গত মাসে সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত নেটওয়ার্ক ইরান ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইরানে ইসরায়েলি হামলায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’–এর মহান স্লোগানের ব্যাপারে গর্ব করেছিলেন। অথচ এ ব্যক্তিকেই গাজায় যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ওয়ান্টেডের তালিকাভুক্ত করেছেন। তিনি তেহরানের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একজন ইসরায়েলি মহিলা পাইলটের গল্প বলছিলেন, যিনি ইরানের ‘ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক স্থাপনাকে নিশানা করেছিলেন। তবে তিনি অন্য অর্থে ইরানি নারী ও সর্বত্র সব মুক্ত মানুষের জন্য লড়াই করছেন।’
ইরানি প্রবাসীদের কেউ কেউ এই মুক্তিকামী মিথকে বিশ্বাস করেছেন। ইতিহাস বলে এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হয়। ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ডব্লিউএমডি) মিথ, আফগানিস্তানের ‘স্বাধীনতায় নারীদের বোমাবর্ষণ’-এর মিথ এবং লিবিয়ার ‘বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য’ রেজিম চেঞ্জের মিথ ছাড়া ভিন্ন কিছু দেখার সুযোগ নেই। 

বেশির ভাগ ইরানি-আমেরিকান যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন এবং ইরানের ওপর বোমাবর্ষণ দেখে ভীত হয়ে পড়েছিলেন। আমি দেখেছি, ইরানি প্রবাসীদের একটি ছোট হলেও অত্যন্ত সোচ্চার অংশ একই ভয়াবহতা দেখে একেবারেই ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে। এই বিভাজন এমন এক মুহূর্তে প্রকাশিত পেয়েছিল, যখন ৯ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার একটি দেশে জীবন ও মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল। এ ছাড়া যখন ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ দায়মুক্তি নিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছিল। ইরানের ওপর আক্রমণকালে ইসরায়েল গাজা ও বৈরুতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত একই ইহুদিবাদী নীতি অনুসরণ করেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত হলো ‘দাহিয়া মতবাদ’-এর মাধ্যমে, যা অপ্রতিরোধ্য শক্তি প্রয়োগ ও বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসের আহ্বান জানায়। এটি ইরানি প্রবাসীদের লক্ষ্য করে একটি সমান্তরাল প্রোপাগান্ডাও চালিয়েছে, যারা সহিংসতাকে মুক্তি হিসেবে তুলে ধরতে তাদের হাসবারা কৌশল ব্যবহার করেছে, যা সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন ঠিক করে। 
‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনকালে এটি বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন যুদ্ধের বিরোধিতাকারী ইরানি-আমেরিকানরা হয়রানি ও প্রোপাগান্ডার ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। গত দুই বছরে এটি কেবল তীব্রতর হয়েছে। ইরানে গণহত্যা বা ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলুন এবং এই প্রবাসী গোষ্ঠীগুলো আপনাকে বিদ্যমান ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সমর্থক’ বলে চিহ্নিত করে। ফিলিস্তিনি ও ইরানি উভয়ের জন্যই মুক্তির পক্ষে অবস্থান নিলে আপনাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।

ইরান সরকার ও তার অপরাধের নিন্দা না করেই যুদ্ধ বন্ধের ডাক দিন, তাহলে আপনি যৌন হয়রানি এবং হয়রানির ঝুঁকিতে পড়বেন। ২০২২ সালে এই গোষ্ঠীগুলো যথাযথভাবে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনে শরিক হয়েছিল ইরানি সরকারের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রতিবাদে। ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৫৫০ জন লোক নিহত হন। তবুও যখন মাত্র ১২ দিনে ইসরায়েল ৯০০ জনেরও বেশি ইরানিকে হত্যা করেছিল, তখন তারা চুপ ছিল।

