বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা প্রদানের মুখ্য ভূমিকায় থাকেন চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান প্রমুখ পেশাজীবী। কিন্তু একদল কর্মী আছে, যাদের নাম তালিকায় থাকে না, যাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ হয় না, অথচ যাদের কাজ ছাড়া হাসপাতালের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। তারা হচ্ছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো দেশের প্রান্তিক জনগণের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মূল ভিত্তি। সেখানে আজ স্বাস্থ্যসেবার এক অপ্রকাশিত ও নীরব সংকট গভীরভাবে বাসা বেঁধেছে। সংকটটি শুধু ওষুধ বা ডাক্তার ঘাটতির নয়। বরং এটি এমন এক অব্যবস্থাপনার ফল, যা হাসপাতালের ভেতরেই রোগ ছড়ানোর উপযোগী পরিবেশ তৈরি করছে। এ সংক্রমণের দায় কোনো একক গোষ্ঠীর নয়; বরং এটি কাঠামোগত ব্যর্থতা।

‘হাসপাতালে গিয়ে ভালো না হয়ে আরও অসুস্থ হয়ে এলাম’– এই অভিযোগটি আজকাল শুধু কথার কথা নয়। এটি বাস্তব। বাংলাদেশে হাসপাতালভিত্তিক রোগ সংক্রমণের হার ক্রমেই বাড়ছে। একটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর রোগী যদি নতুন করে সংক্রমিত হয়, তাহলে সেটি হয় হাসপাতালের পরিবেশের কারণে। এই সংক্রমণগুলো রোগীর সুস্থতা প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করে, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে জীবননাশের কারণও হতে পারে। এই ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একদল মানুষ দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যান হাসপাতালের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে– তারা হলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাদের কাজ কেবল অপরিহার্যই নয়, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

গবেষণা ও কিছু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট মতে, সরকারি হাসপাতালগুলোর অনেকটিতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগী ভর্তি হওয়ার পর নতুন সংক্রমণের শিকার হন। যার মধ্যে রয়েছে– ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, সার্জিক্যাল সাইটইনফেকশন ও সেপসিস। এ সংক্রমণ শুধু রোগীর শারীরিক ক্ষতি করে না; বরং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর আর্থিক বোঝাও বাড়িয়ে তোলে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী? সরকারের স্বাস্থ্য খাতে যেসব সংস্কার হয়েছে– যেমন অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন হাসপাতাল স্থাপন, ডাক্তার নিয়োগ; তার কোনোটিতেই পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থাপনা প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রশিক্ষণ, নিয়োগ, তদারকি ও সম্মান নিশ্চিত না করে কোনো হাসপাতালকে কার্যকরভাবে ‘স্বাস্থ্যকর’ রাখা যায় না।

একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী যখন মাসের পর মাস বিনা গ্লাভস, বিনা মাস্কে হাসপাতালের বর্জ্য অপসারণ করেন– তা কেউ দেখেন না। অথচ সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রথম প্রাচীর তারাই। বাংলাদেশের অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা চুক্তিভিত্তিক বা দৈনিক মজুরিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বেতন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আসে, যা মাসের পর মাস বন্ধ থাকে। কিছু হাসপাতালে দেখা গেছে, একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে ৩০-৪০ শয্যার পুরো ওয়ার্ড পরিষ্কার রাখতে হয়। যেখানে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, একজন কর্মী সর্বোচ্চ ১০-১৫ শয্যার জন্য উপযুক্ত।
আরও উদ্বেগের বিষয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অনেকেই জানেন না কীভাবে সঠিকভাবে জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে হাসপাতালের সংবেদনশীল এলাকাগুলো পরিষ্কার করতে হয়, কিংবা কীভাবে নিজেকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হয়। তাদের কোনো নিয়মিত প্রশিক্ষণ নেই। অনেক সময় নিজেরাই আক্রান্ত হন এবং বিনা চিকিৎসায় বাড়ি ফিরে যান। তবে তাদের জীবন চলে চরম অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ফলে তারা সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা পান না এবং তাদের নিয়মিত বেতন হয় না। কাজের সময় নির্দিষ্ট নয়, কাজের চাপ অমানবিক।

