জনসাধারণের সমস্যা নিয়ে সরকার কতটা চিন্তিত
Published: 3rd, July 2025 GMT
গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের আশা ছিল, দেশে স্থিতিশীলতা ও স্বস্তি ফিরে আসবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক পরিচিতি, অরাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল সহজ-সরল ও বাস্তবঘনিষ্ঠ: হয়তো জীবন কিছুটা সহজ হবে। বাস্তবে সে প্রত্যাশার ফল মিলছে না।
দেশের জনসাধারণের প্রতিদিনের বাস্তবতা– খাবার জোগাড়, বাসা ভাড়া, সন্তানের পড়ালেখা, অসুখ হলে চিকিৎসা, মাস শেষে ধার না করে চলার চেষ্টা। এসবই তাদের জীবনের মুখ্য বিষয়; শহর-পল্লি নির্বিশেষে। কোথাও হয়তো বাসা ভাড়ার প্রশ্নটি নেই; আছে অন্যান্য খরচের বিষয়। লেখাপড়ার কারণে বাড়ি থেকে দূরে থাকা সন্তানের হোস্টেল বা মেস ভাড়া দেওয়ার চিন্তা।
এমন বাস্তবতায় আম জনতা রাজনীতিতে সরাসরি আগ্রহ না দেখালেও রাজনীতির যে কোনো পট পরিবর্তন তাদের জীবনে প্রবল প্রভাব ফেলে। গত এক বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আয় না বাড়া, খরচের চাপ মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। টিসিবির পণ্যের লাইনে ভিড় বেড়েছে, অথচ স্বস্তির আশা কমেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত তিনটি লক্ষ্য– সংস্কার, বিচার এবং অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোরও দাবি। সাধারণ মানুষও এগুলোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। কিন্তু এসব উদ্যোগ তাদের জীবনের বাস্তব সংকট দূর করার সঙ্গে কতটা যুক্ত– তা নিয়ে এখন সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পার হয়েছে, কিন্তু স্বস্তির দেখা মেলা ভার।
দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য ক্রেতার নাগালে নিয়ে আসা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন– এসব বিষয়ে জনগণ যে ধরনের অগ্রগতি দেখতে চেয়েছিল, তা হচ্ছে না। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বড় তিনটি কাজের ঘোষণা সাধারণ মানুষের কাছে ‘বিমূর্ত ছবি’ হয়ে উঠছে। আম জনতার প্রাথমিক চাওয়া– নিরাপদ জীবন, শান্তিতে ঘুমানো, সঞ্চয়ের সামান্য সুযোগ, আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা। এই মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণেও যদি সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক শব্দ হয়েই থাকবে।
১২ মাসের মাথায় দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে বলা যায়– অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো স্বচ্ছতা ও নিয়মিত জনসংযোগের অভাব। শুরু থেকেই যদি সরকারের পক্ষে প্রতি সপ্তাহে কিংবা অন্তত ১৫ দিন অন্তর জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়া হতো; তাদের কাজের অগ্রগতি, উদ্দেশ্য এবং সাধারণ মানুষের জীবনে সরকারের কাজের প্রভাব ব্যাখ্যা করা হতো; তাহলে অনিশ্চয়তা, গুজব ও ভুল ব্যাখ্যার জায়গা তৈরি হতো না।
পাশাপাশি আরেকটি সংকট জনমানসে জায়গা করে নিচ্ছে। সরকার যেন কেবল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর দাবি পূরণেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছে। এতে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিশেষত বেসরকারি খাত, খেটে খাওয়া, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ নিজেদের বঞ্চিত মনে করছে। এ বঞ্চনা থেকে তৈরি হচ্ছে গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ, যা দীর্ঘস্থায়ী হলে সরকারের জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে এখন সবচেয়ে জরুরি সরকারের এমন একটি রোডম্যাপ, যা জনগণের মৌলিক চাহিদার প্রতিফলন ঘটায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মসংস্থানমুখী আর্থিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখানো না গেলে সংস্কার-বিচার-নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন হয়ে যাবে। এমনিতেই এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশের অন্যতম বৃহত্তম আবাসন খাত স্থবির হয়ে পড়ায় সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানা ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ লক্ষাধিক মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। টাকার হাতবদল কমে যাওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে কর্মসংস্থানের অন্যান্য খাত। এ নিয়ে সরকারের দিক থেকে কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন যা করতে হবে: জনগণের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে সরকারের পরিকল্পনাকে যুক্ত করা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ এবং মানুষের অর্থনৈতিক কষ্ট লাঘবে কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃত সাফল্য বিচার হবে এই প্রশ্নে– সাধারণ মানুষের কতটা পাশে দাঁড়িয়েছে; তাদের কতটা শোনার চেষ্টা করেছে এবং তাদের কতটা মর্যাদা দিয়েছে।
জনগণ বড় বড় প্রতিশ্রুতি চায় না। তারা চায় দেশের সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন আয়োজনের আড়ালে যেন তাদের বেঁচে থাকার মতো জীবন বিনষ্ট বা বিপর্যস্ত না হয়। তারা চায় যেন বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ বহাল থাকে। যেখানে খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকবে, শোনার মতো সরকার থাকবে এবং সম্মান নিয়ে বাঁচার সুযোগ থাকবে। যদি সরকার সেই মৌলিক মানবিক শর্তগুলোও পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হতে পারে। কারণ জনগণ যদি পাশে না থাকে, তাহলে কোনো সরকারই টিকতে পারে না। সেটা অন্তর্বর্তী হোক বা নির্বাচিত।
মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মত মত সরক র র প র জন ত র জ বন র কতট
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি ও জামায়াত কে কোন ফ্যাক্টরে এগিয়ে
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের তারিখ এখনো জানা যায়নি, তবে সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। এখন সরকার বা কোনো দলের পক্ষেই নির্বাচনের বাস্তবতা থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। কোন দল কতটা প্রস্তুত, কোন দলের জনসমর্থন কেমন এবং কে আসবে ক্ষমতায়—চায়ের কাপের আড্ডা থেকে শুরু করে সর্বত্র এ নিয়েই আলোচনা চলছে।
এ আলোচনা হচ্ছে পারিবারিক খাবার টেবিলে, গ্রামগঞ্জে, চায়ের দোকানে, শহরের ক্যাফেতে; আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো বটেই। ইন্টারনেটের যুগে এসব আলোচনার কোনো ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা নেই।
তবে বেশির ভাগ আলোচনাই এখনো সাময়িক বা টেনটেটিভ—পরিপক্বতার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করেই আমাদের এ আলোচনা।
রাজনীতিতে জনগণ খুঁজছে কিছু আকাঙ্ক্ষিত ফ্যাক্টরজনগণ এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না—দলগুলোর অবস্থান তাদের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে কতটা মেলে এবং কোন দল সত্যিকারে দেশের শাসনক্ষমতা নিয়ে একটি সম্ভাবনাময় সরকার গঠন করতে পারবে। তবে অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যেও কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেশির ভাগ মানুষ এখনো দলগত সমর্থনে স্থায়ী বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। জনগণ তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার উপাদানগুলোকে দলগুলোর সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করছে।
যেসব দল শৃঙ্খলাবোধ প্রদর্শন করতে পারছে এবং নিজেদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারছে, এখন পর্যন্ত তারাই তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান বলে মনে হচ্ছে।
একটা বিষয় স্পষ্ট—দেশের জনগণ চায়, প্রতিটি দল তাদের নেতিবাচক কার্যকলাপ থেকে বেরিয়ে আসুক। রাজনীতিতে ক্রমাগত বিশৃঙ্খলা দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
