দেশের বর্তমান পরিস্থতিতে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

রবিবার (২৫ মে) বিকেল ৫টায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় এ বৈঠক হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা সব রাজনৈতিক দলের একজন করে প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

এদিকে, শনিবার সন্ধ্যার পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।

বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। জামায়াত ও এনসিপি এ বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছে। তিনটি রাজনৈতিক দলই চায় যেন প্রধান উপদেষ্টার অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। ডিসেম্বর থেকে জুনের ৩০ তারিখের মধ্যে নির্বাচন হবে, এর বাইরে যাবে না।”

প্রেস সচিব বলেন, “স্থানীয় নির্বাচনে জোর দিয়েছে এনসিপি। আওয়ামী লীগের আমলের সব নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা চেয়েছে তারা। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ নয়, তাকে সমর্থন জানিয়েছে।”

তিনি বলেন, “মিটিংয়ে প্রতিটি পার্টি প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা আছে বলে জানিয়েছে। পদত্যাগের বিষয়ে সবাই প্রধান উপদেষ্টার প্রতি বলেছেন, পুরো বাংলাদেশের আপনার প্রতি আস্থা আছে। তার নেতৃত্বেই যেন একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয় সেজন্য অনুরোধ করেছেন। প্রফেসর ইউনূস বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে।”

তিনি আরো বলেন, “বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছে। জামায়াত প্রধান উপদেষ্টার টাইমলাইনকে সমর্থন জানিয়েছে। এনসিপিও একই। এনসিপি ও জামায়াত মনে করে না, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য যে একটা পরিবেশ দরকার, সে পরিবেশ নাই। তবে তারা নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের মাধ্যমে জোর দিয়েছেন।”

বিচার প্রক্রিয়ার সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “এই মাসের মধ্যে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ার শুরু হবে। বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার জন্য পার্টিগুলো অনুরোধ করেছে।”

এদিকে, যমুনায় বৈঠকের পর বিএনপি প্রতিনিধিরা বলেছেন, বিএনপি কখনোই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায়নি। তারা জানান, নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে বাদ দেওয়ার জন্য তারা লিখিত বক্তব্য জমা দিয়েছেন।

জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বৈঠকের পর বলেছেন, “জনগণের ভোগান্তি না হয় এমন সময়ে নির্বাচন হওয়া উচিত এবং "নির্বাচনের আগে সংস্কার ও দৃশ্যমান বিচারের কিছু প্রক্রিয়া জনগণের সামনে আসতে হবে।”

এনসিপির প্রতিনিধিদল অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনার সময়ে হওয়া সব জাতীয় নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি এনসিপি যে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, এই বিষয়টিও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় উল্লেখ করেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

এর আগে গতকাল দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে ঢাকার শের-ই-বাংলা নগর এলাকায় পরিকল্পনা কমিশনে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয় “যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সকল কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।”

এর আগে এনইসি সম্মেলন কক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের ‘অনির্ধারিত বৈঠক’ শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন তিনি আমাদের সাথে থাকছেন।”

ঢাকা/হাসান/ইভা 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ড স ম বর প রক র বল ছ ন এনস প ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে

বেশ কয়েক মাস ধরে সংস্কার আর নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তর্কবিতর্ক চলছে। ‍বিএনপি চাইছে ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচন। আর এনসিপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের চাওয়া হলো ব্যাপক আকারে সংস্কারের পর নির্বাচন। আমরা মনে করি, সংস্কার আর নির্বাচন দ্বান্দ্বিক কোনো বিষয় নয়। এ রকম অবস্থায় আমাদের দরকার গণতন্ত্রের মূল ধারণাটা বোঝা এবং বর্তমানে প্রচলিত গণতন্ত্রের প্রায়োগিক বিকল্পগুলো খোঁজা।

দার্শনিক জ্যঁ-জ্যাক রুশো তৎকালীন ইংল্যান্ডে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তাঁর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বইয়ে বলেছিলেন, ‘ইংরেজ জনগণ নিজেদের স্বাধীন ভেবে সুখ পায়। হ্যাঁ, তারা স্বাধীন, তবে তা শুধু ভোটের সময়। কিন্তু পুরোনো প্রার্থীর বদলে নতুন আরেকজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পরপরই এই জনগণ আবারও শিকলে বন্দী হয়ে পড়ে। এর বাইরে তাদের আর কোনো ভূমিকা থাকে না।’

রুশো এর বাইরে জনগণের সাধারণ ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশের কথা বলেছিলেন; অর্থাৎ জনগণের সমষ্টিগত ক্ষমতার চর্চা। এটাকে বলা হয় যূথবদ্ধ বা সামষ্টিক নাগরিকদের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। এটাই হলো গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ। অর্থাৎ জনগণের সার্বভৌমত্বের বহিঃপ্রকাশ। গণতন্ত্রের অন্য ধারণাগুলো হচ্ছে এই প্রকৃত রূপ বাস্তবায়নের উপায় বা পদ্ধতি। যেমন নির্বাচন, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, ডেলিবারেটিভ বা আলোচনাপ্রসূত গণতন্ত্র, গণভোট ইত্যাদি।

আমাদের দেশে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ মুখে বললেও বাস্তবে এটা যে অন্তঃসারশূন্য কথা, সেটা আমরা সবাই জানি। ভোটের পর জনগণের আর কোনো ক্ষমতা থাকে না। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় সরাসরি জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর এটা করার উপায় হলো যূথবদ্ধ নাগরিক গণতন্ত্র। এ ধরনের গণতন্ত্রেই জনগণের সমষ্টিগত স্বার্থ বেশি সুরক্ষা পায়।

গণতন্ত্রের আদি রূপে ফেরত

প্রাচীন গ্রিস, বিশেষ করে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের এথেন্সে গণতন্ত্রের যে ধারা আমরা দেখি, সেখানেও জনগণের যূথবদ্ধ ক্ষমতাচর্চার কথাই বলা হয়েছিল। এথেন্সে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ সাল, অর্থাৎ অ্যারিস্টোটলের মৃত্যু পর্যন্ত যূথবদ্ধ গণতন্ত্রের প্রয়োগ হতে দেখা যায়। কিন্তু কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের কর্মপরিধি এবং কাজের জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জনগণের সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ আর থাকেনি। তাই প্রতিনিধি বাছাইয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগ তথা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে আমরা একজন সংসদ সদস্যকে নির্বাচিত করছি, যিনি আমাদের প্রতিনিধি হয়ে আমরা যেটুকু ক্ষমতা তাঁকে দিয়েছি, তা চর্চা করবেন। উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে দিয়ে আমাদের মতো জনগণের স্বার্থে সেই ক্ষমতার চর্চা করানো। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই সেই ক্ষমতার চর্চা আসলে নিজেদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থেই করে থাকেন।

বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, কোনো এক ব্যক্তি নিজের কারখানা বড় হয়ে যাওয়ার কারণে নিজে আর সেটা দেখাশোনা করতে পারছেন না। তাই একজন ম্যানেজার নিয়োগ করলেন। নিয়োগ পেয়ে ম্যানেজার মালিককে বলছেন, ‘আমি এই কারখানা আমার খেয়ালখুশিমতো চালাব, আপনার আর কিছু বলার নেই। পাঁচ বছর পর এসে দেখে যাবেন সব ঠিক আছে কি না। না থাকলে আমাকে বদল করে নতুন ম্যানেজার নিয়োগ দেবেন।’ 

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের অবস্থা অনেকটাই এই মালিক–ম্যানেজার সম্পর্কের মতো দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ তাদের বাছাই করা প্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিক চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের মধ্যে রাখতে পারছে না। সারা দুনিয়াতেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের এই সমস্যা চলছে। পৃথিবীজুড়ে এখন এর প্রতিকার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। আর তাই গণতন্ত্রের আদি রূপে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে, অর্থাৎ জনগণের যূথবদ্ধ ক্ষমতাচর্চার ধারণায় ফিরে যাওয়া। 

■ আমাদের দেশে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ মুখে বললেও বাস্তবে এটা যে অন্তঃসারশূন্য কথা, সেটা আমরা সবাই জানি। ■ রাজনীতিবিদেরা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তাঁদের একটা সীমাবদ্ধ পরিসরের মধ্যে রাখতে হবে, যেন তাঁরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে কিংবা গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি করতে না পারেন।

এ ধারণার মূল বিষয় হলো রাজনীতিবিদেরা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তাঁদের একটা সীমাবদ্ধ পরিসরের মধ্যে রাখতে হবে যেন তাঁরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে না পারেন কিংবা গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি করতে না পারেন। আর তাই যূথবদ্ধ জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ জরুরি, অর্থাৎ রুশোর সেই ‘জনগণের সাধারণ ইচ্ছা’ ধারণার প্রয়োগ। এর মাধ্যমে জনগণ রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাদের অগ্রাধিকার বাস্তবায়ন করতে পারবে।

এ ধরনের গণতন্ত্রকে শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে নিয়ে আসার মানে এই নয় যে গণতন্ত্রের অন্য পদ্ধতিগুলো বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ নির্বাচন, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র, যেমন গণভোট, আলোচনাপ্রসূত গণতন্ত্র ইত্যাদি একই সঙ্গে অবশ্যই কার্যকর থাকবে। তবে এগুলো জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতি হিসেবেই শুধু থাকবে, দার্শনিক বা নৈতিক ভিত্তি হিসেবে নয়।

গণতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি: সুযোগের সমতা বনাম ফলাফলের সমতা

প্রচলিত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি মূলত সুযোগের সমতা সৃষ্টি করা। এটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক উদারনীতি দর্শনেরও মূল বিবেচ্য। সংসদীয় বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় বিভিন্ন দাবিদাওয়ার মধ্য দিয়ে। যেমন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সমান সুযোগ থাকবে, ফ্লোর ক্রসিং বা সংসদে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ থাকবে, স্পিকার নিরপেক্ষ থাকবে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ থাকবে ইত্যাদি। আর আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, সুস্থ-প্রতিবন্ধী, ক্ষমতাবান-প্রান্তিক ইত্যাদি সব মানুষকে সমান সুযোগ দিতে হবে।

কিন্তু শুধু সমান সুযোগের ধারণায় সমস্যা হলো এতে বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে বিবেচনা করা হয় না। অথচ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে আমরা যে প্রক্রিয়ার কথাই বলি না কেন, ক্ষমতার এই ভারসাম্যই মূলত রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করে। তাই এমন এক ব্যবস্থা দরকার, যেখানে সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ও আমলাতান্ত্রিক এলিটরা চাইলেই রাষ্ট্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারবেন না।

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এলিটদের এই আর্থসামাজিক অসম ক্ষমতা কমানো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ফলাফলের সমতা। গণতন্ত্রের এই দার্শনিক ধারণা অনুযায়ী সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সমান সুযোগের পরিবর্তে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা দিতে হবে। তাহলেই শুধু সমতা নিশ্চিত হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সবাইকে একই পাল্লায় মাপা হয়। অর্থাৎ সুস্থ-প্রতিবন্ধী সবার জন্য একই ব্যবস্থা। তাই এখানে সবার সমান অধিকারপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয় না। 

বিপরীতে যূথবদ্ধ নাগরিকদের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সমান সুযোগের পরিবর্তে ফলাফলের সমতার ওপর জোর দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হয়। এর মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সরাসরি রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি রাষ্ট্রের চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে এলিটদের অসম ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ বা কমানোর সুযোগ থাকে।

সংস্কার উদ্যোগের ধারণাগত ঘাটতি যেখানে

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আমরা রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের ‘তোড়জোর’ দেখতে পাচ্ছি। এসব সংস্কারের মাধ্যমে জোরালো ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ দিয়েছে বিদ্যমান নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে। ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য যেসব চেক অ্যান্ড ব্যালান্স পদ্ধতি সুপারিশ করা হয়েছে, সেখানে নির্বাচিত রাজনীতিবিদেরাই মূল দায়িত্ব পালন করবেন। ধরেই নেওয়া হয়েছে, রাজনীতিবিদেরা প্রয়োজনমতো নিজেদের চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের মধ্যে রাখতে নিজেরাই চেষ্টা করবেন এবং এ বিষয়ে তাঁদের যথেষ্ট ও আবশ্যকীয় আগ্রহ আছে। কিন্তু এই অনুমান অনেকাংশেই ভুল। কেন ভুল, তার অনেক উদাহরণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আমরা দেখেছি।

কমিশনগুলোর সুপারিশে ব্যক্তি ও সমষ্টি—দুভাবেই জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা করা হয়েছে খুবই দুর্বল ও ন্যূনতম জায়গা থেকে। কমিশনগুলোর সুপারিশ দেখলে মনে হয় চেক অ্যান্ড ব্যালান্সকে শুধু রাষ্ট্রের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলেই চলবে। 

বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, প্রতিনিধিত্বমূলক ও দলকেন্দ্রিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক এলিটরা নিজেদের চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করার বদলে একধরনের অশুভ আঁতাত তৈরি করে সুবিধা ভাগাভাগি করে থাকেন। কারণ, এ ব্যবস্থায় অলিগার্কি বা গোষ্ঠীতন্ত্র সৃষ্টি হবেই। যেহেতু রাজনৈতিক এলিটরা সংখ্যায় কম, তাই তাঁরা নিজেদের মধ্যে সহজেই বোঝাপড়া করতে পারেন। আবার তাঁদের সমষ্টিগত সক্ষমতাও বেশি। যেমন সংসদ সদস্যদের শুল্কবিহীন গাড়ি আমদানির নীতি। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়া রয়েছে। তাই ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী দল—দুই পক্ষের সংসদ সদস্যরাই এর বিরুদ্ধে নীরব থাকেন। 

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের ‘পারভার্স কনসেনসাস’ বা বিকৃত ঐকমত্যের অভাব নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতন্ত্রের জন্য সুবিদিত অন্য দেশেও গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি হয়। কিন্তু কমিশনগুলোর সুপারিশে এসব রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং এর সঙ্গে রাজনীতিবিদদের যেসব প্রণোদনা জড়িয়ে রয়েছে, সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি।

সংস্কারের সুপারিশে কমিশনগুলো বলেছে, বিভিন্ন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা ব্যক্তি, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে দলনিরপেক্ষ, তাঁরা সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে সদস্য হিসেবে মনোনীত হবেন। সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্যদের মনোনয়নের কাজটাও করবেন নির্বাচিত রাজনীতিবিদেরাই। 

কিন্তু জনগণের নেতৃত্বে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের যে আলাপ তোলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা খুব বেশি কাজে আসবে না। এর কারণ হলো বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যাবে, যেসব ব্যক্তি রাজনৈতিক দলগুলোর আশীর্বাদ পাবেন, তাঁরাই শুধু উচ্চকক্ষে ঢুকতে পারবেন। ফলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের নীতির বিরুদ্ধে তাঁরা যেতে চাইবেন না। আর তাঁরা যদি সত্যিই দলনিরপেক্ষ হন, তাহলে তাঁদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে দলে ভেড়ানো হবে। ফলে আবারও শুধু এলিটরাই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে। এটা ঠেকাতে হলে রাষ্ট্রে জনগণের সামষ্টিক ও সরাসরি প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করতে হবে।

সংস্কার কমিশনগুলোর মূল মনোযোগ ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে একচেটিয়া ক্ষমতা ঠেকানো। কিন্তু একচেটিয়া ক্ষমতা ঠেকাতে হলে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের ক্ষমতা রাষ্ট্র ও সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে। তা না হলে এর সুফল পাওয়া যাবে না। আমরা চাই এই ব্যবস্থার সম্পূরক হিসেবে সাংবিধানিকভাবে জনগণের সামষ্টিক ক্ষমতা থাকুক। তাহলে আইনি-বেআইনি সব ধরনের অনিয়ম রোধ করা সম্ভব। তাই জনগণকে শক্তিশালী করতে চাইলে প্রয়োজন রাষ্ট্রের ভেতর-বাইরে বেশ কিছু চেক অ্যান্ড ব্যালান্স পদ্ধতি চালু করা।

যূথবদ্ধ নাগরিক গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন যেভাবে

আমাদের প্রস্তাব হলো, রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টি করে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স তৈরি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে—এমন স্থায়ী সাংবিধানিক কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে (সংস্কার কমিশনগুলোর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না); যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শ্রম, আদিবাসী, নারী ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন বা সরকারি কর্ম কমিশনের মতো যেসব সাংবিধানিক কমিশন রয়েছে, এমন হলে চলবে না। এগুলোকে আরও বেশি ক্ষমতা দিতে হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকারই নির্ধারণ করে, এসব কমিশনের নেতৃত্বে কারা থাকবে। তাই এ ব্যবস্থার পরিবর্তন করে কমিশন গঠনে যূথবদ্ধ নাগরিকদের ভূমিকা রাখার সুযোগ রাখতে হবে।

অন্যদিকে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশা, লিঙ্গ ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভিত্তিতে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। যেমন কৃষক, শ্রমিক, নারী, আইনজীবী, সাংবাদিক, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাগরিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, প্রতিবন্ধী ও অন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এসব সংগঠন নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি বাছাই করবে। তারপর তাঁদের জায়গা করে দিতে হবে সংসদের উচ্চকক্ষে। পাশাপাশি এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে, যদি উচ্চকক্ষে মনোনীত এসব সংগঠনের প্রতিনিধিরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন কিংবা গোষ্ঠীতন্ত্রের অংশ হয়ে যান, তাহলে সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে ঐকমত্য গঠন করে সেসব প্রতিনিধিকে বাতিল করতে পারবেন।

একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজন সাংবিধানিক কর্তৃত্বসম্পন্ন নাগরিক পরিষদ গঠন। বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায়ে ওয়ার্ড সভা ও উন্মুক্ত বাজেট মিটিংয়ের মতো জনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কাঠামো আমাদের দেশে রয়েছে। এগুলোকে সহজেই ঢেলে সাজিয়ে আরও বেশি সাংবিধানিক ও আইনি কর্তৃত্ব দিয়ে নাগরিক পরিষদে রূপান্তর করা যায়। ‍উপজেলা পর্যায়েও এমন নাগরিক পরিষদ তৈরি করতে হবে। এরপর এসব নাগরিক পরিষদকে স্থায়ী সাংবিধানিক ক্ষমতাসম্পন্ন স্থানীয় সরকার কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ করতে হবে। মোদ্দাকথা হলো, এলিটরা যেন রাষ্ট্রের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানগুলো কুক্ষিগত করতে না পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর সে জন্যই রাষ্ট্রের সমান্তরালে সমাজ তথা জনগণের যূথবদ্ধ ক্ষমতাকে সাংবিধানিক ও আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে।

ড. মির্জা হাসান বিআইজিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক 

খলিলউল্লাহ্ প্রথম আলোর জলবায়ু প্রকল্প ব্যবস্থাপক


* মতামত লেখকদের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