রাজনীতিতে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি বেশ আলাপ হচ্ছে। গঠনমূলক আলোচনার চেয়ে গালাগালই বেশি। আবার কিছু মুখস্থ ধারণারও ছড়াছড়ি আছে।
জনগণবিচ্ছিন্ন ব্যারাকভিত্তিক সশস্ত্র বাহিনী তৃতীয় বিশ্বের সমাজের গণতান্ত্রিক বিকাশে কতটা সঠিক মডেল, সেই বিষয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে এ রকম সব দেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম ও বিকাশ এক রকম নয়।
চীন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম হয়েছে উপনিবেশবিরোধী যুদ্ধ ময়দানে। ভারত-পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কায় তা হয়নি। এখানে আশপাশের অঞ্চলের উদাহরণই দিলাম। বিশ্বের অন্যদিকে বিশেষ করে আফ্রিকায়ও উভয় ধরনের সশস্ত্র বাহিনী আছে। চীন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, কোরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর ঐতিহাসিক ধরনও আবার এক রকম নয়।
যেসব দেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম উপনিবেশবিরোধী যুদ্ধের মাধ্যমে বা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মাঝে, সেগুলোর রাজনীতিতে মতামত ছিল এবং থাকবেই; রাজনীতির মানে যদি হয় দেশ গঠন ও পরিচালনার ব্যাপার। এর কারণ, এসব বাহিনীর জন্ম কলোনিয়াল আদলে হয়নি; বরং কলোনিয়াল হেজিমনির বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে হয়েছে। দেশের জন্মে তারা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। ফলে দেশ গঠনে তাদের মতামত থাকবে না, তা হয় না।
প্রশ্ন হলো, সেই মতামত ও লেনদেনের কাঠামো-পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া কী রকম হবে? চীন এটি এক রকমভাবে করেছে। ভিয়েতনাম এক রকমভাবে করেছে। এ রকম আরও নজির আছে। একেক দেশের বাস্তবতায় এটি একেকভাবে হয়েছে। তবে এ ইস্যু মোকাবিলায় রাজনৈতিক হিম্মতের ব্যাপার ছিল। সৃজনশীলতা ও সাহসের ব্যাপার ছিল। যেসব দেশ পেরেছে, সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেক প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। অনেক দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাও তাতে বাড়তি দৃঢ়তা পেয়েছে। বাংলাদেশের সামনেও এটি একটি কর্তব্য হিসেবে ছিল। বিভিন্ন সময় সেসব নিয়ে কথাও হয়েছে। তবে টেকসই কোনো সমাধান আসেনি। সে রকম পরিণত রাজনীতি গুছিয়ে উঠতে বাংলাদেশের হয়তো আরও সময় লাগবে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সেই আলাপটা উঠতে পারত। অনেক কমিশন হলো, তার সঙ্গে প্রতিরক্ষা কমিশনও হতে পারত।
সেদিকে যাইনি আমরা। অর্থাৎ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় বিষয়গুলোতে মতামত গঠনের পরিসর থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে দূরে রাখার এক ধরনের পুরোনো নীতিতেই আছে বাংলাদেশ।
পাশাপাশি ইদানীং জোরের সঙ্গে যেটি দেখা যাচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। অনেকে এও সদম্ভে বলছেন, তারা ‘রাজনীতিবিদদের চাকর’। রাষ্ট্রীয় অন্য সব পেশাজীবীকেও এভাবে ‘চাকর’ হিসেবে দেখার একটি রেওয়াজ দেখা যায়। অর্থাৎ দেশ গঠনে তাদের মতামত রাখার সুযোগ থাকতে পারবে না।
অথচ ইতিহাসের বিভিন্ন সময় দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদদের হাত থেকে সমাজ-অর্থনীতি-দেশ বাঁচাতে এই ‘চাকর’দের ডাকা হয়েছে, তাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে এবং তারা পেশাগত ঝুঁকি নিয়ে তাতে সাড়া দিলেও নতুন নতুন সহি-রাজনীতিবিদ ও বেসামরিক সুশীল সমাজ কিন্তু টেকসই কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেশকে দিতে পারেনি আজও। সে রকম একটি সময়ে আমরা আবার আছি।
আট মাস আগে সশস্ত্র বাহিনী গণঅভ্যুত্থানকে সমর্থন করে বাহবা পেয়েছিল। জনগণের অংশ হিসেবে এবং সেবক হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর সেই ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল। এখন বলা হচ্ছে, দেশের সংস্কার প্রশ্ন ফয়সালা করবেন কেবল ‘প্রভু’ গোষ্ঠী। প্রভু মানে রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজ। ‘চাকর’ হিসেবে সৈনিকদের চুপ থাকতে হবে। তবে তারা পুরো টিম ব্যারাকে থাকতে পারবে না। সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা রাখতে মাঠে থাকতে হবে। সীমান্তও তাদেরই পাহারা দিতে হবে। কিন্তু সীমান্ত দিয়ে অন্য দেশকে করিডোর দেওয়ার সময় তারা মতামত রাখতে পারবে না! এটিই নাকি গণতান্ত্রিক বিশ্বের রেওয়াজ। রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নেও তাদের মতামত শোনা যাবে না!
সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কের এই যে মুখস্থ অনুসরণ, এটি বাংলাদেশে আদৌ কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে কিনা, সেই অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের একটু খতিয়ে দেখা দরকার এখন। সংস্কারবিষয়ক যাবতীয় আলোচনা রাষ্ট্রীয় সব পেশাজীবী সমাজকে সম্পৃক্ত করে টেকসই হতে পারে কিনা, সেই বিকল্প ভাবনাও বোধহয় দরকার। এ রকম আলোচনার পরিবেশে কেবল নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কিছু কর্মকর্তার অতীতের বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার সুরাহা হতে পারত।
আমাদের ‘প্রভু-সমাজে’র মনোভাব দেখা যাচ্ছে ভিন্ন। দেশের সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচন করে তাদের ক্ষমতা নিয়ে দেশ শাসন করার জন্য পুনঃপুন অনুরোধ-আহ্বানের পরও সেটি করতে চাইছে না বা করতে সমর্থ নয় তারা। উল্টো কলহের জন্য সামাজিক মাধ্যমে নিত্যনতুন ইস্যু তৈরি করে দিচ্ছে ভাড়াটে কর্মীদের হাতে। দক্ষিণ বিশ্বে এমন নজির আর পাওয়া যায় না। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে আমরা দেখেছি সচরাচর সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনে বাধা হয়ে থাকে। এখানে দেখা যাচ্ছে, খোদ বেসামরিক ‘প্রভু’রা সে রকম ভূমিকা নিচ্ছেন। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এই চিত্র বৈশ্বিক বিচারে বেশ অভিনব। একই সঙ্গে বিপজ্জনকও।
বিপদটা বহুমুখী। গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাঠ প্রশাসন স্থবির হয়ে যাচ্ছে, রাজস্ব প্রশাসনে ব্যাপক ক্ষোভ ও নিষ্ক্রিয়তা চলছে। রাজস্ব প্রশাসনের স্থবিরতায় সব ধরনের বন্দরে আমদানি-রপ্তানি মুশকিলে পড়ছে। অন্যদিকে সমাজে শাসকের আসন নিচ্ছে সংঘবদ্ধ মব-স্টাররা। পাশাপাশি উত্তর-দক্ষিণ সব সীমান্তে স্পর্শকাতরতা বাড়ছে। এ রকম অবস্থায় সুস্থভাবে চিন্তা করতে সক্ষম সবারই কি দেশের স্থিতিশীলতার ন্যূনতম উপায়গুলো সুপারিশ করা উচিত নয়? সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ককে ক্রমাগত ক্ষত-বিক্ষত করে প্রত্যাশিত সেই স্থিতিশীলতা বাড়বে, নাকি কমবে? দেশের ভেতরকার দুর্বৃত্ত শক্তি এবং বহির্বিশ্বের প্রতিপক্ষরা কি এ রকম ‘ঐতিহাসিক সুযোগে’ হাতমুড়ে বসে থাকবে?
দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে যেভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের পক্ষগুলো সক্রিয় হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের টিকে থাকা এবং এগোনোর শর্ত নির্ভর করছে সিভিল-মিলিটারি ঐক্য এবং ধনী-গরিবের ব্যবধান কমানোর ওপর। এই দুটো আমাদের বড় ‘ফল্ট লাইন’। এর বাইরেও আরও ফল্ট লাইন আছে। প্রশ্ন হলো, সম্প্রতি যারা সচেতনভাবে ফল্ট লাইনগুলোকে টেনে লম্বা করছে, তাদের আমরা চিহ্নিত করতে পারছি কিনা এবং তাদের থামাতে পারব কিনা?
