কলেজের সিনিয়র-জুনিয়র মিলে ১৮ জন। ঠিক করলাম যাব চায়ের রাজ্য সিলেটে। সে অনুযায়ী পৌঁছালাম বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ট্রেন আসতে ৪ ঘণ্টা দেরি হলো। অপেক্ষার সময়টা স্টেশনের ওয়েটিং রুম আর প্ল্যাটফর্মে আড্ডা, গানে আর হইহুল্লোড়ে বেশ কেটে যায় আমাদের।
রাত ২টার পর ট্রেন এলে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর ক্লান্ত হয়ে অনেকেই ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়ে। ট্রেনের ঝকঝক শব্দের সঙ্গে আঁধার কেটে যখন ভোরের আলো ট্রেনের জানালা দিয়ে প্রবেশ করল, অভিযাত্রীদের মনে উত্তেজনা বাড়তে থাকল। সকাল ১০টায় আমরা সিলেট স্টেশনে পৌঁছালাম। সেখান থেকে সোজা হোটেলে।
জাফলং এবং আগুন পাহাড়
হোটেলে চেক ইন দিয়ে সকালের নাশতা সারলাম। ২ ঘণ্টা বিশ্রামের পর পৌনে ১টার দিকে আমরা জাফলংয়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। বাহন হিসেবে দুটি কার নিয়েছিলাম আমরা। মুগ্ধ হচ্ছিলাম দূরে মেঘালয় পাহাড়ের সৌন্দর্য আর রাস্তার পাশে সমতলে-টিলায় চা বাগান দেখে। মনে পড়ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার দুটি লাইন– ‘যেথা পাহাড় গগনে উঠে, নীচে নদী বহে ধীরে, সেথা আমার মন উদাস হয়, ফিরে ফিরে।’ আবেগঘন মুহূর্তে আকাশের বুক চিরে নেমে আসে বৃষ্টি। বৃষ্টি, পাহাড়ের দৃশ্য আর সেই সঙ্গে স্পিকারে বাজতে থাকা গানের ছন্দে সবার মন আনন্দে নেচে ওঠে।
বেলা ৩টার দিকে আমরা জাফলং পৌঁছাই। এ যেন এক অপূর্ব প্রাকৃতিক স্বর্গরাজ্য। সবুজ পাহাড়ের কোলঘেঁষা ছোট নদী, স্বচ্ছ জল আর পাথরের সঙ্গে শীতল বাতাসে অন্যরকম এক আনন্দ দেয়। পিয়াইন নদীর কাছাকাছি গিয়ে কেউ নেমে পড়েছিল স্বচ্ছ জলে, আবার কেউ শান্তভাবে নদী তীরে বসেই উপভোগ করছিল সবুজ পাহাড়, স্বচ্ছ জল আর পরিবেশের নিস্তব্ধতা। ফটোসেশন শেষ করে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ফেরার পথ ধরলাম। পথে এক রেস্তোরাঁয় আহারপর্ব সেরে নিলাম। ফেরার পথে গেলাম আগুন পাহাড়ে। ছোট্ট এক পাহাড়ের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে আগুন ধরালে অদ্ভুতভাবে জ্বলে ওঠে আগুনের শিখা। এ কারণে এ পাহাড়ের এমন নামকরণ। স্থানীয়দের ধারণা, গন্ধক গ্যাসের কারণে এমনটা হয়। এদিনের ভ্রমণ শেষে হোটেলে ফিরলাম।
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট ও সাদাপাথর
সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি ছিল। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সবাই একসঙ্গে সকালের নাশতা সারলাম। বৃষ্টির মধ্যে সাড়ে ১০টার দিকে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের উদ্দেশে রওনা হই। দুপুর ১২টায় চৌরঙ্গী ঘাটে পৌঁছালাম আমরা। সেখান থেকে চারটি নৌকা ভাড়া করে রাতারগুল ‘সোয়াম্প ফরেস্ট’-এর দিকে ছুটলাম। দেশের একমাত্র এই জলাবনের সৌন্দর্য এবং সতেজতা চোখে না দেখলে অনুভব করা যায় না। চারদিকে সবুজ বন হওয়ায় রাতারগুলের পানি সবুজাভ দেখায়। জলাবনের যত বেশি গভীরে যাচ্ছিলাম চারপাশে সবুজাভ জল, গাছপালা আর বনের নিস্তব্ধতা যেন আমাদের সম্মোহিত করে তুলছিল। সেখানে পানির নিচ থেকে উঠে আসা গাছের শিকড়ও যেন একটি শিল্পকর্ম, আমাদের নৌকা যেন যাচ্ছিল কোনো এক অলৌকিক পথ ধরে।
রাতারগুলের জলাবন ঘুরে আমরা ঘাটে ফিরে আসি। এরপর যাত্রা শুরু হয় ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের উদ্দেশে।
বিকেল ৪টায় আমরা ধলাই নদীর তীরে পৌঁছাই। আমরা দুটি নৌকা নিয়েছিলাম সাদাপাথর যাওয়ার জন্য। নৌকায় বসতেই পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। ১০ মিনিট পর আমরা সাদাপাথর পৌঁছাই। চারপাশে অজস্র পাথরের ছড়াছড়ি আর সেই সঙ্গে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঠান্ডা জল। অতি স্বচ্ছ জল দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে সবাই নেমে পড়ি জলে। যদিও জল খুব বেশি ছিল না; তবুও স্বচ্ছ জলের স্রোত আর পাথরের আলিঙ্গনে যেন সবার সময় থেমে গিয়েছিল। প্রায় ২ ঘণ্টার সেই আনন্দময় ভ্রমণ শেষে আমরা ফিরে আসি।
মজার ব্যাপার হলো, দ্বিতীয় দিন আমাদের মন এতই তৃপ্ত ছিল যে মধ্যাহ্নভোজের কথাই ভুলে গিয়েছিলাম। হোটেলে ফিরে খাওয়া শেষ করে সবাই মিলে ট্যুর নিয়ে আলোচনা, গল্প-গানে, হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠে। একটানা দু’দিন এত ঘোরাঘুরির পরও সবার শরীর থেকে যেন ক্লান্তি নামক ব্যাপারটি হারিয়ে গিয়েছিল।
