সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় ২ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। পরে যুবলীগ নেতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। এ পদে বসেই তাঁর দিনবদল শুরু। জনবল নিয়োগ, শিক্ষার্থী পরিবহন, ফরম পূরণের বাড়তি টাকা, সেশন ফিসহ গত ১২ বছরে তিনি অর্ধশত কোটি টাকা পকেটে ভরেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলেও রাজনৈতিক তদবিরে গত ১২ বছর সব কিছু চাপা দিয়ে রাখেন। ক্ষমতাধর এই ব্যক্তি হলেন বগুড়া করোনেশন ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে সাসপেন্ড হওয়া আমিনুল ইসলাম।
২০০১ সালে এ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক কাম অধ্যক্ষের মৃত্যুর পর আমিনুল ইসলাম প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির চেয়ারে বসে জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশীষ পোদ্দার লিটন তাঁকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। 

অভিযোগ রয়েছে, অধ্যক্ষের দায়িত্ব পেয়ে সভাপতির সঙ্গে যোগসাজশ করে কমিটির অন্য সদস্যদের না জানিয়ে কলেজ শাখায় ১৮ জনবল নিয়োগ দেন। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার দফায় নিয়োগের মাধ্যমে প্রভাষক পদে ২০ লাখ টাকা এবং কর্মচারী পদে ১৫ লাখ টাকা করে অন্তত ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় মার্কা সাতটি বাস কেনেন ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা দিয়ে। অথচ বাসগুলোর একেকটির মূল্য ৫ লাখ টাকার বেশি হবে না বলে জানান বাসচালকরা। এখান থেকে অধ্যক্ষের পকেটে ওঠে অন্তত ৪৫ লাখ টাকা। 
স্কুল বাসে যাতায়াত করা ৩৫০ শিক্ষার্থী থেকে ৫০০ টাকা করে প্রতি মাসে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানের হিসাব নম্বরে জমা না করে অধ্যক্ষ পকেটে ভরেন। প্রতি বছর সেশন ফি আড়াই হাজার টাকা করে ৮০০ শিক্ষার্থীর প্রায় ২০ লাখ টাকা, ফরম ফিলাপের বাড়তি নেওয়া সাড়ে ৪ লাখ টাকাও তিনি হাতিয়ে নেন। কলেজ এমপিওকালে স্টাফপ্রতি ২ লাখ করে প্রায় ৭৫ লাখ টাকা কৌশলে নেন। প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৩ লাখ টাকার এফডিআর, উন্নয়ন ফান্ডের ২ কোটি ও দরিদ্র উন্নয়ন ফান্ডের ২০ লাখ টাকাও আত্মসাৎ করেন। এভাবে গত এক যুগেই অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি। 

যত অর্থ-সম্পদ
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আমিনুল ইসলাম বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়ায় ৯ শতক জমির ওপর ৫ তলা বাড়ি করেছেন, যার বাজারমূল্য কমপক্ষে জমিসহ ৮ কোটি টাকা। আছে ৪ কোটির ১৪ শতক জমির ওপর টিনশেড বাগানবাড়ি। কলোনিতে ৪ শতকের ৮০ লাখ টাকার প্লট। ঢাকার মোহাম্মদপুরে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট। স্ত্রী ও নিজের নামে সঞ্চয়পত্র রয়েছে কোটি টাকার। গ্রামের বাড়িতে কৃষি জমি ৭ বিঘা। নামে-বেনামে আরও অর্থ-সম্পদ রয়েছে।

নামেই কমিটির সদস্য 
প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির ১১ সদস্যের মধ্যে ৯ জনকে কোনোদিন সভায় ডাকা হয়নি। সভাপতি ও অধ্যক্ষ সব বিষয়ে গোপনে সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্য সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করে রেজুলেশন করেন। এভাবে এক যুগ রাজত্ব করেছেন তিনি। 
কমিটির অভিভাবক সদস্য আজাহার আলী বলেন, কাগজে-কলমে আমাকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে; কিন্তু প্রথম এক দিন ছাড়া আর কোনোদিন ডাকা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের কোনো কিছুই জানানো হয় না অন্য সদস্যদের। আমাদের স্বাক্ষর জাল করে কাজ করেন অধ্যক্ষ।
ম্যানেজিং কমিটির আরেক সদস্য পলি বেগম বলেন, আমাকে শুধু নামেই অভিভাবক সদস্য করা হয়েছে। কোনো দিন কোনো সভায় ডাকা হয়নি। এমনকি কোনো অনুষ্ঠানেও ডাকা হয় না।

