দুর্নীতি করে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক অধ্যক্ষ
Published: 21st, May 2025 GMT
সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় ২ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। পরে যুবলীগ নেতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। এ পদে বসেই তাঁর দিনবদল শুরু। জনবল নিয়োগ, শিক্ষার্থী পরিবহন, ফরম পূরণের বাড়তি টাকা, সেশন ফিসহ গত ১২ বছরে তিনি অর্ধশত কোটি টাকা পকেটে ভরেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলেও রাজনৈতিক তদবিরে গত ১২ বছর সব কিছু চাপা দিয়ে রাখেন। ক্ষমতাধর এই ব্যক্তি হলেন বগুড়া করোনেশন ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে সাসপেন্ড হওয়া আমিনুল ইসলাম।
২০০১ সালে এ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক কাম অধ্যক্ষের মৃত্যুর পর আমিনুল ইসলাম প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির চেয়ারে বসে জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশীষ পোদ্দার লিটন তাঁকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন।
অভিযোগ রয়েছে, অধ্যক্ষের দায়িত্ব পেয়ে সভাপতির সঙ্গে যোগসাজশ করে কমিটির অন্য সদস্যদের না জানিয়ে কলেজ শাখায় ১৮ জনবল নিয়োগ দেন। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার দফায় নিয়োগের মাধ্যমে প্রভাষক পদে ২০ লাখ টাকা এবং কর্মচারী পদে ১৫ লাখ টাকা করে অন্তত ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় মার্কা সাতটি বাস কেনেন ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা দিয়ে। অথচ বাসগুলোর একেকটির মূল্য ৫ লাখ টাকার বেশি হবে না বলে জানান বাসচালকরা। এখান থেকে অধ্যক্ষের পকেটে ওঠে অন্তত ৪৫ লাখ টাকা।
স্কুল বাসে যাতায়াত করা ৩৫০ শিক্ষার্থী থেকে ৫০০ টাকা করে প্রতি মাসে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানের হিসাব নম্বরে জমা না করে অধ্যক্ষ পকেটে ভরেন। প্রতি বছর সেশন ফি আড়াই হাজার টাকা করে ৮০০ শিক্ষার্থীর প্রায় ২০ লাখ টাকা, ফরম ফিলাপের বাড়তি নেওয়া সাড়ে ৪ লাখ টাকাও তিনি হাতিয়ে নেন। কলেজ এমপিওকালে স্টাফপ্রতি ২ লাখ করে প্রায় ৭৫ লাখ টাকা কৌশলে নেন। প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৩ লাখ টাকার এফডিআর, উন্নয়ন ফান্ডের ২ কোটি ও দরিদ্র উন্নয়ন ফান্ডের ২০ লাখ টাকাও আত্মসাৎ করেন। এভাবে গত এক যুগেই অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি।
যত অর্থ-সম্পদ
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আমিনুল ইসলাম বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়ায় ৯ শতক জমির ওপর ৫ তলা বাড়ি করেছেন, যার বাজারমূল্য কমপক্ষে জমিসহ ৮ কোটি টাকা। আছে ৪ কোটির ১৪ শতক জমির ওপর টিনশেড বাগানবাড়ি। কলোনিতে ৪ শতকের ৮০ লাখ টাকার প্লট। ঢাকার মোহাম্মদপুরে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট। স্ত্রী ও নিজের নামে সঞ্চয়পত্র রয়েছে কোটি টাকার। গ্রামের বাড়িতে কৃষি জমি ৭ বিঘা। নামে-বেনামে আরও অর্থ-সম্পদ রয়েছে।
নামেই কমিটির সদস্য
প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির ১১ সদস্যের মধ্যে ৯ জনকে কোনোদিন সভায় ডাকা হয়নি। সভাপতি ও অধ্যক্ষ সব বিষয়ে গোপনে সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্য সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করে রেজুলেশন করেন। এভাবে এক যুগ রাজত্ব করেছেন তিনি।
কমিটির অভিভাবক সদস্য আজাহার আলী বলেন, কাগজে-কলমে আমাকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে; কিন্তু প্রথম এক দিন ছাড়া আর কোনোদিন ডাকা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের কোনো কিছুই জানানো হয় না অন্য সদস্যদের। আমাদের স্বাক্ষর জাল করে কাজ করেন অধ্যক্ষ।
ম্যানেজিং কমিটির আরেক সদস্য পলি বেগম বলেন, আমাকে শুধু নামেই অভিভাবক সদস্য করা হয়েছে। কোনো দিন কোনো সভায় ডাকা হয়নি। এমনকি কোনো অনুষ্ঠানেও ডাকা হয় না।
কর্তৃপক্ষের কাছে যত অভিযোগ
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড ও জেলা প্রশাসকের কাছে অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন অভিভাবক ও এলাকাবাসী। ২০১৩ সালে করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করেন। তদন্ত কমিটি একাধিকবার তদন্ত করতে গিয়ে অধ্যক্ষকে প্রতিষ্ঠানে পাননি। নিজেকে বাঁচাতে এক পর্যায়ে তিনি আদালতে মামলা করে তদন্ত কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ নেন।
এদিকে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে তদন্ত করেন বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রহিম। তিনি বোর্ডে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে বলেছেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। অধ্যক্ষের এমপিও বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেন ইউএনও।
এ ছাড়া দুদক বগুড়ায় অধ্যক্ষের দুর্নীতির বিষয়ে গত ১৫ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ করেন শিক্ষকরা। সেখানে অধ্যক্ষ কোন খাতে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার বর্ণনা তুলে ধরে অর্থ-সম্পদেরও তালিকা দেন। তাতে বলা হয়, এ পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা আমিনুল ইসলাম আত্মসাৎ করেছেন। বগুড়ার দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, অভিযোগ তদন্তের জন্য অনুমোদন দিতে প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। অনুমোদন পেলে তদন্তকাজ শুরু করা হবে।
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আরাফাত হোসেন গত ১৫ সেপ্টেম্বর ম্যানেজিং কমিটির সভায় অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক গত ২২ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানে এসে অধ্যক্ষকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ মিথ্যা। আমি প্রতিষ্ঠানের কোনো টাকা আত্মসাৎ করিনি। কমিটির সদস্যদের নিয়েই নিয়মিত সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
করোনেশন ইনস্টিটিউশনের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, যেটুকু অর্থ-সম্পদ আছে, তা আমার রোজগারের টাকায় করেছি। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে কিছু শিক্ষক-কর্মচারী। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি। একাধিকবার ফোন করলেও কেটে দেন।
বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আরাফাত হোসেন বলেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত শেষে তাঁর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কর্তৃপক্ষ।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মো.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম ন ল ইসল ম ২০ ল খ ট ক তদন ত ক র সদস য কর ছ ন কম ট র
এছাড়াও পড়ুন:
ঝড়-বৃষ্টিতে সীমানা প্রাচীর ধসে শিশুর মৃত্যু
নাটোরের বড়াইগ্রামে ঝড়-বৃষ্টিতে সীমানা প্রাচীর ধসে বিথি খাতুন নামে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী নিহত হয়েছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যার দিকে উপজেলার আগ্রান গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত বিথি ওই এলাকার কৃষক আবু বক্করের বড় মেয়ে।
জানা যায়, বুধবার সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে যায় আকাশ, শুরু হয় প্রবল ঝড় ও ভারি বৃষ্টি। এ সময় বিথি বাড়ির সীমানা প্রাচীরের পাশে থাকা একটি ট্যাপ কলে হাত-পা ধুচ্ছিল বিথি। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া এবং অতিবৃষ্টির চাপে পুরনো প্রাচীরটি ধসে পড়ে বিথির ওপর। ভেঙে পড়া প্রাচীরের নিচে চাপা পড়ে সে। বিষয়টি দেখতে পেয়ে বিথির পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে বেসরকারি একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই বিথি মারা গেছে।
বিথির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বড়াইগ্রাম থানার ওসি গোলাম সারোওয়ার হোসেন বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া চলমান।