পরদিন ঢাকায় ফেরার ট্রেন ছিল দুপুর ১২টায়। আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর নিরবচ্ছিন্ন গল্প-গানে কাটানো সে মুহূর্তগুলোর সমাপ্তি টেনে আমরা আবারও ফিরে আসি নিজেদের গন্তব্যে।
যারা সিলেট যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তাদের জন্য কিছু তথ্য: আমরা ‘হোটেল গার্ডেন ইন’-এ উঠেছিলাম। স্টেশন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্ব। পরিবেশ এবং সেবা মোটামুটি ভালো। যে হোটেলে উঠুন না কেন আগে থেকে বুকিং দেওয়া ভালো। ভ্রমণের জন্য কার বা বাস বেশির ভাগ হোটেল কর্তৃপক্ষই ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। তবে ভাড়ার ব্যাপারে আলোচনা করে নিতে হবে। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প থরখন র ত রগ ল আম দ র আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো’—সিডনির মঞ্চে হিমু-রূপার নস্টালজিয়া
রোববারের সিডনির ম্যাকুয়ারি লিংকস গলফ ক্লাব হলজুড়ে ছিল হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাসের পরিচিত নস্টালজিয়ার আবহ। ‘পড়ুয়ার আসর’ আয়োজিত স্মরণানুষ্ঠান ‘প্রিয় পদরেখা’ ছিল কেবল আলোচনা নয়, এ ছিল হুমায়ূনের সৃষ্টিকে অনুভব করার, তাঁর চরিত্রদের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার এক আবেগঘন আয়োজন। গদ্য, পদ্য, গান ও নাট্য-আলাপ মিলেমিশে মনে রাখার মতো এক আসর।
অপূর্ব এক দৃশ্যের দেখা মিলল। তরুণ শিল্পী রূপন্তি আকিদ—সিডনির বাঙালি কমিউনিটির তরুণ অভিনেত্রী। নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে নিয়মিত অংশগ্রহণ তাঁকে তরুণ প্রবাসী শিল্পীদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে। সেদিন তাঁর পরনে ছিল হিমুর স্বাক্ষররং নীল শাড়ি, হাতে হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমুর আছে জল’ উপন্যাস।
রূপন্তির পাশে ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা মাজনুন মিজান—গায়ে উজ্জ্বল হলুদ পাঞ্জাবি, হাতে ফুল। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন ও টেলিভিশনে দুই যুগের বেশি সময় ধরে অভিনয় করা মিজান বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের নাটক, টেলিফিল্ম ও সিনেমায় কাজ করে দর্শকের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় থাকলেও প্রবাসে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছেন এবং সিডনির শিল্পমহলে তিনি পরিচিত ও সম্মানিত মুখ।
এই নাট্য-আলাপে হিমু ও রূপার ভূমিকায় অভিনয় করেন রূপন্তি ও মিজান। তাঁদের সংলাপ, দৃষ্টিভঙ্গি আর অভিনয়ের কোমল আবেগ যেন মঞ্চে সত্যিই ফিরিয়ে আনল হিমুর হাঁটাচলার সেই নরম আলো, রূপার শান্ত উপস্থিতি আর দুজনের অদ্ভুত অনুভবের জটিল সুন্দর সম্পর্ক।
নাট্য-আলাপ শুরু হতেই মঞ্চ যেন গল্পের পাতায় পরিণত হলো। যখন তাঁদের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো—
‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’
‘না, ভালোবাসি না...কারণ, ভালোবাসলে তো প্রাপ্তির বাসনা থাকে। আমি তোমাকে অনুভব করি।’
তখন হলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল নিস্তব্ধতার গভীর ঢেউ। দর্শকের চোখে ভেসে উঠল হিমু-রূপার নরম, শীতল, হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্তগুলো।
পরিবেশ আরও আবেগময় হয়ে ওঠে পরিচিত সুরে—‘নেশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে...’
গানের সুর মিশে গিয়েছিল সিডনির প্রবাসী আবেগে—হিমুর হলুদ, নীল আর স্নিগ্ধ প্রেমের গন্ধে। ‘পড়ুয়ার আসর’-এর অন্যতম সদস্য রোকেয়া আহমেদ বলেন, ‘তাঁর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে সিডনিতে এই আয়োজন। আমরা চাই তাঁর সৃষ্টির আলো নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাক। প্রবাসে থেকেও তাঁকে নতুন করে উপলব্ধি করার একটি জায়গা তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য।’
আরও পড়ুনগানের সুরে, মেজবানের ঘ্রাণে—সিডনি যেন এক দিনের চট্টগ্রাম১০ নভেম্বর ২০২৫একজন মুগ্ধ দর্শক অনুষ্ঠান শেষে মন্তব্য করেন, ‘মনে হচ্ছিল যেন গল্পের চরিত্ররা সত্যি সত্যি সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আলোচনার প্রতিটি কথাই হৃদয় ছুঁয়ে গেল।’
রোববারের সিডনির ম্যাকুয়ারি লিংকস গলফ ক্লাব হলজুড়ে ছিল হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাসের পরিচিত নস্টালজিয়ার আবহ