গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেডের নামে সাঁওতালদের উচ্ছেদ বন্ধের দাবি ৩২ বিশিষ্ট নাগরিকের
Published: 9th, July 2025 GMT
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেড স্থাপনের নামে সাঁওতাল কৃষকদের উচ্ছেদ এবং উর্বর কৃষিজমি অধিগ্রহণের প্রচেষ্টা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন দেশের ৩২ বিশিষ্ট নাগরিক। একই সঙ্গে বিগত দেড়-দুই দশকে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) স্থাপন নিয়ে সংঘটিত দুর্নীতি ও অনিয়মের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা।
আজ বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, আমরা গভীর উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিগত স্বৈরশাসনের অনুগতদের পথ অনুসরণ করে একশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা এবং একটি দুষ্টচক্র দেশের যত্রতত্র ইপিজেডের নামে উর্বর কৃষিজমি অধিগ্রহণ এবং দরিদ্র কৃষক, বিশেষ করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে উচ্ছেদের পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে।
নাগরিকেরা অভিযোগ করেন, গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্ম এলাকায় বসবাসকারী সাঁওতালদের উচ্ছেদ করতে সেখানে ইপিজেড গড়ার ঘোষণা দিয়ে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অথচ আইন অনুযায়ী এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিবেশগত প্রভাব (ইআইএ) ও সামাজিক প্রভাব (এসআইএ) মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক হলেও সেখানে তা করা হয়নি। শুধু গোবিন্দগঞ্জ নয়, বিগত সময়ে ঘোষিত বেশির ভাগ ইপিজেডের ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়াগুলো মানা হয়নি।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত ১৬ বছরে শতাধিক ইপিজেড স্থাপনের ঘোষণা এসেছে। কিন্তু দেখা গেছে, ৩৩ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেও মাত্র ১০টি প্রকল্প চালু হয়েছে, যার মধ্যে ৮টি সরকারি ও ২টি বেসরকারি। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) বলেছে, এসব অঞ্চল স্থাপনের জন্য খাসজমি, পুনরুদ্ধার হওয়া ভূমি বা অকৃষি জমি ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশই ছিল দু-তিন ফসলি উর্বর কৃষিজমি।
নাগরিকেরা বলেন, অনেক প্রকল্পে বছরের পর বছর কোনো কাজই শুরু হয়নি। অথচ অধিগ্রহণ করা জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু অনেকে ক্ষতিপূরণ পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। জলাধার ভরাট ও পরিবেশ বিনষ্ট করেও অনেক ইপিজেড গড়ে উঠেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে বিগত বছরগুলোতে শত শত কোটি টাকা লুটপাট ও আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত বেশ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেগুলোর জন্য অধিগ্রহণ করা জমির বড় অংশই উর্বর কৃষিজমি বা জলাধার। কোথাও কোথাও উদ্যোক্তারা অবৈধভাবে বালু ফেলে জমি অনুর্বর করে তাতে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করেছেন—নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে এমন একাধিক নজির রয়েছে। এ অবস্থায় বেজা সম্প্রতি তাদের ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাতিল ঘোষণা করেছে। সংস্থাটির বর্তমান চেয়ারম্যানের মতে, বর্তমান বাস্তবতায় আগামী ১০ বছরে ১০টি অঞ্চল করা গেলেই যথেষ্ট।
এই প্রেক্ষাপটে নাগরিকেরা সরকারের কাছে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেছেন। দাবিগুলো হলো গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্ম এলাকায় সাঁওতালদের উচ্ছেদ ঠেকাতে ইপিজেড স্থাপনের প্রচেষ্টা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত বা প্রস্তাবিত ইপিজেড প্রকল্পগুলোর জমি অধিগ্রহণ এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি–অনিয়ম তদন্তে উচ্চপর্যায়ের স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। ইপিজেড বা এসইজেড স্থাপনের নামে কী পরিমাণ উর্বর কৃষিজমি বিনষ্ট হয়েছে এবং এখনো অব্যবহৃত পড়ে আছে, তা নিরূপণ করতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে জবাবদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। যেসব ইপিজেড এখনো অব্যবহৃত রয়েছে, সেগুলোর জমি আইনি প্রক্রিয়ায় কৃষকদের কাছে ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন হামিদা হোসেন, সুলতানা কামাল, খুশী কবির, ইফতেখারুজ্জামান, রাশেদা কে চৌধূরী, শিরীন পারভীন হক, শাহীন আনাম, সুমাইয়া খায়ের, জেড আই খান পান্না, তাসলিমা ইসলাম, সামিনা লুৎফা, শামসুল হুদা, রোবায়েত ফেরদৌস, জোবাইদা নাসরীন, স্বপন আদনান, সালমা আলী, সুব্রত চৌধুরী, তাসনীম সিরাজ মাহবুব, খায়রুল চৌধুরী, পাভেল পার্থ, মিনহাজুল হক চৌধুরী, মণীন্দ্র কুমার নাথ, রোজিনা বেগম, মাইদুল ইসলাম, সাদাফ নূর, রেজাউল করিম চৌধুরী, জাকির হোসেন, দীপায়ন খিসা, সাইদুর রহমান, রেজাউর রহমান লেনিন, সাঈদ আহমেদ ও হানা শামস আহমেদ।
আরও পড়ুনসংবাদ সম্মেলন: গাইবান্ধার সাঁওতালদের জমিতে ইপিজেড নির্মাণের চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকারও১৯ জুন ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ ব ন দগঞ জ প রক র য় প রকল প সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রামে খাল-নালায় মৃত্যু থামছে না
চট্টগ্রামে গত এক দশকে খাল-নালায় পড়ে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র গত ১৮ এপ্রিল নগরীর হিজরা খালে ছয় মাস বয়সী সেহেরীশের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। তবে বেঁধে দেওয়া সাত কর্মদিবসের প্রতিবেদন আড়াই মাসে দিতে পারেনি তারা। এরই মধ্যে গত বুধবার দুপুরে নগরীর উত্তর আগ্রাবাদ আনন্দিপুরে নালায় পড়ে তিন বছর বয়সী মোছাম্মত হুমায়রার মৃত্যু হলো। অবশ্য হুমায়রার মৃত্যুতে তদন্ত কমিটি হয়েছে।
জানা যায়, ২০২১ সালে চট্টগ্রামের খাল-নালায় পড়ে সর্বোচ্চ পাঁচজনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালে তিনজন ও ২০২৪ সালে মারা যান দু’জন। এর আগে ২০১৫ সালে দু’জন ও ২০১৭ সালে একজনের মৃত্যু হয়। তবে চলতি বছর এরই মধ্যে দুই শিশুর মৃত্যু হলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একের পর এক প্রাণহানি হলেও, কী কারণে ও কাদের গাফিলতিতে মর্মন্তুদ এসব ঘটনা, তদন্ত না হওয়ায়– তা অজানা থেকে যাচ্ছে। এসব মৃত্যুর ঘটনায় কাউকে বিচারের মুখোমুখি হতে না হওয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এমনকি নগরীতে ছড়িয়ে থাকা খাল-নালা নামক মৃত্যুফাঁদগুলো সুরক্ষিত করতে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই।
শিশু সেহেরীশের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সচিব আশরাফুল আমিন বলেন, ‘তাড়াহুড়ো করে দায়সারা প্রতিবেদন দিতে চাইনি বলে দেরি হচ্ছে। তা ছাড়া মৃত্যুর কারণ সবাই জানে। ভবিষ্যতে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিরোধের উপায় বের করার চেষ্টা করেছি। এ জন্য চুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থপতি ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ এবং নগরের বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের তদন্ত কার্যক্রমে যুক্ত করেছি।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এটি চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে আশা করছি। এরপর দ্রুত জমা দেব।’
৪১ ওয়ার্ডে ৫৬৩ মরণফাঁদ
২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদে খোলা নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া মারা যান। এরপর নগরের ঝুঁকিপূর্ণ খাল-নালা চিহ্নিত করেছে সিটি করপোরেশন। সে সময় নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া খালের পাড় ১৯ কিলোমিটার এবং উন্মুক্ত নালা ছিল ৫ হাজার ৫২৭ স্থানে। গত এপ্রিলে শিশু সেহেরীশের মৃত্যুর পর সিটি করপোরেশন পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে উন্মুক্ত খাল-নালার তথ্য চায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত ছয় আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ছয়টি জোনে ৪১টি ওয়ার্ডের তালিকা প্রস্তুত করেন। এতে ৫৬৩ জায়গাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ১ নম্বর জোনে ৪৭, দুই নম্বরে ৭৮, ৩ নম্বরে ৬৮, চার নম্বরে ৭৪, ৫ নম্বরে ৩৩ ও ৬ নম্বর জোনে ২৬৩টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে বিভিন্ন জায়গায় নানা আকারের ৮৬৩টি স্ল্যাব, ১৪৬ স্থানে নিরাপত্তা বেষ্টনী ও কয়েকটি জায়গায় ম্যানহোলের ঢাকনা বসানোর কথা ছিল। কিন্তু এসবের তেমন কিছুই হয়নি। ফলে শিশু হুমায়রার মৃত্যুর পর সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-টিআইবি চট্টগ্রামের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘খাল-নালায় পড়ে মৃতরা সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রের কাছে এসব প্রাণের মূল্য নেই। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সিডিএ কিংবা চসিকের কাউকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। মৃত্যুফাঁদে পরিণত হওয়া খাল-নালা সুরক্ষিত না হলে প্রাণহানি থামানো সম্ভব নয়।’
এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জানান, সেহেরীশের মৃত্যুর পর ঝুঁকিপূর্ণ খাল-নালা তারা সুরক্ষিত করেছেন। এরপরও কীভাবে অরক্ষিত জায়গা থেকে গেছে, তা তদন্তে কমিটি হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবে। কারও গাফিলতি পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নালা-খালে পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।