প্লান্ট ক্লিনিকে বদলে যাচ্ছে দেশের কৃষির ভবিষ্যৎ
Published: 1st, July 2025 GMT
মানুষের জন্য আছে নির্দিষ্ট চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র বা হাসপাতাল। আবার পশুপাখির জন্যও রয়েছে প্রাণি হাসপাতাল ও পেট ক্লিনিক। কিন্তু মানুষ বা পশুপাখির মতো উদ্ভিদেরও তো জীবন আছে। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই তাদের অসুস্থতার প্রশ্ন থেকেই যায়।
মানবজাতির খাদ্যশস্য, শাক সবজি, ফলমূল ও বাসস্থান থেকে শুরু করে সবকিছুর জন্যই উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এ দেশের বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদনে উদ্ভিদের পোকা ও রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা জরুরি। কারণ আক্রান্ত একটি উদ্ভিদ থেকে তা সমগ্র ফসলের ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়তে পারে মহামারী আকারে, যা কখনো কখনো দুর্ভিক্ষের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে।
এক সময় গ্রামীণ কৃষকেরা ফসলের রোগবালাই নিয়ে দিশেহারা থাকতেন। কোন গাছে কী রোগ হয়েছে, কী কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত- এসব প্রশ্নের উত্তর তারা পেতেন না সময় মতো। অনেক সময় স্থানীয় দোকানদারের ভুল পরামর্শে ভেজাল ওষুধ কিনে ফসলের আরো ক্ষতি করে বসতেন।
আরো পড়ুন:
‘সবার ভাগ্য বদলায়, খালি হামার বদলায় না’
ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পুড়ল কৃষকের ফসল, ক্ষতিপূরণ দাবি
কিন্তু এখন দৃশ্যপট বদলেছে। কারণ ঢাকা সাভারের ধামরাই উপজেলার শিরামপুর ইউনিয়নে ছোট্ট উদ্যোগে চালু হওয়া দেশের প্রথম ‘প্লান্ট ক্লিনিক’, যা বদলে দিচ্ছে কৃষকদের ভাবনা, জীবন ও আয়ের চিত্র।
প্ল্যান্ট ক্লিনিক হলো- কৃষক কেন্দ্রিক পরামর্শ সেবা, যা গাছের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নির্ণয় ও সমাধান প্রদানের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কৃষকরা আক্রান্ত গাছের নমুনা নিয়ে আসেন বা মাঠে দেখা সমস্যাগুলোর বর্ণনা দেন। আর প্রশিক্ষিত ‘প্ল্যান্ট ডাক্তাররা’ বা কৃষি বিশেষজ্ঞরা কৃষকদের গাছের পোকা ও রোগ নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পরামর্শ দেন। তারা পোকা ও রোগ প্রতিরোধ এবং দমন কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ দেন। যার মধ্যে জৈবিক, সাংস্কৃতিক, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক পদ্ধতির সমন্বয় থাকতে পারে।
উদ্ভিদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকা ও রোগের ব্যবস্থাপনা করে কৃষকের ক্ষতি কমানো এবং রোগের বিস্তার রোধে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও সেন্টার ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োসায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল (সিএবিআই) প্লান্ট ওয়াইস প্লাসের কারিগরি সহায়তায় বর্তমানে বাংলাদেশ জুড়ে ৪০৫টি প্লান্ট ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। যেখানে উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড.
সফলতার ধারাবাহিকতায় সাভার, ধামরাই, চুয়াডাঙ্গা, মু্ন্সিগঞ্জ ও টাঙ্গাইলসহ দেশ জুড়ে ৪০৫টি প্লান্ট ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে, যার মধ্যে ৩৮৩টি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার ২৮৫টি সমস্যার সমাধান দিয়েছে এই ক্লিনিকগুলো।
সবচেয়ে বড় কথা, এই সেবা কৃষকের জন্য একদম বিনামূল্যে। সরকারের কৃষি বিভাগ, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে এটি পরিচালিত হয়।
প্রতি মাসে সাধারণত দুইবার কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, কখনো কোনো প্রগতিশীল কৃষকের বাড়িতে, কখনো মাঠেই বসে এই ক্লিনিক। সেখানে কৃষকরা তাদের সমস্যার কথা সরাসরি প্লান্ট ডাক্তারের কাছে তুলে ধরেন।
রোগাক্রান্ত পাতার নমুনা নিয়ে এসে জানতে চান কী সমস্যা হয়েছে এবং কীভাবে তার সমাধান করা যায়। সেই সমস্যার সমাধান তারা পান সঙ্গে সঙ্গেই। শুধু মুখের কথাতেই নয়, ওষুধের নাম, পরিমাণ এবং ব্যবহারের নিয়ম এসএমএসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কৃষকের মোবাইলে।
এই প্রযুক্তিনির্ভর সেবা এখন হয়ে উঠেছে কৃষকের জন্য এক নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। কৃষকেরা আর ভুল ওষুধে টাকা নষ্ট করছেন না, ফসলও হচ্ছে নিরাপদ। আগের মতো ব্লক অফিসে গিয়েও সময় নষ্ট করতে হচ্ছে না। ফলে রোগের দ্রুত সুরাহা হচ্ছে, ক্ষতি কমছে এবং উৎপাদন বাড়ছে।
এক সময় যেখানে নারীরা কৃষি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে অনেকটাই পিছিয়ে থাকতেন। এখন এই ক্লিনিকের মাধ্যমে তারাও সামনে এগিয়ে আসছেন। কোনো কোনো সেশনে নারীর অংশগ্রহণ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই অংশগ্রহণ শুধু তাদের অবদানকেই নয়, স্বনির্ভরতাকেও প্রকাশ করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, “২০১৩ সালে ঢাকার ধামরাই উপজেলার শিরামপুর ইউনিয়নে বাংলাদেশের প্রথম প্ল্যান্ট ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কৃষি পরামর্শ সেবার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। শুরুতে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় আগ্রহ কম ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি স্থানীয় কৃষকদের জন্য নির্ভরযোগ্য সহায়ক হিসেবে গড়ে ওঠে। যা উদ্ভিদের পোকা ও রোগ নির্ণয় এবং দমন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটায়।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে এই ক্লিনিক ফসলের পোকা ও রোগ নির্ণয়, দমন ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল নিয়ে পরামর্শ দেয়। সাধারণত প্রতি মাসে দুইবার সেশন অনুষ্ঠিত হয়, যা কখনো কৃষকদের বাড়িতে, নির্দিষ্ট স্থানে বা মোবাইল ক্লিনিকের মাধ্যমে সরাসরি মাঠে পরিচালিত হয়। এভাবে কৃষকদের বাস্তবসম্মত সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করা হয়।”
তিনি আরো বলেন, “প্রতি সেশনে গড়ে ১০-১৫ জন কৃষক অংশ নেন, যেখানে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত নারী কৃষক থাকেন। সরাসরি পরামর্শের পাশাপাশি, ক্লিনিকটি ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমেও সেবা প্রদান করে।”
এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, “প্লান্ট ক্লিনিক কৃষকের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করেছে। তারা এখন জানেন, মোবাইলেই তারা পেতে পারেন বৈজ্ঞানিক ও নির্ভরযোগ্য পরামর্শ। তারা এখন শুধুই সমস্যা সমাধানে আসেন না, বরং জানতে চান কীভাবে আরো ভালো ফলন পাওয়া যায় এবং কিভাবে জমির স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায়।”
শিরামপুরে শুরু হওয়া এই ছোট্ট উদ্যোগটি এখন সমগ্র দেশে ছড়িয়েছে। এটি শুধু কৃষকদের সমস্যার সমাধান দেয়নি, দিয়েছে আশার আলো। কৃষক এখন প্রযুক্তি, জ্ঞান ও আস্থার মাধ্যমে গড়ে তুলছে টেকসই কৃষির ভবিষ্যৎ। ‘প্লান্ট ক্লিনিক’ আজ শুধু একটি সেবা নয়, এটি একটি নীরব কৃষি বিপ্লবের নাম।
ঢাকা/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর এই ক ল ন ক ক টতত ত ব ক ষকদ র র জন য ফসল র
এছাড়াও পড়ুন:
লড়তেন কুস্তি, এখন জাদুর বাঁশি’তে মুগ্ধ করে রাখেন তিনি
ছবি: সংগৃহীত