে অতিদ্রুত সরকার সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশ করবে। সরকার তার অগ্রাধিকার কার্যতালিকা ঘোষণা করলেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ অপেক্ষমাণ হয়ে শান্ত হবে। প্রত্যেকেই বিশ্বাস করতে চায়– তার ভোটে নির্বাচিত সরকার এসে ধাপে ধাপে সকলের দাবি পূরণে কাজ শুরু করবে।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণতন ত র র সরক র র উপদ ষ ট
এছাড়াও পড়ুন:
প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতাকে সীমায় আনবে কে
যখন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ বেড়ে চলেছে, তখন নাগরিক কোয়ালিশন নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ এক সংলাপের আয়োজন করেছে। ১১ মে আয়োজিত এই সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, কয়েকটি সংস্কার কমিশনের প্রধান ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন।
নাগরিক জোটের পক্ষ থেকে সাত দফা প্রস্তাবও উত্থাপন করা হয়, যা জট কাটাতে সহায়ক হতে পারে। তবে ওই সংলাপে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায় মনে হয়, তাঁরা নিজ নিজ অবস্থানে অনড় আছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে দেওয়া বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। অনেকটা সেই গ্রামীণ প্রবাদের মতো, ‘সালিস মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার।’
সংলাপে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতার বিষয়টিও উঠে আসে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বাংলাদেশ যখন সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রবেশ করল, তখন রাষ্ট্রপতির হাতে যে অভাবনীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, সেই ক্ষমতার প্রতিটি অংশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
তবে আমাদের এটাও জানা আছে যে ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দিয়েছিল, পরবর্তী রাষ্ট্রপতিরাও তা ভোগ করেছেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে। আমাদের এখানে একদলীয়, বহুদলীয়, রাষ্ট্রপতিশাসিত কিংবা সংসদীয় শাসন—সবই পরিচালিত হয় ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। এক ব্যক্তি কয়বার প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেটা নিয়ে যে বিএনপি ও অন্যান্য দল বিতর্ক করছে, তা–ও ওই ব্যক্তিকে সামনে রেখে। আগে আপনারা সংস্কারের মৌলিক বিষয়ে একমত হোন, এরপর মেয়াদ ঠিক করা যাবে।
আমাদের রাজনীতিকেরা ভুলে যান যে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে দলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে যা–ই লেখা থাকুক না কেন, তাদের গণতান্ত্রিক উপায়ে নেতৃত্ব নির্বাচনের রেওয়াজ নেই। দলের সম্মেলন হওয়ার আগে ‘নেতা’ ঠিক করে রাখে।
সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, এর প্রায় সবটা নিয়ে আলোচনা করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান তাঁর অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইয়ে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এ বইয়ে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
আকবর আলি খান যে প্রশ্ন রেখেছিলেন, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের পথে যাচ্ছে কি না। আমরা তার চূড়ান্ত রূপ দেখলাম আওয়ামী লীগ শাসনামলে। তিনি আরও লিখেছেন, ক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ফ্রান্সের বুরবন সম্রাট, রাশিয়ার জার ও মোগল বাদশাহর সঙ্গে তুলনীয়।
সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে তিনি যে রূপ স্থির করিবেন, সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে। ২. প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্ব এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে। ৩. মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।
১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রের অন্য সব নাগরিকের ওপর স্থান দিলেও কোনো ক্ষমতা দেয়নি। সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ ছাড়া সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি যুক্ত হয়।
সংসদীয় ব্যবস্থায় এত দিন একই ব্যক্তি ছিলেন একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, দুই দলের আমলেই এমনটি ছিল। এতে সরকার, সংসদ ও দলে এক ব্যক্তির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না।বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ শাসিত ব্যবস্থার বদলে প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। অন্যান্য দেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত ব্যবস্থায় অন্য মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর অধীন নন, তিনি তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে ‘প্রথম’। আর বাংলাদেশে এত দিন যা চলছিল, সেটি হলো প্রধানমন্ত্রীই মন্ত্রিসভার প্রধান, অন্যরা তাঁর অধীন। তিনি চাইলে যেকোনো সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী করতে পারেন, যেকোনো মন্ত্রীকে যেকোনো সময় বিদায় দিতে পারেন। এমনকি তিনি বিরোধী দল থেকেও মন্ত্রী নিতে পারেন।
২০১৪-২০১৮ সংসদে জাতীয় পার্টি ছিল বিরোধী দলে। অথচ সেই দলের একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। এটা ছিল বিরোধী দলহীন সংসদকে বিরোধী দল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা। সংসদীয় গণতন্ত্রে একই সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও বিরোধী দলে থাকার সুযোগ নেই।
আকবর আলি খানের মতে, কেবল আইন করেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ানো হয়নি, বিধিমালায়ও তাঁকে যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এর দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে।
বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে ছয়জন মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা, দুজন সচিব এবং তাঁদের সমর্থনের জন্য উপযুক্ত অতিরিক্ত, যুগ্ম ও সহকারী সচিবের সমন্বয়ে এক বিরাট দাপ্তরিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সচিবালয়ের কর্মকর্তারা মন্ত্রীদের দ্বারা পরিচালিত মন্ত্রণালয়গুলোর বিভিন্ন কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। এর ফলে মন্ত্রীরাও হয়ে পড়েন হুকুমবরদার।
সংসদীয় ব্যবস্থায় এত দিন একই ব্যক্তি ছিলেন একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, দুই দলের আমলেই এমনটি ছিল। এতে সরকার, সংসদ ও দলে এক ব্যক্তির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটাকে এই মুহূর্তে অসম্ভব মনে হলেও আমাদের সেখানেই যেতে হবে, যদি আমরা ব্যক্তিতন্ত্রের স্থলে গণতন্ত্র এবং প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসনব্যবস্থার বদলে মন্ত্রিসভা শাসিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
আমরা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলে পরিত্যাগ করেছি। এর জন্য জনগণকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু একানব্বই সালে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম হলো, তাতে রাষ্ট্রপতির সমুদয় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতেই অর্পণ করা হলো। আইন ও বিধিমালা এমনভাবে তৈরি করা হলো, যাতে প্রধানমন্ত্রী পদটি থেকে গেল সবার ওপরে।
প্রধানমন্ত্রীও একটি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করে জয়ী হন। অন্য মন্ত্রীরাও নিজ নিজ আসনে নির্বাচন করে জয়ী হন। অর্থাৎ দুজনই জনপ্রতিনিধি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর হাতে অবারিত ক্ষমতা।
৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে যেমন সাধারণ সদস্যদের হাত–পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তেমনি মন্ত্রীদেরও প্রধানমন্ত্রীর কৃপাপ্রার্থী করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ঠিক করেন কাকে কোন মন্ত্রণালয় দেবেন, ওই মন্ত্রণালয়ে তাঁর কাজের কোনো যোগ্যতা থাকুক আর না–ই থাকুক।
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দল আন্দোলন করছিল, তখন স্যার নিনিয়ান একটি আপস প্রস্তাব দিয়েছিলেন, নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় সরকারি ও বিরোধী দল থেকে সমানসংখ্যক মন্ত্রী নেওয়া হবে এবং আগের সংসদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই সরকারের প্রধান থাকবেন। সে সময় বিরোধী দল তা মানেনি এই যুক্তিতে যে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই তো সব ক্ষমতা। অন্য মন্ত্রীরা নিমিত্ত মাত্র।
যে বিরোধী দল আন্দোলন–সংগ্রাম করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কায়েম করেছিল, তারাই ক্ষমতায় এসে সেটি বাতিল করে দেয় আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে। আওয়ামী লীগ সরকার যখন পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের তোড়জোড় করে, তখন দলের ভেতরে ও বাইরে প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরাও সেই রকম মত দিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে সেটি বাতিল করা হয়। অর্থাৎ গণতন্ত্রের চেয়ে ব্যক্তির ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছে। ভবিষ্যতে যে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)