আলতাফ পারভেজ: লেখক ও গবেষক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ র সশস ত র ব হ ন সশস ত র ব হ ন র ব হ ন র জন ম গণত ন ত র ক র জন ত ব দ এক রকম ন র পর মত মত ক রকম এ রকম
এছাড়াও পড়ুন:
শেষটা রাঙালেন মোস্তাফিজ, জিতল দিল্লি
এবারের আইপিএলে মোস্তাফিজুর রহমান নিলাম থেকে কোনো দল পাননি। শেষবার খেলেছিলেন চেন্নাইয়ে। তাকে এবার ধরেও রাখেনি মাহেন্দ্র সিং ধোনির দল। বাধ্য হয়ে টিভির পর্দাতেই চোখ রাখতে হয়েছিল।
কিন্তু তার কপাল খুলে যায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধে। একাধিক বিদেশী ক্রিকেটার যখন ভারত ছাড়ছিলেন তখন দল গোছানো কঠিন হচ্ছিল ফ্রাঞ্চাইজিগুলোর। স্থগিত হওয়া আইপিএল শুরু হলে মোস্তাফিজকে দলে ভেড়ায় দিল্লি ক্যাপিটালস। মোস্তাফিজ আগেও দিল্লিতে খেলেছিলেন।
দিল্লি সেরা চারে না উঠায় তিন ম্যাচ খেলার সুযোগ হয় বাংলাদেশি পেসারের। গুজরাটের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে কোনো উইকেট না পেয়ে ২৪ রান দিয়েছিলেন। পরের ম্যাচে মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ৩০ রানে পেয়েছিলেন রোহিত শর্মার উইকেট। দুই ম্যাচেই হেরেছিল তার দল।
গতকাল নিজেদের শেষ ম্যাচে পাঞ্জাবের বিপক্ষে বাঁহাতি পেসারের পারফরম্যান্স ছিল দুর্দান্ত। জিতেছে তার দলও। মোস্তাফিজ ৩৩ রানে পেয়েছেন ৩ উইকেট। আগে ব্যাটিং করে পাঞ্জাব কিংস ৮ উইকেটে ২০৬ রান করে। জবাবে দিল্লি শেষ ওভারে ৬ উইকেটের জয় নিশ্চিত করে।
জয়পুরে ৪১৪ রানের ম্যাচে মোস্তাফিজ ৮.২৫ ইকোনমিতে বোলিং করেছেন। যেখানে ডট বল ছিল ৮টি। চার হজম করেছেন ১টি। ছক্কা ২টি।
ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে বোলিংয়ে এসে উইকেটের স্বাদ পান। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান প্রিয়ান্স আয়রা মোস্তাফিজের শর্ট অব লেন্থের বল পুল করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন। প্রথম ওভারে ৫ রানে ১ উইকেট নেন তিনি। দ্বিতীয় ওভারে ১৪ রান বিলিয়ে আসেন।
১৬তম ওভারে নিজের তৃতীয় ওভার করতে আসেন মোস্তাফিজ। এবারও পঞ্চম বলে পেয়ে যান উইকেট। আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান শশাঙ্ক সিং লং অনে ক্যাচ দিয়ে আউট হন। ফিরে এসে মাত্র ৪ রান দেন তিনি। এরপর ইনিংসের শেষ ওভার করতে এসে দক্ষিণ আফ্রিকার পেস অলরাউন্ডার জানসেনকে ফেরান। উইকেটের পেছনে ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে তালুবন্দি করান। ৪ ওভারের দারুণ বোলিং শেষ হয় ওখানেই।
দুই ম্যাচ পর দিল্লি জয় পেয়েছে সামির রিজবীর ব্যাটে। ২৫ বলে ৩ চার ও ৫ ছক্কায় ৫৮ রান করেন সামির। এছাড়া ২৭ বলে ৪৪ রান করেন করুন নায়ার।
১৪ ম্যাচে ৭ জয়ে মোস্তাফিজদের দিল্লির মিশন শেষ হলো।
ঢাকা/ইয়াসিন