‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের সেই ভয়াবহ রাতে যা ঘটেছিল
Published: 20th, May 2025 GMT
চা শ্রমিকদের মাতৃভূমিতে ফেরার আন্দোলন ইতিহাসে ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। আজ ২০ মে, ১৯২১ সালের এই তারিখে চা শ্রমিকদের চাঁদপুর স্টেশন থেকে নিজ নিজ ভূমির দিকে যাত্রা করার কথা ছিল। অবশ্য শ্রমিক আসা শুরু হয়েছিল মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই।
শুরুর দিকে চাঁদপুর রেলস্টেশনে জড়ো হওয়া শ্রমিকেরা স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সহায়তায় গোয়ালন্দগামী জাহাজে উঠে পড়েন। ওই সময় চাঁদপুরের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন সুশীল কুমার সিংহ। তিনি শ্রমিকদের সহযোগিতা করেছিলেন কিন্তু কিছুদিন পরেই তৎকালীন ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ম্যাকফরসন চাঁদপুর রেলস্টেশনে এসে হাজির হন। পরে ঘটনা নির্বিচারে হত্যার দিকে গড়ায়। তার নির্দেশে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও গোর্খা সৈন্য স্টেশন ঘিরে ফেলে। ট্রেনের টিকেট বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়, জাহাজের পাটাতন তুলে দিয়ে যাত্রীদের মেঘনায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
মোঃ আবুল হাসান অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সদস্য, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, কেন্দ্রীয় কমিটি উপদেষ্টা, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘চা শ্রমিকরা কলিমগঞ্জ রেলস্টেশনে জড়ো হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন নারী ছোট শিশুদেরকে নিয়ে ট্রেনে রওনা দিতে পেরেছিলেন। পুরুষেরা হাঁটা শুরু করেছিলেন। কিছু মানুষ জাহাজে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন এবং কিছু মানুষ জাহাজে উঠতেও পেরেছিলেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে তৎকালীন ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের যে প্রতিনিধি ম্যাকফরসন সে চাঁদপুরে উপস্থিত হয়ে যাত্রীদের জাহাজে উঠতে বাধা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপর জাহাজের পাটাতন সরিয়ে দেওয়া হয়। অনেক শ্রমিক নদীতে ভেসে যান। এই ঘটনা উনিশ, বিশ তারিখ জুড়ে হয়েছে। এবং রাতের বেলা ‘গোর্খা সৈন্য’ অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের ওপর আক্রমণটা করে অনেককে হত্যা করেছে। ’’
আরো পড়ুন:
ঈদের আগে পোশাক শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
হিলিতে আরনু জুটমিল বন্ধ ঘোষণা, শ্রমিকেরা দিশেহারা
গোর্খা সৈন্য সম্পর্কে মোঃ আবুল হাসান জানান, এই চা শ্রমিকদেরকে যারা সংগ্রহ করেছেন তারা মূলত এক ধরণের দালাল। যেসব অঞ্চল থেকে চা শ্রমিকদেরকে আনা হয়েছে, পুরো প্রক্রিয়াতে একটা ব্যবসা গড়ে উঠেছিল। অনেকটা দাস কেনা-বেচার ব্যবসায়ের মতো। চা বাগানে শ্রমিকদেরকে আনার পরে এদের মধ্যে থেকে কিছু মানুষকে মালিকপক্ষ বিশেষ বাহিনী হিসেবে বা গোর্খা পুলিশ হিসেবে ব্যবহার করতো।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একটি বড় অংশ ছিল অসহযোগ আন্দোলন। মুল্লুক চলো আন্দোলনও ছিল এক ধরণের অসহযোগ আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলনে চা শ্রমিকদের সম্পকৃক্ততা নানান ফর্মে, নানান মাত্রায় ছিল। মুল্লুক চলো আন্দোলন ঘিরে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটার পরে সে সময় কংগ্রেসের প্রাদেশিক পর্যায়ের নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বস্ত্রীক চাঁদপুরে এসে বাকি ভূক্তভোগী শ্রমিকদের দেখে যান, খোঁজখবর নেন।
‘‘ওই আন্দালনের জের ধরে সাড়ে চার হাজার রেল শ্রমিকদের টার্মিনেট করা হয়েছিল। তো এই সব ধর্মঘটে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের নানাভাবে ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দিয়েছিলেন দীনবন্ধু, চার্লস অ্যান্ড রুলস। ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে টার্মিনেট করার মতো পরিস্থিতি কিছুদিন আগেও ছিল। আমাদেরকে কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে নানান সময়ে। জবরদস্তির ব্যাপারটা এখনও নানানভাবে আছে। বিমোট এরিয়াতে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানগুলোতে নানা রকম জবরদস্তির নজির পাওয়া যায়।’’—যোগ করেন মোঃ আবুল হাসান
তিনি আরও বলেন, ‘‘কাজ করতে গিয়ে দেখেছি পনেরো বছর আগেও এই জবরদস্তি ব্যাপারটা প্রবল ছিল। এমনকি এখনও জবরদস্তি আছে। একজন চা শ্রমিক যদি চা বাগানে যে ধরণের মজুরি বা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় সে যদি এটা মেনে নিতে না চায় তাহলে আইনগতভাবে বাগানে থাকার সকল অধিকার হারাবে। ২০০৫,’০৭ এই সময়ে যেতাম তখন যাদেরকে সেন্টার করে আমরা যেতাম তাদেরকে নোটিশ করা হতো। বা গ্রাম চৌকিদার ডেকে নিয়ে শোকোজ করা, ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে টার্মিনেট করা; এই ধরণের পরিস্থিতি কিছুদিন আগেও ছিল।’’
বিশ্বের রাজনীতির সুফলগুলো এই চা শ্রমিকদের ঘরে না পৌঁছালেও কুফলগুলো কালে কালে, সময়ে সময়ে ঠিকই পৌঁছেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব থেকেও মুক্ত ছিলেন না তারা।
মোঃ আবুল হাসান বলেন, ‘‘মোটা দাগে বলতে গেলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে চা শিল্প যদিও লাভ করছিল কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের দোহাই দিয়ে যে ধরনের চুক্তিতে কিংবা সুযোগ সুবিধা দেওয়ার আশ্বাসে চা শ্রমিকদের আনা হয়েছিল সেসব সুযোগ সুবিধাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’’
‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে, মার্তৃভূমিতে ফিরতে পারেননি চা বাগানের শ্রমিকেরা। এখনও চলমান আইনের বিরুদ্ধে কথা বলার আইনী সুযোগ নেই কোনো শ্রমিকের। এরপরেও যেটুকু পরিবর্তন এসেছে তার পেছনে রয়েছে ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের অনেক বড় প্রভাব।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জবরদস ত হয় ছ ল ধরণ র
এছাড়াও পড়ুন:
একজনের অসুস্থতায় আটকা ৪ লাখ শিক্ষকের বেতন, আজ মাউশি ঘেরাওয়ের ঘোষণা
মে মাসের অর্ধেক পার হয়েছে। এপ্রিলের বেতন এখনও পাননি সারাদেশের পৌনে ৫ লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী। এরা সবাই মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও)ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যাচ্ছে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক কর্মকর্তার অসুস্থতার কথা। এমন অবস্থায় আজ মাউশি ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিয়েছেন ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা।
মাউশি সূত্র জানায়, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রস্তুত করে এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ইএমআইএস) সেল। এই সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট খন্দকার আজিজুর রহমান অসুস্থ। তাই বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রস্তুত করা যায়নি।
জানা গেছে, আজিজুর রহমান অসুস্থ। বিকল্প জনবল না থাকায় বেতন বিল তৈরির কাজ সম্পূর্ণ থমকে আছে। ফলে শিক্ষকরা তাদের ড্যাশবোর্ডে প্রয়োজনীয় তথ্য দেখতে পাচ্ছেন না। অনেকের আশঙ্কা, বড় কোনো সংকট ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
সূত্র বলছে, ইএফটি (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) পদ্ধতিতে বেতন দেওয়ার জন্য মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠক করলেও কার্যকর কোনো সমাধান আসেনি। একজন কর্মকর্তার ওপর নির্ভরশীল এ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে।
শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, দেশে অনেক আইটি বিশেষজ্ঞ থাকলেও মাউশি তাদের সাহায্য নিচ্ছে না। মার্চে যারা ইএফটির মাধ্যমে বেতন পেয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ অবসরে গেলে, মারা গেলে বা চাকরি ছাড়লে সফটওয়্যারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেতন স্থগিত হওয়ার কথা। তাহলে অন্যদের বেতন বিলম্বিত হওয়ার কারণ গ্রহণযোগ্য নয়।
বেসরকারি শিক্ষকদের অভিযোগ, সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যথাসময়ে বেতন পেলেও এমপিওভুক্তরা বারবার বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
জানা গেছে, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এক লাখ ৮৯ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী ইএফটির আওতায় আসেন। এর পর ধাপে ধাপে আরও প্রায় দেড় লাখ শিক্ষক ইএফটিতে যুক্ত হন। তবে বহু শিক্ষক এখনও এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি।
শিক্ষকদের তথ্যভিত্তিক নানা ত্রুটি (এনআইডি, এমপিওশিট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা জন্মতারিখ ও নামের বানানগত অসংগতি) দূর করা যায়নি। ফলে তাদের বেতন আটকে আছে। কেউ সংশোধনের আবেদন করলেও তা নিষ্পত্তি হয়নি।
ইএমআইএস সেলের প্রোগ্রামার মো. জহির উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘কাজ এখনও শেষ হয়নি। তবে দ্রুত শেষ হবে।’
মাউশির কর্মকর্তারা জানান, কাজ শেষ হলেও শিক্ষকদের বেতন পেতে আরও চার-পাঁচ দিন লাগবে। ফলে এ সপ্তাহে কাজ শেষ না হলে এপ্রিলের বেতন পৌঁছতে পারে মে মাসের শেষ সপ্তাহে।
এই সংকট নিরসনে দ্রুত ও দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং আইটি সহযোগিতা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা।
শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সভাপতি অধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদ সমকালকে বলেন, একজন কর্মকর্তার অসুস্থতার কারণে পাঁচ লাখ
শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বন্ধ থাকতে পারে না। এটি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর প্রতি অবহেলা ও ষড়যন্ত্র। ঈদুল আজহার আগে পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতাসহ মে মাসের বেতন না দেওয়ার জন্য এটি ষড়যন্ত্র হতে পারে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান ও পরিচালক (মাধ্যমিক) কে এম এ এম সোহেল সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলছেন। গত বৃহস্পতিবার দফায় দফায় কল করলেও তারা ফোন ধরেননি।
আজ মাউশি ঘেরাও
শনিবারের মধ্যে এপ্রিল মাসের বেতন ছাড় না হলে আজ রোববার সকাল ১০টায় মাউশি ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি দিয়েছে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করার দাবিতে পরিষদের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি থেকে গতকাল শনিবার এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
কর্মসূচি থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে ঈদুল আজহার আগে পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার দাবি জানানো হয়েছে।
অবস্থান কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যেসব শিক্ষক নেতারা অংশ নেন, তারা নানা বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। শিক্ষকরা বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমে মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে হবে। বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে। আর্থিক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সব বাধা ঘুচিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।