আরেকটি বিষয়, যা সাধারণ জনগণের খুবই অপছন্দ, তা হলো রাজনীতিবিদদের বাগাড়ম্বর। যাঁরা সফল হতে চান, তাঁদের শৃঙ্খল ও শালীন হতে হবে।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘রাজনীতিতে ডান ও বামের বিভাজন মুছে যাচ্ছে।’
সত্যিকার অর্থে দেশের মানুষ এখন আর আদর্শিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। গত ৩৫ বছরে আদর্শিক রাজনীতি ‘প্রমোট’ ও প্রচার করতে গিয়ে রাজনীতিবিদেরা দেশে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের সেই আদর্শ জনগণের কোনো উপকারে আসেনি।
তাই আপাতত আদর্শ ও দফাভিত্তিক রাজনীতি সম্ভবত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বামপন্থী দলগুলো। তারা আদর্শের কলহে রাজনীতির বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছে।
আরেকটি বিষয় এখনো খুব আলোচনায় আসেনি, সেটি হলো, বাংলাদেশে রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পদচারণকে দেশের জনগণ ইতিবাচকভাবে দেখছে। তবে এককভাবে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণ আগে কখনো পূর্ণমাত্রায় সমর্থন দেয়নি।
আরও পড়ুনবিএনপি-জামায়াতের চার যুগের বন্ধুত্বের কী হলো১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশগুলো (পাকিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত) প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিষয়টি প্রযোজ্য। কোনো রাজনৈতিক দলের নামে ‘ইসলাম’ শব্দটি থাকলেই যে আমাদের দেশের ধর্মভীরু মানুষ দলবদ্ধভাবে তাদের ভোট দেবে, তা কখনো হয়নি এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও হবে না।
যেসব রাজনৈতিক দল বৃহত্তর পরিসরে সাংগঠনিকভাবে আমাদের সমাজ ও জনগণের মতোই দেখতে, তারাই সব সময় ব্যাপকভাবে জনগণের স্বীকৃতি পাবে।
যেসব উপাদান বা ফ্যাক্টর বিবেচনা করে জনগণ এবার রাজনৈতিক দলগুলোকে বিচার করতে পারে, সেগুলো হলো—
১. সুশৃঙ্খল ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার;
২. নেতিবাচক কার্যকলাপ পরিহার এবং শুদ্ধ রাজনীতির ধারক হওয়া;
৩. ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুত্ববাদী সংমিশ্রণে দলীয় সংগঠন গঠন;
৪. আদর্শের রাজনীতি নয়, বরং দেশ পরিচালনায় বাস্তব সক্ষমতা।
এ পর্যায়ে আমরা বর্তমান বড় দুই রাজনৈতিক দল—বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নিয়ে কথা বলব এবং দেশের রাজনৈতিক সংলাপে তাদের অবস্থানকে এই চার ফ্যাক্টরের নিরিখে মূল্যায়ন করব।
এনসিপি: ‘চাপের রাজনীতি’ ছাড়তে হবেএ আলোচনা থেকে আমরা এনসিপিকে বাইরে রাখব দুটি কারণে। প্রথম কারণ হলো, এনসিপির রাজনৈতিক পরিচিতি এখনো বিকশিত হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, এখন পর্যন্ত এনসিপির সব কার্যক্রম শুধু জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে। ভোটের রাজনীতিতে তাদের খুব উৎসাহভরে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এনসিপি নিশ্চয়ই বাস্তবতা মেনে নিয়ে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের আরও প্রসারিত করবে।
এনসিপি সম্বন্ধে একটা মন্তব্য এখানে বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সেটি হলো, তারা দলীয়ভাবে ‘চাপের রাজনীতি’কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যেমন শাপলা প্রতীক দিতেই হবে এবং অন্য সব বিষয়ও তাদের চাওয়ামতো হতে হবে। তাদের এই ‘চাপের রাজনীতি’ যে জনগণ খুব পছন্দ করছে না, তা তাদের বুঝতে হবে।
বিএনপি আগেও ক্ষমতায় ছিল। তাদের দলে অনেক পরিচিত নেতা রয়েছেন, যাঁরা আগেও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার চালিয়েছেন। এটাও সত্য, তাদের কিছু নেতার বিতর্কিত অতীত রয়েছে। বিএনপিতে তরুণ একটা উচ্চশিক্ষিত গ্রুপও অপেক্ষা করছে নেতৃত্বে যোগ দিতে। তাঁদের অনেকেই নিজেদের মা–বাবার হাত ধরে বিএনপিতে এসেছেন। সব মিলিয়ে বিএনপি দাবি করতে পারে, তারা দেশ পরিচালনায় সক্ষম একটা রাজনৈতিক দল। বিএনপির ঘাটতি ও শক্তি কোথায়বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলাভিত্তিক নেতারা গত ১৫ বছর সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আছেন, যেদিন অনুকূল পরিবেশে কে কোথায় শীর্ষ প্রতিনিধি বা সংসদ সদস্য হবেন, তা নির্ধারিত হবে। কোনো কোনো এলাকায় বিএনপির ১৫ থেকে ২০ জন সম্ভাব্য প্রার্থী দাঁড়িয়ে আছেন। একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে তারা যত বেশি বিশৃঙ্খলা দেখাবে, ততই দলের নেতিবাচকতা বাড়বে।