এই কর্মীরা হাসপাতালে রোগীর রক্ত, বর্জ্য, সংক্রমণ, অপারেশনের পরবর্তী জীবাণু ইত্যাদি পরিষ্কারের কাজ করেন– যে কাজটি সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর এই কাজ অত্যন্ত বায়োলজিক্যাল হ্যাজার্ডস বা জীবাণু-সম্পর্কিত বিপদের মধ্যেই পড়ে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিজেরাই বিভিন্ন চর্মরোগ, সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট ও ভাইরাল ইনফেকশনের ঝুঁকিতে থাকেন। কোনো দুর্ঘটনা বা সংক্রমণ হলে সরকারি সাহায্য বা চিকিৎসাসেবাও মেলে না। অনেক সময় প্রতিষ্ঠান এসব দায় অস্বীকার করে।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিয়োগ ব্যবস্থায় রয়েছে বিস্তর অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতি। যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, এই নিয়োগ সাধারণত হয় ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে। প্রতিবছর-দুই বছর মেয়াদে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পায়। তারাই পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেয়। এখানে রয়েছে কর্মী নিয়োগে ঘুষ দাবি, অস্থায়ী চুক্তিপত্র, কাজের পরও বেতন বন্ধ রাখা। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের অভাব একটি বড় সমস্যা। কর্মীদের নিয়মিতভাবে আধুনিক পরিচ্ছন্নতা পদ্ধতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। ফলে তারা পুরোনো পদ্ধতিতেই কাজ করেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচ্ছন্নতা খাতকে এখনও সহায়ক সেবা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর  ফলে পরিচ্ছন্নতা খাতে নেই আলাদা বাজেট লাইন, নেই স্থায়ী নিয়োগ কাঠামো, নেই দক্ষতা উন্নয়ন বা পেশাগত প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইনে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কার্যকর ভূমিকা স্পষ্ট নয়; হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মতামতের কোনো জায়গা নেই। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে স্বীকৃত হন। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের পেশাটি এখনও ‘বর্জ্য অপসারণকারী’ বলেই পরিচিত, যা একটি শ্রেণিবৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ।

মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম: সিনিয়র লেকচারার, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জনস ব স থ য স ক রমণ বর জ য র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

চবি ছাত্রদলের ৪২০ জনের কমিটিতে নারী মাত্র ১১

আংশিক কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রদলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ৪২০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নারী সদস্য রয়েছেন মাত্র ১১ জন। যা শতকরা হিসেবে তাদের অংশগ্রহণের হার মাত্র ২.৬২ শতাংশ।

এর মধ্যে, সহ-সভাপতি পদে একজন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে তিনজন, সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে একজন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে একজন, মানবাধিকার সম্পাদক পদে একজন, সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে একজন, ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক পদে একজন এবং সহ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক পদে দুইজন।

আরো পড়ুন:

বগুড়ায় স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে স্বামী আটক

কুমিল্লায় প্রবাসীর স্ত্রীকে মারধর-তালাক, অন্যজনের সঙ্গে বিয়ে

বুধবার (২৯ অক্টোবর) রাতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে ৬০ জন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ৯২ জন, সহ-সাধারণ সম্পাদক ৬৩ জন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ৬৪ জন এবং সদস্য রয়েছেন ৬২ জন।

এর আগে, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে মো. আলাউদ্দিন মহসিনকে সভাপতি ও আবদুল্লাহ আল নোমানকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি পায় চবি ছাত্রদল। এরপর নানা জটিলতা ও সাংগঠনিক স্থবিরতায় ২ বছর পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি সংগঠনটি। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ৪২০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, একটি কমিটির মেয়াদ থাকে সর্বোচ্চ ২ বছর। সেখানে চবি ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস পর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করেছে কেন্দ্রীয় সংসদ।

এদিকে, গত ১২ অক্টোবর চাকসু নির্বাচনের আগে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে চবি ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতির পদ থেকে মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ মামুনকে সংগঠনের সদস্য পদসহ স্থায়ী বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় সংসদ। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতির পদটি শূন্য রয়েছে।

পূর্বের আংশিক কমিটিতে সভাপতি ছিলেন মো. আলাউদ্দিন মহসিন, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান, সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াসিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেও তারা একই পদে বহাল আছেন।

ঢাকা/মিজান/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
  • ফতুল্লায় দুই ট্রাকের মাঝে পড়ে যুবকের মৃত্যু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩
  • নামতে গেলেই চালক বাস টান দিচ্ছিলেন, পরে লাফিয়ে নামেন
  • তানজানিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের বিজয়ী সামিয়া
  • আমার স্ত্রী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করছেন না: জেডি ভ্যান্স
  • নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ৩১ বিভাগকে প্রস্তুতির নির্দেশ ইসির
  • কর্মদিবসের শেষ দিনে প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু
  • প্রশিক্ষকদের দায়িত্বে উদাসীনতাসহ যেসব অসংগতি উঠে এল প্রাথমিক তদন্তে
  • চবি ছাত্রদলের ৪২০ জনের কমিটিতে নারী মাত্র ১১