কর্তৃপক্ষের কাছে যত অভিযোগ
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড ও জেলা প্রশাসকের কাছে অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন অভিভাবক ও এলাকাবাসী। ২০১৩ সালে করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করেন। তদন্ত কমিটি একাধিকবার তদন্ত করতে গিয়ে অধ্যক্ষকে প্রতিষ্ঠানে পাননি। নিজেকে বাঁচাতে এক পর্যায়ে তিনি আদালতে মামলা করে তদন্ত কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ নেন। 
এদিকে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে তদন্ত করেন বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রহিম। তিনি বোর্ডে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে বলেছেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। অধ্যক্ষের এমপিও বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেন ইউএনও।
এ ছাড়া দুদক বগুড়ায় অধ্যক্ষের দুর্নীতির বিষয়ে গত ১৫ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ করেন শিক্ষকরা। সেখানে অধ্যক্ষ কোন খাতে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার বর্ণনা তুলে ধরে অর্থ-সম্পদেরও তালিকা দেন। তাতে বলা হয়, এ পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা আমিনুল ইসলাম আত্মসাৎ করেছেন। বগুড়ার দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, অভিযোগ তদন্তের জন্য অনুমোদন দিতে প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। অনুমোদন পেলে তদন্তকাজ শুরু করা হবে।

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আরাফাত হোসেন গত ১৫ সেপ্টেম্বর ম্যানেজিং কমিটির সভায় অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক গত ২২ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানে এসে অধ্যক্ষকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ মিথ্যা। আমি প্রতিষ্ঠানের কোনো টাকা আত্মসাৎ করিনি। কমিটির সদস্যদের নিয়েই নিয়মিত সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। 

করোনেশন ইনস্টিটিউশনের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, যেটুকু অর্থ-সম্পদ আছে, তা আমার রোজগারের টাকায় করেছি। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে কিছু শিক্ষক-কর্মচারী। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি। একাধিকবার ফোন করলেও কেটে দেন।
বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আরাফাত হোসেন বলেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত শেষে তাঁর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কর্তৃপক্ষ।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মো.

আসাদুজ্জামান বলেন, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। সে জন্য বগুড়ার ওই অধ্যক্ষকেও দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম ন ল ইসল ম ২০ ল খ ট ক তদন ত ক র সদস য কর ছ ন কম ট র

এছাড়াও পড়ুন:

রাইজিংবিডিতে সংবাদ প্রকাশ: ডেরা রিসোর্টের লাইসেন্স বাতিল

মানিকগঞ্জের ঘিওরের বালিয়াখোড়ায় অবস্থিত ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের নানা অনিয়ম নিয়ে রাইজিংবিডিতে ‘কবরস্থানে হরিণের খামারসহ নানা অনিয়মের আখড়া ডেরা রিসোর্ট’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স বাতিল করেছে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে ডেরা রিসোর্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর)  বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সহকারী নিয়ন্ত্রক (সিনিয়র সহকারী সচিব) শেখ রাশেদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনা পত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে। 

জানা গেছে, ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টার ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদন করেন। নানা অনিয়মের কারণে তাদের লাইসেন্স নামঞ্জুর করা হয়েছে। রিসোর্টের লাইসেন্স না থাকায় প্রশাসনকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘ফসলি জমি দখল করে ডেরা রিসোর্ট নির্মাণ, বিপাকে কৃষক’; ১৯ মার্চ ‘ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে ডেরা রিসোর্ট, তদন্ত কমিটি গঠন’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে রাইজিংবিডি। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ‘কবরস্থানে হরিণের খামারসহ নানা অনিয়মের আখড়া ডেরা রিসোর্ট’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ডেরার লাইসেন্স নামঞ্জুর করে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, “অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডিতে ডেরা রিসোর্ট নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও ভোগান্তি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদক অনুসন্ধান করে ডেরা রিসোর্টের নানা অনিয়ম তুলে এনেছেন। প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রশাসন লাইসেন্স বাতিল করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে এটি ভালো উদ্যোগ। তবে এসব নির্দেশনা কাগজে কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করাটাই বড় কাজ। নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে সুশাসন নিশ্চিত হবে।” 

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কপি পেয়েছি। সে অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক বলেন, “লাইসেন্সের বিষয়ে কোন নোটিশ এখনও পাইনি আমরা। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিষয়েও জানা নেই। যদি লাইসেন্স বাতিল করে থাকে, তাহলে আমরা আইনিভাবে বিষয়টি সমাধান করব।”

এ বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকালে এশিউর গ্রুপের অঙ্গসংগঠন ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ সাদীর মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

ঢাকা/চন্দন/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