বিএনপির চাঁদাবাজি, দখলদারি—এসব নেতিবাচক দিক এমনিতেই দিন দিন ‘আয়তনে’ বাড়ছে। দলকে শুদ্ধ করার তাদের ‘দন্তহীন’ প্রচেষ্টাগুলো কোনো কাজ দেয়নি। ডাকসু নির্বাচনের পরেই বলেছিলাম, বিএনপিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। পরবর্তী সময়ে জাকসু, চাকসু ও রাকসুর ফলাফলেও তা প্রতিফলিত হয়েছে।
ধারণা করি, শিবিরের ‘ভালোত্ব’ নয়, আদতে বিএনপির জন্যই ছাত্রদল তলিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদলের দুর্ভোগ বিএনপির নির্বাচনী ভাগ্যেকে কতটুকু পিছিয়ে দেবে, সেদিকে সবারই চোখ থাকবে।
আরও পড়ুনবিএনপি ও এনসিপির টানাপোড়েনে ‘প্রিজনার্স ডিলেমায়’ পড়তে পারে দেশ ১৩ আগস্ট ২০২৫ডাকসুতে ছাত্রদলের হার, বিএনপিকে যা ভাবতে হবেবিএনপির সবচেয়ে বড় সুবিধা, তারা আমাদের দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের ছোট-বড় যেকোনো সমাবেশে গেলে সেগুলোকে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর একটা ভালো নমুনা মনে হবে। তাদের মধ্যে কিছুটা মৌলবাদী ঘরানার, কিছুটা ভাসানী–সমর্থক ঘরানার, কিছুটা মুজিবীয় ঘরানার, কিছুটা জাতীয়তাবাদী, কিছুটা বামপন্থী—সবই পাওয়া যাবে।
বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি—দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিএনপির এই বহুত্ববাদী রঙে আশ্বস্ত হবে। বৃহত্তর সমাজের ভারসাম্য বজায় না রাখতে পারলে যে উত্তাল অবস্থা হবে, তাতে কেউ–ই নিরাপদ থাকবে না।
বিএনপি আগেও ক্ষমতায় ছিল। তাদের দলে অনেক পরিচিত নেতা রয়েছেন, যাঁরা আগেও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার চালিয়েছেন। এটাও সত্য, তাদের কিছু নেতার বিতর্কিত অতীত রয়েছে। বিএনপিতে তরুণ একটা উচ্চশিক্ষিত গ্রুপও অপেক্ষা করছে নেতৃত্বে যোগ দিতে। তাঁদের অনেকেই নিজেদের মা–বাবার হাত ধরে বিএনপিতে এসেছেন।
সব মিলিয়ে বিএনপি দাবি করতে পারে, তারা দেশ পরিচালনায় সক্ষম একটা রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে এ দাবি করা সহজ হবে না। যতই ভোটের সময় কাছে আসবে, ততই ‘দেশ পরিচালনায় সক্ষমতা’ ফ্যাক্টর বিএনপির জন্য সহায়ক হবে।
দুর্নীতিমুক্ত দল হিসেবে জামায়াত নিজেদের জন্য একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই ইমেজ অনেকটা তুলনামূলক। যেমন ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের যত নেতিবাচক ঘটনা জনগণের চোখে ধরা পড়েছে, সে তুলনায় জামায়াতের ঘটনা অনেক কম। সিলেটের সাদাপাথর দুর্নীতিতে দুদকের প্রতিবেদনে যেহেতু সব দলই জড়িত ছিল, সেহেতু সে ঘটনা জামায়াতকে এককভাবে কলঙ্কিত করেনি।জামায়াতে ইসলামী কোথায় এগিয়েদুর্নীতিমুক্ত দল হিসেবে জামায়াত নিজেদের জন্য একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই ইমেজ অনেকটা তুলনামূলক। যেমন ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের যত নেতিবাচক ঘটনা জনগণের চোখে ধরা পড়েছে, সে তুলনায় জামায়াতের ঘটনা অনেক কম। সিলেটের সাদাপাথর দুর্নীতিতে দুদকের প্রতিবেদনে যেহেতু সব দলই জড়িত ছিল, সেহেতু সে ঘটনা জামায়াতকে এককভাবে কলঙ্কিত করেনি।
জামায়াতকে তাদের মনোনীত প্রার্থী নিয়ে খুব বিশৃঙ্খলায় পড়তে হবে না। দলের নেতারাও মোটামুটি একই সুরে কথা বলবেন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে যত বেশি বিশৃঙ্খলায় পড়বে, ততই জামায়াতের ইমেজ ভালো দেখাবে। শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার জামায়াতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে।
জামায়াতে ইসলামীর বিগত কয়েকজন আমিরকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলবেন, বর্তমান আমির শফিকুর রহমানই তুলনামূলকভাবে অধিক নমনীয় এবং পরিবর্তনীয়। তিনি লেখাপড়া করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে, ছাত্রাবস্থায় জাসদের রাজনীতি করতেন। তিনি যেহেতু ডগমা বা প্রচলিত সূত্র ধরে জামায়াতের রাজনীতিতে আসেননি, তাই তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত।
শফিকুর রহমানের কিছু কিছু উদ্যোগ জামায়াতের জন্য ইতিবাচক মনে করা হয়।
সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তায় শফিকুর রহমানের উদ্যোগ—তাদের মন্দিরে গিয়ে অভয় প্রদান—অনেকের কাছে নির্ভেজাল মনে হয়েছে। তিনি হিন্দু জনগণকে জামায়াতকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাঁদের জামায়াত থেকে মনোনয়ন দেওয়ার কথাও বলেছেন। তবে জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও অবকাঠামো যত দিন না বদলাবে, শফিকুর রহমানের একক প্রচেষ্টা সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই জামায়াত এখনো একটা সমজাতীয় বা হোমোজেনাস দল এবং এটা তাদের জন্য নেতিবাচক হয়েই থাকবে।
আরও পড়ুনজামায়াত এগিয়ে, বিএনপি কেন পিছিয়ে ০৪ অক্টোবর ২০২৫জামায়াতকে এখনো বিশেষ আদর্শ বা মতবাদের বাহক হিসেবে গণ্য করা হয়। জামায়াত তাদের আদর্শ ও মতবাদের ভিত্তিতে বড় কোনো সুবিধা পাবে না। আবার যাঁরা জামায়াতকে পাকিস্তানপন্থী বা একাত্তরে পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে পরাস্ত করতে চান, তাঁরাও খুব সুবিধা করতে পারছেন না।
তবে এটা এখনকার অবস্থা—ভবিষ্যতে ‘একাত্তরের ইতিহাস’ হাওয়াইয়ের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো যে কখন জামাতের জন্য বিস্ফোরিত হবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। তবে এখন অন্য ফ্যাক্টরগুলোই বেশি গুরুত্ব নিয়ে সামনে আসছে।
আরেকটা ফ্যাক্টর জামায়াতের বিপক্ষে কাজ করবে। সেটি হলো, দলের ওপরের সারির দু-চারজন নেতা ছাড়া অন্যরা সাধারণ জনগণের কাছে একদম অপরিচিত। একটা কর্মশীল সরকার গঠন এবং সুষ্ঠুভাবে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁরা কতটুকু সক্ষম? কারা দেশের নেতা হবেন?
নির্বাচন যত কাছে আসবে, এই প্রশ্নগুলো আরও সামনে আসবে এবং অধিকতর গুরুত্ব পাবে।
চাই শুদ্ধতা ও বাস্তববাদী সংমিশ্রণনির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, জনগণের মধ্যে এই উপকরণগুলোর যাচাই-বাছাই আরও বাড়বে। কোন কোন উপকরণের গুরুত্ব আস্তে আস্তে বাড়বে কিংবা কোনগুলোর গুরুত্ব কিছুটা কমবে, তার ফয়সালা হতে আরও সময় লাগবে।
কিছু কিছু অনুমান হয়তো করা যায়, তবে এক্ষুনি কোনো শেষ কথা বলা ঠিক হবে না। যেমন একটা পর্যায়ে জনগণ শুধু ‘শুদ্ধ রাজনীতি’ কিংবা ‘দেশ পরিচালনায় সক্ষমতা’-কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভোটকেন্দ্রের দিকে যাবে। আবার এমনটা না–ও হতে পারে; হয়তো তারা সব ফ্যাক্টর বিবেচনা করেই ভোট দেবে।
আরেকটি দেখার বিষয় হলো, ৫ আগস্টের আগে বিএনপি ৪০ শতাংশ জনসমর্থন অধিকারে রাখা দল ছিল। এখন তাদের যারা প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই জামায়াত ছিল ৫ শতাংশ লোকের সমর্থন পাওয়া দল। শুধু বিএনপির নেতিবাচকতা দিয়ে জামায়াত কি জনসমর্থনের এই বিরাট ব্যবধান এত সহজে ঘুচাতে পারবে?
বিশ্বজুড়ে এখন একটা অস্থিরতা চলছে। বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের জনগণ নিজেদের দারুণভাবে প্রতারিত ভাবছে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের জনগণ রাজনীতিতে খুঁজছে শুদ্ধতা ও বাস্তববাদী সংমিশ্রণ। যেসব রাজনৈতিক দল জনগণের চাওয়া–পাওয়ার ফ্যাক্টরগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের নির্বাচনে এগিয়ে আসবে, তারাই বেশি সুফল পাবে এবং সফল হবে।
সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: salehpublic711@gmail
*মতামত লেখকের নিজস্ব