আমিসহ অনেক ইরানি আমেরিকান  ইসরায়েলের গণহত্যা দেখে ভীত হয়েছি। আশঙ্কা করেছি যে, যদি এ ধরনের নৃশংসতা দায়মুক্তির সঙ্গে সংঘটিত হতে পারে, তাহলে ইরানিদেরও লক্ষ্যবস্তু করা থেকে তাদের কেউই বিরত রাখতে পারবে না। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলপন্থি কণ্ঠস্বর একটি প্ল্যাটফর্ম দিলেও, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মূলত উপেক্ষা করা হয়েছে।
গত এক বছরে আমি ২৫ প্রবাসী ইরানির সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এগুলো জাদালিয়ায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রে যুক্ত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল– কেন এত ইরানি ইসরায়েলকে সমর্থন করে তা বোঝা। বারবার আসা বিষয়গুলো হলো: অভ্যন্তরীণ কল্যাণের চেয়ে তেহরানের আঞ্চলিক অগ্রাধিকার নিয়ে হতাশা; আরব-বিরোধী এবং ইসলামবিদ্বেষ মনোভাবের সঙ্গে জড়িত সামষ্টিক মানসিক ট্রমা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিছক সুবিধাবাদ। ইরান সরকারের প্রতি তাদের বিরোধিতা বিচার-বিবেচনাকে বিকৃত করে দেয়। আর তাদের এই বাস্তবতা থেকে অন্ধ করে দেয় যে, ইসরায়েল যুক্তিসংগত ভূমিকা পালনকারী নয়, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এই অঞ্চলজুড়ে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর দায়মুক্তির লক্ষ্যবস্তু তৈরি করে। যুদ্ধকালে হাসবারা কৌশল দ্বারা এই বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপাপড়া ইরানি শিশুদের ছবি এবং শত শত নিহতের খবরকে দ্রুত রাষ্ট্রীয় প্রচারণা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া হয়। আর দাবি করা হয় যে, নিহতরা সবাই ইরানি বিপ্লবী গার্ড কর্পসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একই রকমভাবে ‘হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়’ থেকে আসা ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর সংখ্যা ইহুদিবাদীরা প্রত্যাখ্যান করেছিল। 
ইরানিরা কয়েক দশক ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে আসছে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা বাইরের শক্তি থেকে আসতে পারে না, যা কারাজ থেকে কেরমানশাহ, তাবরিজ থেকে তেহরান।

সিয়ারা মোয়েজিদিস: ইরানি আমেরিকান আইনজীবী এবং গবেষক; মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম র ক ন স ব ধ নত র জন য প রব স কর ছ ল র ওপর ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারে’ ৩১ ইসরায়েলি সেনা নিহত

গাজায় চলমান অভিযানে নিজেদের মধ্যে ভুলবশত ছোড়া গুলিতে (ফ্রেন্ডলি ফায়ার) ইসরায়েলের অন্তত ৩১ সেনা নিহত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার ইসরায়েলি আর্মি রেডিওর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় ‘স্থল অভিযান’ শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি ৪৪০ সেনা নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৭২ জন অভিযান পরিচালনাসংক্রান্ত দুর্ঘটনায় নিহত হন, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ১৬ শতাংশ।

এ ছাড়া সেনাদের মধ্যে ৩১ জন নিজেদের মধ্যে ভুলবশত ছোড়া গুলিতে, ২৩ জন গোলাবারুদ–সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায়, ৭ জন সাঁজোয়া যানের চাকায় পিষ্ট হয়ে ও ৬ জন অজ্ঞাত গুলিবর্ষণের ঘটনায় নিহত হন।

ইসরায়েলি আর্মি রেডিওর খবরে আরও বলা হয়, গত ১৮ মার্চ ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান আবার শুরু করার পর এখন পর্যন্ত সেখানে ইসরায়েলি ৩২ সেনা নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু দুজন ‘অভিযান পরিচালনা–সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায়’ নিহত হয়েছেন।

গাজায় ‘স্থল অভিযান’ চালাতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি ৪৪০ সেনা নিহত হয়েছেন বলে ইসরায়েলি আর্মি রেডিওর এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৭২ জন অভিযান পরিচালনাসংক্রান্ত দুর্ঘটনায় নিহত হন, যা মোট সেনা মৃত্যুর প্রায় ১৬ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এবং কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় এ বছরের জানুয়ারিতে গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, যা মার্চের শেষভাগে ভেঙে পড়ে।

ইসরায়েলের আরও পাঁচ সেনা কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলেও খবরে বলা হয়েছে। এর মধ্যে উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাওয়া এবং প্রকৌশল সরঞ্জাম ব্যবহারে অসাবধানতার কারণও রয়েছে।

এ ধরনের একটি ঘটনা গত বৃহস্পতিবার রাতেও ঘটেছে। তবে খবরে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুনগাজায় ৪ ইসরায়েলি সেনা নিহত০৬ জুন ২০২৫

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ সংঘাতে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি ৮৮২ সেনা নিহত (স্থল অভিযানে নিহত ৪৪০ সেনাসহ) ও ৬ হাজার ৩২ সেনা আহত হয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান সত্ত্বেও ইসরায়েল গাজায় তাদের গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত এই যুদ্ধে ৫৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

গত নভেম্বরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণহত্যার (জেনোসাইড) মামলা চলছে।

আরও পড়ুনগাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন ইসরায়েলি সেনারা, নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়ছে০২ মে ২০২৫আরও পড়ুনগাজায় ইসরায়েলের ৭ সেনাসদস্য নিহত২৫ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গণহত্যার বিচার ও সংস্কারের পরেই নির্বাচন: নাহিদ ইসলাম
  • গাজায় ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারে’ ৩১ ইসরায়েলি সেনা নিহত
  • বিচার, সংস্কার তারপর নির্বাচন: নাহিদ ইসলাম
  • ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করুন: জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ
  • পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তা ছাড়া কি ইসরায়েল টিকে থাকতে পারবে
  • গাজায় ৪৮ ঘণ্টায় তিন শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল