শ্বাসকষ্ট ও জ্বর নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা হয় আট দিন বয়সী শিশু মোহামদ জিশানকে। দ্বীপের একমাত্র ২০ শয্যার হাসপাতালটিতে নেই কোনো চিকিৎসক। তবে শিশুটির লক্ষণ দেখে তাকে দ্রুত টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে বলেছিলেন সেখানকার দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য সহকারী শহিদুল ইসলাম। কিন্তু সাগর উত্তাল থাকায় তাকে টেকনাফের হাসপাতালে আনা যায়নি। গুরুতর অসুস্থ শিশুটির মৃত্যু হয় একরকম চিকিৎসা না পেয়ে।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল নয়টার দিকে হাসপাতালে মারা যায় দ্বীপের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ তৈয়ুবের ছেলে জিশান। এ নিয়ে দুই দিনের ব্যবধানে হাসপাতালে নিতে না পারায় দ্বীপে অসুস্থ হয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হলো। গত মঙ্গলবার দুপুরের দিকে দ্বীপের গুচ্ছগ্রাম ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো.

আমিনের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ বেলালের মৃত্যু হয়। সাগর উত্তাল থাকায় মঙ্গলবার থেকে আজ দুপুর দুইটা পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে সার্ভিস ট্রলার চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর ফলে অসুস্থ রোগীদের টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া যাচ্ছে না। দ্বীপের ২০ শয্যা হাসপাতাল এত দিন চলছিল একজন অফিস সহায়ক দিয়ে। কয়েক দিন আগে একজন স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ দেওয়া হলেও কোনো চিকিৎসক নেই।

১৮ মে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে প্রথম আলোর অনলাইনে ‘অফিস সহায়ক দিয়েই চলছে হাসপাতাল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর দ্বীপে বিশেষ একজন স্বাস্থ্য সহকারী পাঠানো হয়। তবে দ্বীপবাসীর দাবি অনুযায়ী এখনো যোগ দেননি চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। নেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ও ওষুধ। দ্বীপের জন্য কোনো নৌ অ্যাম্বুলেন্সেরও ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না দ্বীপের ১১ হাজার বাসিন্দা।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সদ্য আসা স্বাস্থ্য সহকারী শহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আজ আট দিন বয়সী শিশু জিশানের মৃত্যু হয় হাসপাতালে। সম্ভবত তার নিউমোনিয়া হয়েছিল। তাকে টেকনাফ নেওয়ার জন্য বলা হলেও সাগর উত্তাল থাকায় নেওয়া যায়নি। এর আগে বেলাল নামের আরও এক শিশুর মৃত্যু ঘটে। তীব্র জ্বর আর জন্ডিসের লক্ষণ ছিল শিশুটির। হাসপাতালের আনার পরপরই মারা যায় সে।

আজ সকালে মারা যাওয়া শিশু জিশানের দাদি হাসিনা বেগম বলেন, জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিল জিশান। এর মধ্যে সেন্ট মার্টিন হাসপাতালে নিয়ে গেলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য টেকনাফ নিয়ে যেতে বলেন সেখানকার স্বাস্থ্য সহকারী। কিন্তু সার্ভিস ট্রলার চলাচল বন্ধ থাকায় চিকিৎসার জন্য টেকনাফে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

পাঁচ বছর বয়সী বেলালের জন্ডিস হয়েছিল বলে ধারণা করছেন বাবা মোহাম্মদ আমিন। তিনি বলেন, ‘সাগর উত্তাল থাকার কারণে সার্ভিস ট্রলার চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে ছেলেটিকে আমরা চিকিৎসাই দিতে পারিনি। আমাদের চোখের সামনেই মারা গেল সে। একটা নৌ অ্যাম্বুলেন্স থাকলে হয়তো ছেলেটা বাঁচত।’

মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন দিন আবহাওয়া খারাপ থাকায় টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে সার্ভিস ট্রলার চলাচল বন্ধ রয়েছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে কেউ টেকনাফে আসতে পারেননি। টেকনাফ থেকেও কেউ সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যেতে পারেননি। আবহাওয়া ভালো হলেই টেকনাফ থেকে যাত্রী ও মালামাল নিয়ে সেন্ট মার্টিনে ট্রলার আসবে বলে জানান সার্ভিস ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভারপ্রাপ্ত ইউপির চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপের বাসিন্দা ও পযর্টকদের কথা বিবেচনা করে ২০০২ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পশ্চিম পাড়ায় প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে একটি হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হয়। হাসপাতালটি ২০ শয্যার হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে দ্বীপের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক প্রণয় রুদ্র প্রথম আলোকে বলেন, সেন্ট মার্টিন হাসপাতালে শুধু একজন অফিস সহায়ক ছিলেন। প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিশেষ ব্যবস্থায় একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে পাঠানো হয়েছে। তিনি এখন দ্বীপের মানুষকে জরুরি চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। জটিল কোনো রোগী হলে টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের সঙ্গে টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন তিনি। তবে এর মধ্যে মঙ্গলবার ও আজ বৃহস্পতিবার সেন্ট মার্টিন দ্বীপে দুই শিশু মারা গেছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব স থ য সহক র প রথম আল চ ক ৎসক র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে

বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।

আরো পড়ুন:

ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০

বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী

প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। 

দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী। 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”

 

শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।

লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।

স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, ‍“হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”

রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?” 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
  • কুবিতে নতুন ১৮ বিভাগ ও ৪ ইনস্টিটিউট চালুর সুপারিশ
  • সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন
  • ৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে